সূরা বাকারাহ; আয়াত ২২২-২২৭ (পর্ব ৫৭)
পবিত্র কুরআনের তাফসিরবিষয়ক অনুষ্ঠান 'কুরআনের আলো'র আজকের পর্বে সূরা আল-বাকারাহ'র ২২২ থেকে ২২৭ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। আল্লাহপাক সূরা বাকারাহ'র ২২২ ও ২২৩ নম্বর আয়াতে বলেছেন,
وَيَسْأَلُونَكَ عَنِ الْمَحِيضِ قُلْ هُوَ أَذًى فَاعْتَزِلُوا النِّسَاءَ فِي الْمَحِيضِ وَلَا تَقْرَبُوهُنَّ حَتَّى يَطْهُرْنَ فَإِذَا تَطَهَّرْنَ فَأْتُوهُنَّ مِنْ حَيْثُ أَمَرَكُمُ اللَّهُ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ التَّوَّابِينَ وَيُحِبُّ الْمُتَطَهِّرِينَ (222) نِسَاؤُكُمْ حَرْثٌ لَكُمْ فَأْتُوا حَرْثَكُمْ أَنَّى شِئْتُمْ وَقَدِّمُوا لِأَنْفُسِكُمْ وَاتَّقُوا اللَّهَ وَاعْلَمُوا أَنَّكُمْ مُلَاقُوهُ وَبَشِّرِ الْمُؤْمِنِينَ (223
"(হে পয়গম্বর!) আপনার কাছে রজঃস্রাব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। আপনি বলে দিন এটা অশুচি। কাজেই তোমরা রজঃস্রাবকালে স্ত্রীগমন থেকে বিরত থাকবে। সুতরাং যতদিন না তারা পবিত্র হয় ততদিন তাদের নিকট (সহবাসের জন্য) যাবে না। যখন তারা উত্তমরূপে পবিত্র হবে, তখন যেভাবে আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ দিয়েছেন সেভাবে তাদের কাছে গমন করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাওবাকারী এবং অপবিত্রতা থেকে যারা বেঁচে থাকে তাদেরকে পছন্দ করেন।" (২:২২২)
"তোমাদের স্ত্রীরা হলো তোমাদের জন্য শস্যক্ষেত্র। অতএব তোমরা তোমাদের শস্য-ক্ষেত্রে যেভাবে ইচ্ছা গমন কর। আর নিজেদের জন্য আগামী দিনের ব্যবস্থা কর এবং আল্লাহকে ভয় করতে থাক। আর নিশ্চিতভাবে জেনে রাখ যে,আল্লাহর সাথে তোমাদেরকে সাক্ষাত করতেই হবে। আর যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে সুসংবাদ জানিয়ে দাও।" (২:২২৩)
বিয়ের অন্যতম লক্ষ্য হলো- সন্তানের অধিকারী হওয়া এবং বংশ টিকিয়ে রাখা। আর এক্ষেত্রে নারী ও পুরুষ উভয়েরই ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু আল্লাহ তা'লা সন্তান প্রতিপালনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সন্তান জন্মের আগেই মায়ের ওপর অর্পণ করেছেন। পবিত্র কোরআন এক্ষেত্রে সুন্দর ও উপযুক্ত উপমা ব্যবহার করে স্ত্রীকে শস্য-ক্ষেত্রের সঙ্গে তুলনা করেছে। পুরুষের ঔরস থেকে মায়ের গর্ভে নয় মাস ধরে সন্তানের বীজ প্রতিপালিত হবার পর সন্তান মাটি থেকে চারাগাছের মত বেরিয়ে এসে মানব-সমাজের গুলবাগিচায় স্থান করে নেয়। কিন্তু বীজ গ্রহণ ও প্রতিপালনের জন্য শস্যক্ষেতের প্রস্তুতি থাকা দরকার। মহিলাদের মাসিক বা ঋতুকাল হলো এই প্রস্তুতির সময়, তাই আল্লাহ মাসের কতগুলো নির্দিষ্ট দিনে স্ত্রীগমন নিষিদ্ধ করেছেন,এ সময়টা স্ত্রীদের মন ও শরীরের জন্য ক্ষতিকর এবং এ সময়ে তারা গর্ভবতী হবার জন্য প্রস্তুত থাকে না। তাই সৎ ও পবিত্র সন্তান তথা সমাজের গুলবাগিচায় সুগন্ধীফুল দানের চিন্তা করা উচিত। একই সঙ্গে এটাও জেনে রাখা দরকার যে, সন্তানের বাবা-মা হিসেবে নিজেদের দায়িত্ব সম্পর্কে কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে।
এই দুই আয়াত থেকে আমরা যেসব শিক্ষা নিতে পারি তার সারমর্ম হলো-
এক. ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ ধর্ম। মানুষের সমস্ত চাহিদা ও প্রশ্নের উত্তর এতে রয়েছে। যেমন পরিবার গঠন ও সন্তানের অধিকারী হবার বিষয়েও এই ধর্ম মানুষের জিজ্ঞাসা ও চাহিদার উপযুক্ত উত্তর ও সমাধান দেয়।
দুই. ইসলাম ধর্মের বিধান সৃষ্টিজগতের শৃঙ্খলার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাই যেসব কাজ নিজের বা অন্যের জন্য ক্ষতিকর, ইসলাম সে সবের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব মানুষের সুস্থতা নিশ্চিত করাই এসব নিষেধাজ্ঞার উদ্দেশ্য।
তিন. মানুষের প্রবৃত্তিকে অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে এবং পরিবারের সুস্থতা বজায় রেখে ভোগ ও আরাম আয়েশ করতে হবে।
চার- ইসলামের দৃষ্টিতে স্ত্রী হলো বাগানের সমতুল্য, যা কিনা তার স্বামীকে প্রশান্তি দেয় এবং একই সঙ্গে স্ত্রী হলো পবিত্র সন্তান প্রতিপালনে দায়িত্বশীল।
এরপর ২২৪ ও ২২৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَلَا تَجْعَلُوا اللَّهَ عُرْضَةً لِأَيْمَانِكُمْ أَنْ تَبَرُّوا وَتَتَّقُوا وَتُصْلِحُوا بَيْنَ النَّاسِ وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ (224) لَا يُؤَاخِذُكُمُ اللَّهُ بِاللَّغْوِ فِي أَيْمَانِكُمْ وَلَكِنْ يُؤَاخِذُكُمْ بِمَا كَسَبَتْ قُلُوبُكُمْ وَاللَّهُ غَفُورٌ حَلِيمٌ (225)
"(হে বিশ্বাসীগণ!) নিজেদের শপথের জন্য আল্লাহকে অজুহাত করো না। যেই শপথের উদ্দেশ্য হলো-সৎকাজ, আত্মসংযম বা খোদাভীতি ও মানুষের মাঝে মীমাংসা করে দেয়া থেকে বিরত থাকা। আল্লাহ সবকিছু জানেন ও শোনেন।" (২:২২৪)
"অবশ্য তোমাদের অর্থহীন শপথের জন্য আল্লাহ তোমাদের দায়ী করবেন না। কিন্তু তোমাদের মনের সংকল্পের জন্য আল্লাহ তোমাদেরকে দায়ী করবেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল ও সহিষ্ণু। " (২:২২৫)
বিভিন্ন তাফসির গ্রন্থে এসেছে- রাসুলে করিম (সা.)'র কোন এক সাহাবীর কন্যা ও জামাতার মধ্যে মতভেদ দেখা দিলে জামাতা তাদের সংশোধনের জন্য কিছুই করবেন না বলে শপথ নেন। তখন এ আয়াত নাজিল হয় এবং এতে বলা হয় মানুষের সংশোধনের জন্য দায়িত্ব এড়িয়ে যেও না এবং অর্থহীন শপথের জন্য নিজেকে সৎ কাজ থেকে বিরত করোনা। আসলে এ ধরনের শপথের কোন মূল্য নেই এবং আল্লাহ এইসব শপথ ভঙ্গের জন্য তাদেরকে ধরবেন না। অমনযোগীতা, উদাসীনতা ও চিন্তাভাবনা করা ছাড়া অনিচ্ছাকৃতভাবে যেসব শপথ নেয়া হয় সেসব শপথ ভঙ্গের জন্য আল্লাহ কোন শাস্তি না দিয়ে তাদেরকে ক্ষমা করবেন।
এই দুই আয়াতের শিক্ষা হলো -
প্রথমত : সৎকাজের বাধা সৃষ্টির জন্য শপথ করা যাবে না। আল্লাহর পবিত্র নামকে সম্মান করতে হবে এবং আল্লাহর নামকে মূল্যহীন বা অনর্থক কাজের জন্য ব্যবহার করা যাবে না।
দ্বিতীয়ত: মানুষ রাগের মাথায় অসাবধানতাবশত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে কোন অপছন্দনীয় কথা বললে আমরা যেন তার প্রতিশোধ না নিয়ে আল্লাহর মতোই ক্ষমা করে দেই।
সূরা বাকারাহ'র ২২৬ ও ২২৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহপাক বলেছেন-
لِلَّذِينَ يُؤْلُونَ مِنْ نِسَائِهِمْ تَرَبُّصُ أَرْبَعَةِ أَشْهُرٍ فَإِنْ فَاءُوا فَإِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ (226) وَإِنْ عَزَمُوا الطَّلَاقَ فَإِنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٌ (227)
"যারা নিজ স্ত্রীকে কষ্ট দেয়ার জন্য তাদের থেকে দূরে থাকার শপথ নেয়, তাদেরকে চারমাস অপেক্ষা করতে হবে। এরপর যদি তারা শপথ থেকে ফিরে আসে বা পরস্পর মিলমিশ করে নেয়, তবে আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়ালু।" (২:২২৬)
"আর যদি তারা তালাক দেয়ারই সংকল্প করে, তবে আল্লাহ শ্রবণকারী-মহাজ্ঞানী।" (২:২২৭)
ইসলাম পূর্বযুগে আরবদের মধ্যে একটি নোংরা প্রথা চালু ছিল। প্রথাটি হলো- অনেক স্বামী তাদের স্ত্রীদেরকে শারীরিক ও মানুষিক চাপের মধ্যে রাখার জন্য তাদের কাজ থেকে দূরে থাকার শপথ নিত। এ ধরনের লোকেরা তাদের স্ত্রীদেরকে তালাকও দিত না আবার তাদের সাথে বসবাস না করে তাদেরকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ঝুলিয়ে রাখত। ইসলাম এই অপছন্দনীয় প্রথার বিরুদ্ধে সতর্ক করে বলেছে,যারা এরকম শপথ করে, তাদেরকে চারমাসের মধ্যেই স্ত্রীর ব্যাপারে স্পষ্ট সিদ্ধান্ত নিতে হবে অথবা শপথ প্রত্যাহার করে নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মত জীবন-যাপন করতে হবে। যদি তাদের মধ্যে বনিবনা হওয়ার সুযোগ না থাকে,তবে আনুষ্ঠানিকভাবে তালাক দিতে হবে। #