দেখব ঘুরে ইরান এবার: গোরগান শহরের তুর্কামান বন্দর
বন্দর তুর্কামান শহরটি গোলেস্তান প্রদেশের উত্তর-পশ্চিম অংশে অবস্থিত। বন্দর তুর্কামানের উত্তরে রয়েছে ইরানের প্রতিবেশী দেশ তুর্কমেনিস্তান। দক্ষিণ দিকে রয়েছে ‘কোর্দকুই ও গোরগান’ শহর, পূর্বদিকে রয়েছে ‘অগগালো’ শহর আর পশ্চিম দিকে রয়েছে কাস্পিয়ান সাগর এবং গোরগান উপসাগর।
তুর্কামান শহরের আয়তন দেড় হাজার বর্গ কিলোমিটারের উপরে। শহরের প্রধান কেন্দ্র হলো গোমিশান। আর তিনটি প্রধান শহর হলো বান্দার তুর্কামান, গোমিশ তাফপে এবং সিমিন শাহর। এই শহরের শতকরা নব্বুই ভাগ জনসংখ্যাই হলো তুর্কামানীরা। শহরটি খানিকটা উঁচু তবে বিশ্বের স্বাধীন পানিস্তর থেকে নীচু। তুর্কামান বন্দর নগরীর আবহাওয়া এখানকার উত্তরাঞ্চলে খানিকটা মরু আঞ্চলিক আর দক্ষিণ অঞ্চলের আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ। এ কারণে এ এলাকায় জনগণের আনাগোনা সবসময়ই তুলনামূলকভাবে বেশি।
তুর্কামান বন্দর নগরীটি ইরানের রাজধানী শহর তেহরান থেকে ৩৭৫ কিলোমিটার উত্তর পূর্বদিকে এবং গোলেস্তান প্রদেশের কেন্দ্রীয় শহর গোরগান থেকে ২৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। তুর্কামান শহরটি ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে গড়ে উঠেছিল। তুর্কামান উপজাতিরাই বেশিরভাগ বসতি গড়ে তুলেছিল এখানে। প্রথমদিকে এই শহরটি ছিল সেনানিবাসের মতো। ধীরে ধীরে এই শহরটিতে বন্দর সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কর্মকাণ্ড শুরু হয়। যেমন মালামাল উঠানামার জন্যে জেটি স্থাপন করা হয় এখানে। বাণিজ্যিক দিকটিকে সামনে রেখে যোগাযোগ ব্যবস্থাও গড়ে ওঠে চমৎকারভাবে। সেইসাথে সরকারী বেসরকারী বিভিন্ন অফিস আদালতও গড়ে উঠেছে। এসব কারণে শহরটির উন্নয়ন খুব দ্রুততার সাথে অগ্রগতি লাভ করে। তুর্কামান বন্দরে ইদানীং মাছ শিকারের ব্যাপক আয়োজন লক্ষ্য করা যায়। অশুরদেহ দ্বীপটি এই মাছ শিকারের জন্যে ব্যাপক খ্যাতি লাভ করেছে।

তুর্কামান বন্দর নগরীর দশ কিলোমিটার দক্ষিণ দিকে রয়েছে পাহাড় আর বন-জঙ্গল। তুর্কমেনিস্তানের কাছেই সমুদ্র উপকূলে পড়েছে এলাকাটি। তো একদিকে এই চমৎকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অপরদিকে অশুরদেহ দ্বীপ এবং ঐতিহাসিক জেটি-সব মিলিয়ে ভ্রমণরসিকদের জন্যে অপূর্ব এক আকর্ষণ সৃষ্টি করেছে তুর্কামান নগরী। এই যে জঙ্গলের শ্যামলিমার কথা বললাম, এই শ্যামল সবুজ এলাকা জুড়ে রয়েছে অসংখ্য গ্রাম। সমগ্র গোলেস্তান প্রদেশই শুধু নয় বরং বলা যায় ইরানের উত্তরাঞ্চলের মধ্যে এখানকার গ্রামগুলোর আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। এইসব গ্রাম ভ্রমণ করে তাদের কৃষ্টি কালচার, রীতি-রেওয়াজ, আচার প্রথাগুলো দেখলে ভালো না লেগে পারবে না।
তাছাড়া এখানকার গ্রামবাসীরা এতো উদার এবং অতিথি পরায়ণ যে তাদের সাথে একবার মিশলে আপনার ছুটে আসতে কষ্ট হবে। তারা এতো সদয় এবং প্রাণবন্ত, এতো হৃদয়গ্রাহী তাদের ব্যবহার যে যিনিই এখানে বেড়াতে আসবেন অবকাশ যাপনের জন্যেই হোক কিংবা দেখার জন্যেই হোক আপনি জীবনে কোনোদিন এখানকার স্মৃতি ভুলতে পারবেন না। ঐ যে অশুরদেহ গ্রামের কথা বললাম, এই গ্রামটিও এখান দর্শনীয় একটি নিদর্শন। এই গ্রামটি কেন্দ্রীয় প্রাদেশিক শহর গোরগান থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরে পড়েছে।
অশুরদেহ দ্বীপটিও কাস্পিয়ান সাগরের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় মিয়নকলেহ উপদ্বীপের একেবারে পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত। এর আয়তন ১২০০ হেক্টরের মতো। অশুরদেহ দ্বীপের উত্তরে কাস্পিয়ান সাগর, দক্ষিণে গোরগান উপসাগর। এই দ্বীপের আবহাওয়া ইরানের উত্তরাঞ্চলের আবহাওয়ার মতোই শীতকালে নাতিশীতোষ্ণ আর গ্রীষ্মে গরম এবং নাতিশীতোষ্ণ তবে আর্দ্রতার মাত্রা থাকে প্রচুর।
অশুরদেহ দ্বীপের ইতিহাসের দিকে তাকালে সহজেই বুঝতে পারা যাবে এই দ্বীপটি আগেকার দিনে বাণিজ্যিক লেনদেনসহ অর্থনৈতিক বিভিন্ন কার্যক্রমের প্রাণকেন্দ্র ছিল। দ্বীপটির সংবেদনশীল অবস্থানের কারণে এটি সবসময়ই ব্রিটেন এবং রুশ উপনিবেশবাদীদের প্রতিযোগিতামূলক সংঘাতের শিকার ছিল। ১৮৩৬ খ্রিষ্টাব্দে দ্বীপটি রুশদের দখলে যায়। তখন রাশিয়া ছিল জারদের নিয়ন্ত্রণে। এই জারিজমের পতনের পর অবশ্য অশুরদেহ দ্বীপটি ইরানকে ফেরত দেওয়া হয়। এ সময় অর্থাৎ ১৯২১ সালে বিখ্যাত একটি চুক্তি হয়েছিল ইরান এবং রাশিয়ার মধ্যে। আরেকটি কারণেও এই দ্বীপটি ঐতিহাসিকভাবে খ্যাত তাহলে ইতিহাসবিদগণ মনে করেন এই দ্বীপটিতেই সুলতান মুহাম্মদ খাওয়ারেযমশাহ মারা গিয়েছিলেন।

গোলেস্তান প্রদেশের দেখার মতো স্থানগুলোর একটি এই অশুরদেহ দ্বীপ। স্বাভাবিকভাবেই ভ্রমণপিপাসুদের কাছে দ্বীপটি বেশ আকর্ষণীয়। দ্বীপের ভেতরে রয়েছে অসংখ্য প্রজাতির জীব জন্তুর নিরাপদ বসবাস। মাছ শিকারের জন্যেও দ্বীপটির নামডাক রয়েছে। আর মাছ শিকারের ফলে দ্বীপটি ‘ক্যাভিয়ার’ অর্থাৎ মাছের ডিম উৎপাদনেরও একটি প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। মাছের ডিম তথা ক্যাভিয়ার ব্যাপক পরিমাণে রপ্তানী হয় দেশের বাইরে। সে কারণেই রপ্তানী বাণিজ্যের জন্যেও বিশেষ একটি অঞ্চল এই অশুরদেহ দ্বীপ।
দ্বীপ থেকে সাগরে বেড়ানোর জন্যে রয়েছে বিচিত্র এবং নিরাপদ আয়োজন। যেমন এখানে রয়েছে সী-বাস, রয়েছে স্পিড-বোট। রয়েছে খাবার দাবারের জন্যে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এবং আকর্ষণীয় বহু রেস্টুরেন্ট। বলার অপেক্ষা রাখে না যে এইসব রেস্টুরেন্টে বিশেষ খাবারের পাশাপাশি মাছ এবং ক্যাভিয়ার সহজেই মেলে। এইসব বিচিত্র আকর্ষণের কারণেই সারাবছর জুড়েই অশুরদেহ দ্বীপে পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকে। গোলেস্তান প্রদেশের এই বন্দর নগরী তুর্কামান শহরে রয়েছে দোশাম্বে বাজার। দোশাম্বে শব্দের অর্থ হলো সোমবার। বুঝতে বাকি থাকে না যে প্রতি সোমবারে এই বাজারটি বসে। এই বাজারে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সহজেই পাওয়া যায়। সেইসাথে রয়েছে বিনোদনের জন্যে ঘোড়দৌড়ের আয়োজনও। কৃষিপণ্য সামগ্রীসহ, দুগ্ধজাত বিচিত্র পণ্য এবং হস্তশিল্প সামগ্রী এখানকার একটি বিশেষ আকর্ষণ। হাতে বোনা গালিচাসহ বিচিত্র রং এবং ডিজাইনের রেশমি বস্ত্রও এখানে সহজলভ্য।
বন্দর নগরী তুর্কামানের সাথে পরিচিত হবার পর এবার চলুন এখানকার আরেকটি শহর কোর্দকুয়ি’র সাথে পরিচিত হওয়া যাক। এখানকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা এই কোর্দকুয়ি’র আবহাওয়া কাস্পিয়ানী অর্থাৎ নাতিশীতোষ্ণ। ইতিহাসের আলোকে বলা হয়ে থাকে শাহ আব্বাস সাফাভির আমলে কুর্দিস্তানের বহু মানুষ এই এলাকায় এসে আবাস গড়ে তোলে। এ কারণেই শহরটির নাম হলো কোর্দ-কুয়ি। কোর্দকুয়ির প্রধান অর্থনৈতিক জোগান আসে কৃষিকাজ থেকে। ধান, গম, সয়া, তুলা ইত্যাদির ব্যাপক চাষ হয় এখানে। এখানে চারণভূমিও আছে অনেক। ঘাস-বিচালিতে সমৃদ্ধ এলাকাটি। এখানে বিচিত্র হস্তশিল্পও উৎপাদিত হয়ে থাকে। ‘রাদকন’ নামের একটি ইটের টাওয়ার এখানকার ঐতিহাসিক একটি স্থাপনা। সুযোগ পেলে ঘুরে আসতে ভুলবেন না এই প্রত্যাশায় আজ এ পর্যন্তই। #
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/১৬
খবরসহ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব লেখা ফেসবুকে পেতে এখানে ক্লিক করুন এবং নোটিফিকেশনের জন্য লাইক দিন