মার্চ ২৫, ২০১৮ ১৯:৪১ Asia/Dhaka

বন্ধুরা! সালাম নিন। আশা করি যে যেখানেই আছেন ভালো ও সুস্থ আছেন। ইরানি নওরোজ মানে নববর্ষের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন গ্রহণ করুন। আমরা বলেছিলাম যে ইরানে বসন্তের সূচনাই নওরোজ।

বসন্ত আর নতুন বছর একসঙ্গে শুরু হয় বলে আনন্দের জোয়ারটাও দ্বিগুণ হয়ে যায়। নির্জীব প্রকৃতিও হয়ে উঠতে শুরু করে সজীব সবুজ। অতিথি আপ্যায়নের জন্য ফলফলাদি, মিষ্টি, চকোলেট, দানাদার শস্যপণ্য ইত্যাদি কিনে ঘর সাজানো হয়। পেস্তা বাদাম, বাদাম, কাজু বাদাম, সূর্যমুখির বিচি ইত্যাদি ভর্তি করে রাখা হয় ঘরে। নতুন জামা-কাপড় পরা নওরোজের প্রাচীন সংস্কৃতির অংশ। প্রকৃতি যেমন নবরূপে সাজে, তার সঙ্গে মিল রেখে ইরানিরাও নতুনভাবে সাজে।

একদিকে ঝকঝকে ঘর অন্যদিকে নতুন জামা কাপড়ের রঙীন সাজ সবমিলিয়ে অপূর্ব এক আনন্দঘন পরিবেশ সৃষ্টি হয় এই নওরোজে। প্রফুল্লতায় ভরে ওঠে মন,ভরে ওঠে উদারতায় বিশাল। নওরোজে ইরানের প্রায় প্রতিটি ঘরেই সবুজের আগমন ঘটে। গম,ডাল কিংবা মাষকলাই ডাল ছোট মাটির পাত্রে বা প্লেটে পানিতে রাখা হয় এবং অল্প সময়ের মধ্যে সেগুলো থেকে সবুজ চারা গজায়। একটা বিশেষ পদ্ধতিতে এই চারাগুলোর যত্ন নেয়া হয় বলে একেবারেই তরতাজা হয়ে ওঠে। জীবনের প্রতীক, বরকতের প্রতীক এই চারাগাছগুলোকে হাফত-সিন টেবিলে রাখা হয়। বসন্ত ঋতুতে গাছপালার সবুজ হয়ে ওঠাকে পারলৌকিক জীবনের প্রমাণ বলে মনে করা হয়। ১৩ দিন টেবিলে বা দস্তরখানে রাখার পর এই সবুজ চারাগুলো আরও বড় হয়ে যায় এবং সিজদাহ বেদার বা প্রকৃতি দিবসে প্রবহমান পানি কিংবা বনে বাদাড়ে রেখে দেয়।   

আরও কত আয়োজন, কত আচার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে যে বরণ করা হয় এই নওরোজকে, তা না দেখলে উপলব্ধি করা সত্যিই দুষ্কর।  চারদিকে প্রাণের মেলা, আনন্দের বিচিত্র আয়োজন। আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে এবং অবস্থার ইতিবাচকতা কামনা করে সূচনা হয় সকল আয়োজনের। যে দোয়াটি পড়ে শুরু করা হয় সেটি হলো:  

"হে অন্তর ও দৃষ্টির পরিবর্তনকারী এবং দিন ও রাতের পরিচালনাকারী এবং অবস্থার পরিবর্তনকারী মহান আল্লাহ! আমাদের অবস্থাকে সর্বোত্তম অবস্থায় রূপান্তরিত করো।"

আমরা এই নওরোজের সমৃদ্ধ সংস্কৃতির সঙ্গে আজকের আসরেও আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবো।

ইতোপূর্বে আপনারা 'হাফত-সিন' টেবিলের কথা শুনেছেন। "হাফত-সিন" মানে সাতটি "সিন"। ফার্সি বা আরবী বর্ণমালার "সিন" অক্ষর দিয়ে শুরু হওয়া সাতটি জিনিসকে হাফত-সিন বলা হয়। যেমন "সাবজে" বা গম বা ডালের সবুজ চারা,সামানু বা গমের চারা দিয়ে তৈরি করা খাবার, সিব বা আপেল,"সেনজেদ" নামের একটি বিশেষ ফল,"সোমাগ" নামক বিশেষ মশলা, সির বা রসুন এবং সের্কে বা সিরকা। এসব সামগ্রী হল নব-জীবন,প্রবৃদ্ধি,ফলবান হওয়া,প্রাচুর্য,সৌন্দর্য,সুস্থতা,ভালবাসা,আনন্দ ও ধৈর্য প্রভৃতির প্রতীক। এ ছাড়াও নওরোজের এ দস্তরখানে পবিত্র কুরআন শরিফ, ডিম,আয়না,পানি,লাল রংয়ের ছোট মাছ ও ধাতব মুদ্রা রাখা হয়। এগুলোর প্রতীকী অর্থ রয়েছে। এইসব রীতি ও আচার প্রথা ইরানে ইসলামি বিপ্লব-পূর্বকাল থেকেই চলে এসেছে। এগুলো এখন ইরানের আবহমান সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।

না কেবল ইরানের বললে ঠিক হবে না। নওরোজ ইরানি,কুর্দি,তাজিক ও আজেরি জাতিসহ আরো কয়েকটি জাতির বৃহত্তম জাতীয় উৎসব। জাতিসংঘের সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো নওরোজ উৎসবকে ইতোমধ্যেই বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকার অন্তর্ভুক্ত করেছে। ইসলামি বিপ্লব বিজয়ের পর অবশ্য ইরানে নওরোজ উৎসবের রীতিতে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। ইসলামী আচার-অনুষ্ঠান যুক্ত হয় এ উৎসবের সাথে। ওই যে দোয়া, মাজার জিয়ারত করা, মেহমানদারি করা, বাবা-মায়, আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করা ইত্যাদি আনুষ্ঠানিকতা বিপ্লবের ইতিবাচক সংযোজন। বিয়ের অ্যাঙ্গেইজমেন্ট হয়েছে যাদের নওরোজের সপ্তাখানেক আগে তাদের পরিবারের মাঝে উপহার বিনিময়ের প্রচলন রয়েছে। সাধারণত ছেলের পরিবারের পক্ষ থেকে মেয়ের জন্য জামা-কাপড়,মিষ্টি,সোনার অলংকার ইত্যাদি পাঠানো হয় আর মেয়ের পরিবার ছেলের জন্য উপহারের পাশাপাশি নৈশভোজেরও ব্যবস্থা করে।

যারা পরিবার পরিজন থেকে দূরে অবস্থান করে তারা দূর থেকেই শুভেচ্ছা কার্ড পাঠিয়ে স্বজনদের স্মরণ করে। প্রযুক্তির কল্যাণে অবশ্য এখন আর কেউ এসব কার্ড পোস্ট করে না, ই-মেইল, এসএমএস, এমএমএসে পাঠানো হয় এখন। এর একটা সুবিধা মনের কথাগুলো অডিও ভিডিওর মাধ্যমেও পৌঁছানো যায় সহজেই। একটি মজার ব্যাপার উল্লেখ না করলেই নয়। সেটা হলো বছর বুঝে নেওয়া বা বছরকে বরণ করার আনুষ্ঠানিকতা। কুরআন পাঠ, ফালে হাফেজ পাঠের মধ্য দিয়ে শুরু করা হয় নওরোজ। কোথাও কোথাও সব্জি পোলাও মাছ খেয়ে সূচনা করে দিবসের। তারপর মুরব্বিদের সঙ্গে দেখা করতে যায়। নওরোজ শুরুর আগের বৃহস্পতিবার পরিবারের সদস্যরা তাদের মৃত সদস্যদের, পূর্বপুরুষদের কবর জিয়ারতে যায়।

ঈদে যেমন ছোটোদের সেলামি দেওয়া হয় তেমনি নওরোজেও ছোটোদের উপহার হিসেবে সেলামি দেওয়ার প্রচলন রয়েছে। সাদারণত এই সেলামির টাকা হাফত সিন টেবিলে রাখা কুরআনের পরতে পরতে রাখা হয় এবং বাচ্চাদের বলা হয় সেখান থেকে নিয়ে নিতে। এর কারণ হলো খোদায়ি বরকত ও পুণ্যের অধিকারী হওয়ার বাসনা। এভাবে ফার্সি বছরের প্রথম মাস ফারভারদিনের ১৩ তারিখ পর্যন্ত চলে নওরোজ উৎসব। মজার ব্যাপার হলো ১৩ তারিখে ইরানিরা কেউই ঘরে থাকে না। এই দিনটি ইরানে পালিত হয় প্রকৃতি দিবস হিসেবে। আগে এই দনটিকে বলা হতো "সিজদাহ বেদার"। সিজদাহ মানে ১৩ আর বেদার মানে হলো দ্বারমুখি কিংবা বনমুখিতা। অর্থাৎ এই ১৩ তম দিনে ঘর থেকে বেরিয়ে প্রকৃতির সান্নিধ্যে যাওয়া। এ কারণেই প্রকৃতি দিবসে ইরানিরা ঘরের বাইরে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ও মনোরম প্রাকৃতিক স্পটে সময় কাটান। বিশেষ করে উদ্যান,ঝর্ণা,পাহাড়,পার্ক-এসব স্থানে তারা চাদর বিছিয়ে বা তাবু খাটিয়ে খোশ-গল্প করে এবং মজাদার খাবার খেয়ে সময় কাটান।#

ট্যাগ