জানুয়ারি ২৫, ২০১৮ ১৭:৪৮ Asia/Dhaka

সুরা হুজুরাত পবিত্র কুরআনের ২৬ পারার অন্যতম সুরা। এটি কুরআনের ৪৯ তম সুরা হলেও নাজিল হওয়ার দিক থেকে ১০৬ নম্বর সুরা। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা)'র সঙ্গে আচরণের আদব-কায়দা ও সমাজে পরস্পরের সঙ্গে আচরণের আদব-কায়দা সম্পর্কিত নৈতিক কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এই সুরায় আলোচনা রয়েছে।  তাই এই সুরাকে নৈতিক বিষয় সম্পর্কিত সুরাও বলা যায়।

১৮ আয়াতের মাদানি এই সুরার অলোচ্য আরও কিছু নৈতিক বিষয় হল: মুসলমানদের নানা বিষয়ে সংশোধন ও মধ্যস্থতা বা আপোস-রফা করা, আন্তরিকতা ও সম্প্রীতি সৃষ্টিতে সহায়ক সামাজিক কিছু নৈতিকতা, পরস্পরের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, উপহাস না করা, সন্দেহ ও খারাপ ধারণা পোষণ এবং গুপ্তচরবৃত্তি ও গিবত বা অন্যের পেছনে নিন্দা করা থেকে দূরে থাকা। এ ছাড়া আল্লাহকে মনে রেখে খোদাভীতি ও মানবিক মূল্যবোধের মানদণ্ডগুলো মেনে চলা, ঈমান আনার পাশাপাশি সৎ কাজও করা, ইসলাম ধর্ম গ্রহণের মাধ্যমে আল্লাহ বা মুসলামানদের করুণা করা হয়েছে বলে না ভাবা  এবং  সৃষ্টি জগতের সব রহস্য বা গোপন বিষয় ও মানুষের সব তৎপরতা মহান আল্লাহর জানা থাকা সম্পর্কেও বক্তব্য রয়েছে সুরা হুজুরাতে।

সুরা হুজুরাতের প্রথম আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন,'হে মুমিনরা! তোমরা কোনো কাজেই আল্লাহ ও রসূলের চেয়ে অগ্রণী হয়ো না এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছু শুনেন ও জানেন।'  

-এখানে বলা হচ্ছে যে কোনো কথা ও কাজে মহান আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলের চেয়ে অগ্রণী হওয়া নিষিদ্ধ। কোনা কাজ বা বক্তব্যের ব্যাপারে মহানবী (সা)'র মতো সর্বোচ্চ ধর্মীয় ও সামাজিক বিষয়ে নেতার সঙ্গে পরামর্শ করা বা পরামর্শ দেয়া যেতে পারে। কিন্তু তাঁর অনুমতি না নিয়েই কোনো কথা বা কাজে মশগুল হওয়া মহাঅন্যায় ও মহাপাপ। একবার পবিত্র রমজান মাসের এক সফরের সময় (মক্কা বিজয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরুর পর এক স্থানে) মহানবী (সা) নিজে রোজা ভাঙ্গেন ও সঙ্গীদেরকেও রোজা ভাঙ্গতে বললেন। ফলে অনেক সাহাবি রোজা ভাঙ্গেন। কিন্তু একদল সাহাবি তখনও রোজা না ভেঙ্গে রোজা অব্যাহত রাখেন। বিশ্বনবী (সা) তাদেরকে ‘পাপীর দল’ বলে অভিহিত করেছিলেন।  

পরের আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন:

'হে মুমিনরা! তোমরা নবীর কণ্ঠস্বরের উপর তোমাদের কণ্ঠস্বর উঁচু করো না এবং তোমরা একে অপরের সাথে যেভাবে উঁচুস্বরে কথা বল,তাঁর সাথে সেরূপ উঁচুস্বরে কথা বলো না। এতে তোমাদের কর্ম নিস্ফল হয়ে যাবে এবং তোমরা টেরও পাবে না।'

- এই আয়াতের বক্তব্য অনুযায়ী মহানবী (সা)’র কণ্ঠস্বরের চেয়ে নিজ কণ্ঠস্বরকে উঁচু করা কারো জন্যই শোভনীয় নয়। সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুল ও মহামানব বিশ্বনবীর (সা) সঙ্গে উচ্চস্বরে কথা বলা বড় ধরনের বেয়াদবির শামিল। মহান আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টির সামনে বা তাঁর উপস্থিতিতে যারা নীচু বা নম্রস্বরে কথা বলবে ও আদব রক্ষা করার খোদায়ী বিধান মেনে চলবে তাদের পুরস্কার সম্পর্কে সুরা হুজুরাতের তিন নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন:

‘যারা আল্লাহর রসূলের সামনে নিজেদের কণ্ঠস্বর নীচু করে,আল্লাহ তাদের অন্তরকে তাকওয়া বা খোদাভীতির জন্যে পরীক্ষা করেছেন যাতে তাদের অন্তর পবিত্র ও একনিষ্ঠ হয়। তাদের জন্যে রয়েছে ক্ষমা ও মহাপুরস্কার।’  

-এটা স্পষ্ট যে মহান আল্লাহর রাসুলের সামনে আদব রক্ষা করা ও বিনম্র থাকার অর্থ আল্লাহর সামনেই আদব মেনে চলা। মহান আল্লাহ এ বিষয়টিকে হৃদয়ের পবিত্রতার লক্ষন ও খোদাভীতির গুণ অর্জনের উপযুক্ত হৃদয় বলে অভিহিত করেছেন। আর এর ফলে ক্ষমা ও মহাপুরস্কার রয়েছে বলেও মহান আল্লাহ এই আয়াতে উল্লেখ করেছেন। আর যারা এই খোদায়ী বিধান মেনে চলে না তাদের সম্পর্কে সুরা হুজুরাতের চার নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন:

‘যারা হুজরা বা আপনার কক্ষগুলোর আড়াল থেকে আপনাকে উঁচুস্বরে ডাকে, তাদের বেশিরভাগই অবুঝ।’

হুজুরাত শব্দটি হচ্ছে হুজরা তথা ‘কক্ষ বা কামরা’ শব্দের বহুবচন। মসজিদুন নববী সংলগ্ন এইসব কক্ষে থাকতেন বিশ্বনবী (সা)’র পরিবার-পরিজন। কোনো কোনো সময় অসচেতন বা অজ্ঞ টাইপের লোকজন কোনো কাজের জন্য মহানবীর (সা) সঙ্গে দেখা করতে এসে উঁচু স্বরে ও অভদ্র ভঙ্গীতে চিৎকার করে বলত: এই মুহাম্মাদ! বেরিয়ে আস!

-এই আয়াতে মুসলমানদেরকে এ ধরনের অপছন্দনীয় আচরণে জড়িত হতে নিষেধ করা হচ্ছে। কারণ,বিশ্বনবী (সা)’র উঁচু মর্যাদার আলোকে তাঁর সঙ্গে এ জাতীয় আচরণ গ্রহণযোগ্য নয়।

মহানবী (সা)'র সঙ্গে আচরণ সম্পর্কে আলোচনা পরিপূর্ণ করতে সুরা হুজুরাতের চতুর্থ আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন:

‘যদি হুজরা থেকে আপনার বের হয়ে তাদের কাছে আসা পর্যন্ত তারা ধৈর্য ধরত,তবে তা-ই তাদের জন্যে মঙ্গলজনক হতো। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’

 -এটা স্পষ্ট যে যারা মহানবীর (সা) প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে ও তাঁর সামনে আদব-কায়দা রক্ষা করে চলে এবং ধৈর্য ধারণ করে তাদের ওপর মহান আল্লাহর রহমত বর্ষিত হবে। এ ছাড়াও তারা বড় ধরনের খোদায়ী পুরস্কারের অধিকারী হবে।

মোটকথা ইসলাম অন্যদের সঙ্গে আচার-আচরণে ভদ্রতা রক্ষা ও সম্মান প্রদর্শনের ওপর ব্যাপক গুরুত্ব দেয়। মহানবী (সা) ও ইসলামের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা সব সময়ই অন্যদের সঙ্গে আচার-আচরণে ছিলেন ভদ্র। তাঁদের আচার-আচরণ ছিল সব সময়ই পছন্দনীয় এবং নানা নৈতিক শিক্ষায় ভরপুর।

কুরআনের শিক্ষাগুলো সমাজে যোগায় প্রীতি ও আন্তরিকতার অনুপ্রেরণা। কুরআন মু’মিনদের পরস্পরকে ভাই বলে উল্লেখ করে। তাই ভাইয়ের উচিত ভাইয়ের ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করা। তাদের উচিত দুঃখ-কষ্টের সময় পরস্পরের প্রতি দয়াদ্র হওয়া এবং ওয়াদা ও চুক্তিগুলো মেনে চলা। মু’মিনরা যা নিজের জন্য পছন্দ করবে তা অন্য ভাইয়ের জন্যও পছন্দ করবে। সামগ্রিকভাবে তাদের মধ্যে শান্তি, ভ্রাতৃত্ব ও নিরাপত্তার পরিবেশ বজায় থাকা উচিত।# 

পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/মো: আবু সাঈদ/আশরাফুর রহমান২৫