আগস্ট ১২, ২০১৮ ১৯:২৩ Asia/Dhaka
  • দেখব ঘুরে ইরান এবার: গোরগান শহরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য

গোরগানের আয়তন ১৬১৫ বর্গ কিলোমিটার। তুর্কমেনিস্তান সীমান্তের কাছেই অবস্থিত এই শহরটি। গোরগানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিচিত্র।

একদিকে যেমন পাহাড় পর্বত রয়েছে, তেমনি রয়েছে বন বনানী আর সবুজ জঙ্গল, রয়েছে সবুজ ঘাসে ভরা বিস্তীর্ণ সমতল ভূমি। অপরদিকে দিগন্ত বিস্তৃত খোলা প্রান্তর, মরুভূমি, আবার সমুদ্র, উপসাগর আর নদী পুকুরও রয়েছে প্রচুর। সবকিছুর বাইরে কৃষিকাজের জন্যে ব্যাপক কৃষিজমি তো রয়েছেই। গোরগান শহর এই উপশহরের কেন্দ্রিয় শহর এবং গোলেস্তান প্রদেশেরও মূলকেন্দ্র। ইরানের উত্তরাঞ্চলের শহরগুলোর একটি হলো এই গোরগান। গোরগানের আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ। গ্রীষ্মকালে এই প্রদেশের আবহাওয়া ক্রমশ আর্দ্র এবং উষ্ণ হয়ে ওঠে।

গোরগান শহরের লোকজন ফার্সি ভাষায় কথা বলে। তবে আস্তারাবাদি এলাকার চমৎকার ভাষাভঙ্গিতে কথা বলে তারা। এখানকার জনগণের মাঝে বেশ বৈচিত্র্য রয়েছে। কেউ স্থানীয়, কেউবা ফার্স, অনেকেই আবার তুর্কমেনীয়। বালুচ, কাযযাখ, সিস্তানী, দেইলামি, মযান্দারনী, সাবজেভরি, কশ্মারি, শাহরুদি এবং বাস্তমীওদের বসবাস রয়েছে এই এলাকায়। সবাই মিলেমিশে সুন্দরভাবে সহাবস্থান করছে এখানে। গোরগান এলাকাটি আগে ভিন্ন নামে পরিচিত ছিল। এলাকাটির প্রাচীন নাম ছিল আস্তারাবাদ কিংবা আস্তারেহ আবাদ। খ্রিষ্টীয় ১৯৩৭ সাল থেকে এই আস্তারাবাদ ‘গোরগান’ নামে পরিচিতি পায় এবং এই নামটিই এখন সবার কাছে পরিচিত।

তবে গোরগানকে পাহলাভি ভাষায় ভারকন অথবা ভারকনে উচ্চারণ করা হয়। গ্রিক ভাষায় গোরগানকে বলা হয় হিরকন বা হিরকানিয়া। আবার আরবি ভাষায় বলা হতো জোরজান। এই এলাকাটির এতো পরিচিতির একটা প্রধান কারণ হলো পুরাতত্ত্ববিদদের গবেষণা। পুরাতাত্ত্বিকদের দৃষ্টিতে গবেষণার জন্যে কিংবা খনন কাজের জন্যে এই এলাকাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত। প্রাপ্ত তথ্য প্রমাণ অনুযায়ী গোরগান এলাকার ইতিহাস যথেষ্ট সমৃদ্ধ এবং প্রাচীন নিদর্শনের দিক থেকে খুবই মূল্যবান।

এখানে পাওয়া গেছে ৬ হাজার বছর আগের প্রাচীন মৃৎশিল্পের নমুনা। গোরগানের বিভিন্ন স্থানে পাওয়া গেছে এসব নিদর্শন। এমনকি গোরগানের তুরাঙ নামক টিলাতেও এ ধরনের নিদর্শন পাওয়া গেছে। এইসব নিদর্শন থেকে যেটা প্রমাণিত হয় সেটা হলো কতো প্রাচীনকাল থেকে এখানে মানব বসতি গড়ে উঠেছে, সেইসাথে গড়ে উঠেছিল মানব সভ্যতাও। এসব দিক থেকে গোরগানের সমৃদ্ধ সভ্যতার বিষয়টি প্রমাণ হয়ে যায়।

খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকে গোরগান এলাকাটি ছিল একটি স্বাধীন ভূখণ্ড। রোমান সম্রাটের দরবারে রাষ্ট্রদূতও ছিল। আলেযিয়রের শাসনামলে এই শহরটি ছিল হুকুমতের মূল কেন্দ্র। তবে মোঙ্গলদের এবং তৈমুরীয়দের পাশবিক হামলার কারণে প্রাচীন গোরগান শহরটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় এবং এখানকার লোকজন পার্বত্য পাদদেশীয় জঙ্গলে অবস্থিত আস্তারাবাদ শহরে চলে যায়। এই আস্তারাবাদের আবহাওয়া ছিল খুবই উপভোগ্য আর এখানকার মাটি ছিল বেশ উর্বর। আস্তারাবাদ হয়ে ব্যবসায়ীরা যাওয়া আসা করতো। এসব কারণে খুব দ্রুত আস্তারাবাদের উন্নয়ন ঘটে। শহরটির আয়তনও খুব দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং পরবর্তীকালে আস্তারাবাদের নাম পরিবর্তিত হয়ে গিয়ে ‘গোরগান’ নাম ধারণ করে। সাফাভি শাসনামলে এই শহরকে বলা হত দারুল মুমেনিন। অনেক আলেম ওলামা এবং জ্ঞানী গুণীর বসবাস যেমন ছিল এই শহরে তেমনি আনাগোনাও ছিল প্রচুর। সেজন্যেই হয়তো এরকম নামকরণ।                               

ইসলাম প্রবেশের মধ্য দিয়ে বিশেষ করে প্রথম শতকগুলোতে তাবারেস্তান প্রদেশটির মর্যাদাই ছিল অন্যরকম। এর কারণ হলো ইসলামী সভ্যতা এবং সংস্কৃতির ব্যাপক বিকাশ ঘটেছিল এই এলাকায়। এই প্রদেশের জোরজান শহর এবং তারপর আস্তারাবাদ শহর ছিল সেই সময়কার বড়ো বড়ো মনীষীদের জন্মস্থান এবং লালন পালন কেন্দ্র। বিখ্যাত ‘কাবুসনামা’ নামক গ্রন্থের লেখক এবং আলে যিয়রের সর্বশেষ আমির আনসারুল মায়ালি কেইকাবুস এবং আব্দুল কাহের জোরজানি-যিনি ব্যাকরণ তথা নাহু-সরফের মূল্যবান সংকলক ছিলেন-ফার্সি সাহিত্য এবং আরবি সাহিত্যের ক্ষেত্রে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে গেছেন। স্বয়ং কাবুসনামাই হলো মোঙ্গল পূর্ববর্তী ইসলামী সভ্যতার একটা মূল্যবান সংকলন।

চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও এই এলাকার গুণীজনেরা যথেষ্ট অবদান রেখে গেছেন। মুসলিম বিশ্বের বিশেষ করে ইরান এবং ইসলামী দুনিয়ার বিখ্যাত দুজন চিকিৎসা বিজ্ঞানী এরকমই অবদান রেখেছেন বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে। এঁরা হলেন আবু সাহ্‌ল মাসিহি এবং অপরজন সাইয়্যেদ ইসমায়িল জোরজানী। বিখ্যাত দার্শনিক মিরদামাদ এবং মির ফেন্দেরেস্কি  দুজনই মুসলিম বিশ্বের জন্যে বিশেষ গর্বের। আর এই দুই দার্শনিকই এই গোরগানেরই কৃতী সন্তান ছিলেন।

আগেকার দিনে গোরগান শহরের পাঁচটি প্রবেশদ্বার ছিল। শহর ঘিরে ছিল অনেক টাওয়ার। একটি প্রতিরক্ষা প্রাচীরও ছিল শহরের উত্তর দিকটায়। এই প্রাচীরের নাম ছিল এস্কান্দার প্রাচীর। সাসানীয় যুগে এই প্রাচীরটি নির্মাণ করা হয়েছিল। এখনো এই প্রাচীরটির ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাওয়া যায়। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিশেষজ্ঞগণ প্রাচীর পথে যেসব টিলা ছিল সেগুলোর ধ্বংসাবশেষ পর্যালোচনা করে বলেছেন ঐ প্রাচীরের সুরক্ষা এবং শহরের সুরক্ষার লক্ষ্যে এখানে অনেক কেল্লাও গড়ে তোলা হয়েছিল। প্রাচীরটির দৈর্ঘ্য ছিল ২০০ কিলোমিটার। ইরানের সবচেয়ে দীর্ঘ প্রাচীর এটি। আর বিশ্বের ঐতিহাসিক প্রাচীরগুলোর মধ্যে তৃতীয় স্থানে অবস্থান করছে এই প্রাচীর। বিশ্বের বাকি দুটি নামকরা প্রাচীর হলো চীনের প্রাচীর এবং জার্মান প্রাচীর। ঐতিহাসিক অনেক লেখায় এই প্রাচীরটিকে এস্কান্দার বাঁধ, আনুশিরভন বাঁধ, লাল সাপ ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়েছে।

গোরগানের আরো কিছু ঐতিহাসিক স্থাপনার কথা বলা যাক। একটি হলো গোরগান জামে মসজিদ। সেলজুকি শাসনামলে এর মসজিদটির মূল ভিত্তি গড়ে উঠেছিল। এখন এই প্রাচীন মসজিদটির শুধুমাত্র মিনার, মিম্বার আর কুফি অক্ষরে লেখা কিছু লিপিকর্মই অবশিষ্ট রয়েছে। মিনারটি এখনো সেই ইটেরই গড়া। গোরগান মিউজিয়ামের বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য অনুযায়ী এই মিম্বারটি সমগ্র পৃথিবীর চারটি অনন্য সাধারণ মিম্বারের মধ্যে একটি।

এখানকার আরেকটি প্রাচীন নিদর্শন হলো এমাদিয়া মাদ্রাসা। আরো আছে ‘নালবান্দন’ বাজার। রয়েছে দর্শনীয় আরেকটি স্থাপনা ‘গোরগান মিউজিয়াম’। প্রাকৃতিক নিদর্শনের মধ্যে গোলেস্তান ন্যাশনাল পার্করে কথা না বললেই নয়।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/১২

খবরসহ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব লেখা ফেসবুকে পেতে এখানে ক্লিক করুন এবং নোটিফিকেশনের জন্য লাইক দিন