নভেম্বর ১৯, ২০১৭ ১৪:৩৭ Asia/Dhaka
  • বন্ধুর হাত
    বন্ধুর হাত

সৎ বন্ধু থাকার ইতিবাচক দিক নিয়ে কথা বলছিলাম। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ক্ষেত্রে যেটা লক্ষ্য করা যায় তাহলো অন্যদের আকিদা-বিশ্বাসকে মেনে নেওয়ার মতো সহিষ্ণুতা তৈরি হয়। যার ফলে অন্যদের আচার আচরণের প্রতিক্রিয়া দেখানোর পরিবর্তে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখে।

এইসব গুণ মানুষের সামাজিক ও মানসিক উন্নয়নের নেপথ্য কারণ। আর এইসব গুণই একজন মানুষের ভেতরে পরিবর্তন এনে প্রকৃত বন্ধু হিসেবে গড়ে উঠতে সহযোগিতা করে। আর প্রকৃত হলো সেই বন্ধু যে তার বন্ধুর সুখ-দু:খ, আনন্দ-বেদনায়, দু:সময়-সুসময় সর্বাবস্থায় নিজের বন্ধুকে নি:সঙ্গ রাখে না এবং সবসময় তাকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়। সেইসঙ্গে যে-কোনো পরিস্থিতিতে নিজের কাছে আশ্রয় দেয়।

আসলে বন্ধুত্ব হলো এক ধরনের একটা আত্মিক বন্ধন। এই বন্ধন মানুষকে তার চিন্তা-চেতনা ও কাজকর্মের দিক থেকে কাছে নিয়ে আসে এবং পারস্পরিক সাহায্য সহযোগিতার মধ্য দিয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ জীবনযাপন সুন্দরভাবে কাটে। এজন্যই বলা হয়ে থাকে যে বন্ধুলাভের গুণাবলি হলো সমাজিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা এবং পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক ভিত্তি। সঠিক বন্ধু নির্বাচন করার এবং বন্ধু লাভের যথাযথ উপায়গুলো জানা ব্যক্তির মানসিকতা ও ব্যক্তিত্ব গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বেশিরভাগ মনোবিজ্ঞানী এবং সমাজবিজ্ঞানীদের মতে বন্ধুত্ব হলো ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের পূর্ণতার সহায়ক। সেই শৈশব কৈশোর জীবন থেকেই বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত।

শৈশব থেকেই বন্ধুত্ব

শিশু-কিশোরদের জন্য জীবনের সবচেয়ে আনন্দঘন সময় হলো বন্ধুদের সঙ্গে কাটানোর সময়। বন্ধুদের সঙ্গে এদিক সেদিক যাওয়া আসা করা তাদের সঙ্গে ভালো মন্দ একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় আশয় শেয়ার করার মধ্যে তারা অন্যরকম এক আনন্দ অনুভব করে। বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা, পরামর্শ করার মধ্য দিয়ে তারা তাদের ব্যক্তিগত বিষন্নতা সুখ দু:খবোধ ইত্যাদি দূর করার চেষ্টা করে। অভিজ্ঞ, বুদ্ধিমান এবং মেধাবি বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশার মধ্য দিয়ে তারা তাদের বস্তুগত, আত্মিক ও আধ্যাত্মিক ব্যাপারেও উন্নতি লাভ করতে পারে। তবে কখনো কখনো বন্ধুত্ব হয়ে উঠতে পারে কামনা বাসনা চরিতার্থ করার অভিন্ন চিন্তা কিংবা বস্তুগত স্বার্থসিদ্ধির মাপকাঠিতেও। সেক্ষেত্রে ওই বন্ধুত্ব মানবিক উন্নত অবস্থান থেকে একেবারে রসাতলে চলে যাওয়ার কারণ হয়ে উঠতে পারে। সুতরাং বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা জরুরি। সব বন্ধুকে একই মানদণ্ডে ভাবলে চলবে না।

এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে,তাহলে একজন ভালো বন্ধু কী করে নির্বাচন করবো? বন্ধু নির্বাচনের সঠিক মাপকাঠিগুলো কী? পবিত্র কুরআনের দৃষ্টিতে মানুষের ব্যক্তিত্বের মাপকাঠি সরাসরি তাদের বিশ্বাসের উপর নির্ভরশীল। ঈমানের মতো মূল্যবান ও দুর্লভ মর্যাদার অধিকারী যে নয় তার ব্যক্তিত্ব বন্ধুত্ব গড়ার মতো খুব একটা উন্নত বলা যাবে না। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে: "হে  ঈমানদারগণ, তোমরা আমার এবং তোমাদের শত্রুদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না। তোমরা তাদের সাথে বন্ধুত্ব করার চেষ্টা করছো অথচ যে সত্য তোমাদের কাছে এসেছে তারা তা মানতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে"।

মানুষের ব্যক্তিত্বের ওপর বন্ধুদের ব্যাপক প্রভাবের প্রতি দৃষ্টি রেখে পবিত্র কুরআন সবার কাছে প্রত্যাশা করে বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে যেন সঠিক মানদণ্ডে বিচার করা হয়। সঠিক মানদণ্ড হলো ঐশি মানদণ্ড। কুরআনের মানদণ্ডে বন্ধুকে যাচাই বাছাই করে চিনতে হবে। কারণ হলো স্থায়ী বন্ধুত্ব ঈমানদারদের মধ্যেই হয়ে ওঠে। যেই বন্ধুত্ব কেবল এই পৃথিবীতেই নয় পরকালেও অটুট থাকতে পারে। পবিত্র কুরআন এ প্রসঙ্গে বলেছে কিয়ামতে সব বন্ধুই পরস্পরের শত্রুর মতো থাকবে,শুধুমাত্র মুত্তাকিরা ছাড়া অর্থাৎ যারা আল্লাহকে ভয় করে চলেছে পৃথিবীতে। বন্ধুত্বের নীতি হলো একজন আরেকজনকে প্রয়োজনীয় কাজকর্মে সাহায্য সহযোগিতা করবে। তবে এই সাহায্য যদি আল্লাহর সন্তুষ্টির বিপরীতে যায় তাহলে ধরে নিতে হবে ওই সাহায্য তাকে বিচ্যুতি ও ধ্বংসের দিকে ধাবিত করতেই করা হয়েছে।

বন্ধুত্বের বাড়িয়ে দেওয়া হাত যদি আল্লাহর সন্তুষ্টির বিপরীতে যায় তাহলে ধরে নিতে হবে ওই সাহায্য তাকে বিচ্যুতি ও ধ্বংসের দিতে ধাবিত করতে পারে। পবিত্র কুরআনে কিয়ামতে অত্যাচারী জালেমদের কথা বর্ণনা প্রসঙ্গে ইঙ্গিতে বলা হয়েছে যে বন্ধু নির্বাচনে সেদিন তারা যার পর নাই ব্যথিত ও দু:খিত হবে। সূরা ফুরকানের ২৭ থেকে ২৯ নম্বর আয়াতগুলোতে বলা হয়েছে: জালেম অর্থাৎ মুশরিকরা সেদিন আক্ষেপ করে নিজেদের হাত কামড়াতে থাকবে এবং বলতে থাকবে: হায় ! যদি আমি রসুলের সহযোগী হতাম! হায়! আমার দুর্ভাগ্য, হায়! যদি আমি অমুক লোককে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ না করতাম। তার প্ররোচনার কারণে আমার কাছে আসা উপদেশ আমি মানি নি! মানুষের জন্য শয়তান বড়ই বিশ্বাসঘাতক প্রমাণিত হয়েছে।

সর্বোপরি সামাজিক সম্পর্কের বিচিত্র উপায় ও পদ্ধতি উপস্থাপন করা হয়েছে। কল্যাণ ও উপকার করাও একটি উপায়। এর ফলে বন্ধুত্ব দৃঢ়তা পায় এবং কল্যাণকারীর প্রতি অন্যদেরও সুদৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। সামান্য হাসিও সম্পর্ক সেতু নির্মাণে সহযোগিতা করে এবং আলোচনার পথ খুলে দেয়। কাউকে কাছে আসার সুযোগ দিতে এই মৃদু হাসিটুকুই যথেষ্ট। হাত মেলানো, সালাম করা এবং প্রথম সাক্ষাতে হাসিমুখে কথা বলা ইত্যাদি সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্র সৃষ্টি করে। পবিত্র কুরআন অন্যদের সঙ্গে সুন্দর ও ইতিবাচক সম্পর্ক সৃষ্টির ক্ষেত্রে এই পদ্ধতিকেই সঠিক বলে বর্ণনা করেছে।

সালাম দিয়ে হাসিমুখে হাত মেলানোর মধ্য দিয়ে সম্পর্ক তৈরির ব্যাপারে কুরআন অনুপ্রাণিত করেছে বলে আমরা বলেছিলাম। সূরা ফুসসিলাতের ৩৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:

(তিলাওয়াত)

(সুরায়ে ফুসসিলাত/হা-মিম সিজদাহ: ৩৪)

হে নবী! সৎ কাজ ও অসৎ কাজ সমান নয়। তুমি অসৎ কাজকে সেই নেকী দ্বারা নিবৃত্ত করো যা সবচেয়ে ভাল। তাহলে দেখবে যার সাথে তোমার শত্রুতা ছিল সে অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে গেছে।

দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব গাঢ় করার ক্ষেত্রে উপহার আদান প্রদান করা একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। দুই পক্ষের মাঝে এর মাধ্যমে আন্তরিকতা এবং মুহাব্বাত বেড়ে যায়। উপহারের মাহাত্ম্য হলো দুই পক্ষের মনের ভেতর যত দুষণ আছে, যত পঙ্কিলতা আছে, অনিষ্ট চিন্তা আর রূঢ়তা আছে-সব যেন ধুয়ে মুছে পরিষ্কার হয়ে যায়। এ কারণেই ধর্মীয় শিক্ষায় দেখা যায় বন্ধুদের মাঝে পারস্পরিক সন্তুষ্টি ও আন্তরিকতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে উপহার সামগ্রি বিনিময় করার জন্য ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত করা হয়েছে।

তবে হ্যা! মনে রাখতে হবে উপহার সামগ্রি নিয়ে যেন কোনোরকম হীণমন্যতায় ভুগতে না হয়। হীণমন্যতা বলতে বোঝানো হচ্ছে উপহার সামগ্রি খুব দামি না হলে কেমনে দেওয়া হবে-এ ধরনের চিন্তা করা। না, উপহার উপহারই। সেটা দামি হোক কিংবা কমদামি-তাতে কিছু যায় আসে না। উপহার দেওয়া মানে হলো বন্ধুকে মনে রাখা। সব বন্ধু তো অর্থনৈতিক দিক থেকে সমান নয়। সুতরাং যে যার সামর্থ্য অনুযায়ী উপহার বিনিময় করবে। এ ক্ষেত্রে কোনোরকম লজ্জা কিংবা হীণমন্যতার অবকাশ নেই।

বন্ধু নির্বাচন করার ক্ষেত্রে যেসব উপায় ও পন্থার কথা আমরা বললাম সবই খুব গুরুত্বপূর্ণ। এইসব উপায় আন্তরিকতার সঙ্গে এবং যথাযথ নৈপুণ্যের সঙ্গে প্রয়োগ করতে হবে।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/১৯