অক্টোবর ১০, ২০১৮ ১৬:৩০ Asia/Dhaka
  • দেখব ঘুরে ইরান এবার: ইরানের ঐতিহাসিক প্রদেশ ইয়াযদ (দুই)

ইরানের ঐতিহাসিক প্রদেশ ইয়াযদ নিয়ে কথা বলছিলাম আমরা। বিশ্ব পর্যটকরা এই শহরে প্রায়ই বেড়াতে আসে। ইয়াযদের মসজিদে কাবির, ফাহরাজ জামে মসজিদ, সাইয়্যেদ রোকনুদ্দিনের সমাধি, দৌলতাবাদ বাগিচা, আমিরে চাখমখ মসজিদ, অগ্নিমন্দির, টাওয়ার ইত্যাদি।

ইয়াযদ প্রদেশের ইরানের কেন্দ্রীয় মরু এলাকায় অবস্থিত হবার কারণে এখানে পানির উৎস যথেষ্ট নয়, খুবই সীমিত। পানির প্রয়োজনীয়তা মাটির তলদেশ থেকে নলকূপের সাহায্যে তুলে নিয়ে মেটাতে হয়। মাটির নীচের পানিই এখানকার পানির প্রধান উৎস। শুনে আশ্চর্য হবেন যে এই প্রদেশের মরুবাসীরা নিজেদের শ্রম ও শক্তি দিয়ে হাজার হাজার খাল কেটেছে মাটির নীচের পানি ব্যবহার করার জন্য। পানির সন্ধানে খননকৃত এইসব খাল একদিকে যেমন আগেকার যুগের মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রমসাধ্য বৈশিষ্ট্যের কথা তুলে ধরে অপরদিকে এগুলো এখন স্মৃতি হিসেবে মূল্যবান ইতিহাসকেও প্রামাণ্য করে তোলে। সেখানে এখনও ৩ হাজার ১৩১ টি খালের মধ্যে ২ হাজার ৬১৫টি খাল ব্যবহার হচ্ছে।

 

খাল খনন করা ইরানিদের গুরুত্বপূর্ণ একটি আবিষ্কার। এই খাল খননের বিষয়টি সমগ্র মানব জাতির জন্যই জটিলতম, ঐতিহাসিক এবং বিস্ময়কর একটি ঘটনা। মানুষের জীবন যাপনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয়তাগুলোর অন্যতম একটি উপাদান হলো পানি। এই পানির উৎস সন্ধান করে যেসব এলাকায় পানি কম সেসব এলাকায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য খাল খনন সত্যিই যুগান্তকারী একটি ব্যাপার। মরু এলাকায় যেখানে পানি নেই কিংবা কৃষিকাজ করার প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহের এই উপায় কয়েক হাজার বছর ধরে মানব সমাজে এক বিস্ময়কর আবিষ্কার হিসেবে পরিগণিত ছিল। বিশেষ করে মরু অঞ্চলে এই খাল খননের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। পানি পৌঁছে দেওয়ার কৌশলও ছিল চমৎকার। খালের শুরুতে বিরাট একটি কূপ খনন করে পানি জমানো হত। সেখান থেকে কিছুদূর পরপর আরো কূপ খনন করে যতদূরে প্রয়োজন নিয়ে যাওয়া হত। প্রথম কূপকে বলা হত মাতৃকূপ আর খালের শেষ কূপকে বলা হত মাজহার বা প্রকাশ কূপ।

 

খালের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল সূর্যের আলোর উত্তাপে শুষ্ক কিংবা অর্ধশুষ্ক মরু এলাকায় পানির বাষ্পীভূত হয়ে উড়ে যাওয়া রোধ করা। উল্লেখ করার মতো বিষয়টি হলো পানি সরবরাহ করার এই সহজ পদ্ধতি কয়েক হাজার বছর আগে যেমন ছিল আজ পর্যন্ত তেমনি আছে, কোনো পরিবর্তন হয় নি। ইয়াযদ প্রদেশ অসংখ্য খালের জন্য যেমন তেমনি ইরানের দীর্ঘতম খালের জন্য বিখ্যাত। দীর্ঘতম খালটির নাম ‘যর্চ্’। কেবল দীর্ঘতম নয় ইরানের প্রাচীনতম খাল হিসেবেও পরিগণিত। অন্তত তিন হাজার বছর আগের খাল এটি। যর্চ খালের দৈর্ঘ্য এক শ’ কিলোমিটারের মতো। এই খালটির মাঝে খননকৃত কূপের সংখ্যা ২ হাজার ১১৫ টি।

 

ইয়াযদ শহর ইয়াযদ প্রদেশের কেন্দ্রীয় শহর। রোদে পোড়া ইটের তৈরি শহরের মধ্যে বিশ্বের দ্বিতীয় ঐতিহাসিক শহর এই যর্চ। ইতালির ভ্যানিস শহরের পরই যর্চের স্থান। যর্চ শহর এখন পর্যন্ত তার অস্তিত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। পর্যটন আকর্ষণীয় সকল বৈশিষ্ট্য এখনও রয়েছে শহরটির। এ কারণেই হয়তো ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে ইরানের জাতীয় ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় ইয়াযদ শহরটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। হবে নাই বা কেন, এখানে রয়েছে ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বহু নিদর্শন। যে কোনো একটি নিদর্শনই বিশ্ব ও ইরানের ইতিহাস ঐতিহ্যপ্রেমী দর্শককে অসাধারণভাবে আকৃষ্ট করবে। ইয়াযদ শহর বেশ কটি নামে পরিচিত। এই শহরকে বলা হয় বায়ু সঞ্চালন দণ্ডের শহর, ধর্মীয় শহর, ইবাদতের শহর, মিষ্টির শহর, খালের শহর, রোদ এবং আগুনের শহর ইত্যাদি।

ইয়াযদের প্রাচীন স্থাপত্যের সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার শুরুতেই যাওয়া যাক এখানকার পুরনো ঘরগুলোর দিকে। ইয়াযদের প্রাচীন ঘরগুলোর বৈশিষ্ট্য হলো উঁচু উঁচু দেয়াল আর মাঝখানে উঠোন রেখে চারদিকে রুম। উঠোনের ঠিক মাঝখানে পানির হাউজ। প্রতিটি বাড়ির নীচে রয়েছে আন্ডারগ্রাউন্ড রুম যাকে আধুনিক পরিভাষায় বেইজমেন্ট বলা হয়। গরমের সময় এই বেইজমেন্টে সবাই বিশ্রাম নেয়। ঘরের দরোজা জানালাগুলো অসংখ্য ঘুলঘুলিযুক্ত। রুমের ভেতরে আয়নার কারুকাজ আর দেয়াল এবং ছাদগুলোতে চকের বিভিন্ন ডিজাইনের চমৎকার প্লাস্টারিং। এসবই প্রাচীন ইয়াযদের ঐতিহ্যবাহী ঘরবাড়ির বৈশিষ্ট্য। এগুলো এখনও দেখতে পাওয়া যাবে ইয়াযদে। লরি’দের ঘর কিংবা মুয়াইয়েদ আলায়ির ঘরের কথা উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে।

 ইয়াযদের প্রাচীন ঘরগুলোতে আরেকটি জিনিস চোখে পড়ার মতো। তাহলো বায়ু সঞ্চালনের অদ্ভুত সিস্টেম। মরু অঞ্চল এবং শুষ্ক আবহাওয়ার জন্যে উপযুক্ত করে এই সিস্টেমটিকে দক্ষতার সাথে গড়ে তোলা হয়েছে। বায়ু সঞ্চালন প্রক্রিয়া মানে হলো ঘরের ভেতরে বাতাস ঢোকানো এবং তা বেরিয়ে যাবার ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থা কেবল যে ঘরকে ঠাণ্ডা করে তাই না বরং ঘরের সৌন্দর্যও বাড়িয়ে দেয়। মিনারের মতো করে আট কোণাকৃতির একটি সরু স্থাপনা ঘরের ছাদ থেকে উপরের দিকে উঠে গেছে। মিনারের শেষ মাথার চারদিকই খোলা। গরম বাতাস এই টাওয়ারের ভেতরে ঢুকে ঠাণ্ডা বাতাসে পরিবর্তিত হয়ে ঘরের ভেতর যায়। ঠাণ্ডা পানিকেও এ ক্ষেত্রে কাজে লাগানো হয়। আবার কাঠের তৈরি চার কোণা একটি পাইপের মাধ্যমে সেই বাতাস বেইজমেন্টেও প্রবাহিত করা হয়।

 বিশ্বের সবচেয়ে বড় বায়ু সঞ্চালন টাওয়ার এই ইয়াযদে অবস্থিত। এই টাওয়ারটি হলো ইয়াযদের বাগে দৌলাতাবাদের বায়ু সঞ্চালন টাওয়ার। যান্দিয়া এবং কাজারি শাসনামলের সবচেয়ে সুন্দর বায়ু সঞ্চালন টাওয়ারটি ২৭০ বছর আগে নির্মাণ করা হয়েছে। এই টাওয়ারটি যেমন দেখতে সুন্দর তেমনি উচ্চতার দিক থেকেও বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বড়। উচ্চতা প্রায় ৩৪ মিটারের মতো। আট কোণাকৃতি হবার ফলে সবদিকের বাতাসই ধারণ করতে পারে সহজেই। টাওয়ার ভেতর দিয়ে আসা বাতাস সোজা চলে যায় ঘরের নীচে পানির হাউজে। ঠাণ্ডা পানির হাউজে বাতাস ঢুকে ঠাণ্ডা হয়ে যায় এবং সেই বাতাসই ছড়িয়ে পড়ে সবখানে।

 বায়ু সঞ্চালন টাওয়ারের পাশেই রয়েছে একটি বাগিচা। ‘বেহেশতে অয়িন’ নামে পরিচিত এই বাগিচাটি। এখানে বহুকাল বাস করেছিলেন যান্দিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা কারিম খান যান্দ। বাগিচাটিকে এতো সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছে যে কাজারি এবং যান্দিয়া শাসনামলের সবচেয়ে সুন্দর বাগান হিসেবে এটিকে মনে করা হয়।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/  ১০

খবরসহ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব লেখা ফেসবুকে পেতে এখানে ক্লিক করুন এবং নোটিফিকেশনের জন্য লাইক দিন

ট্যাগ