নভেম্বর ০৫, ২০১৮ ২০:২৪ Asia/Dhaka

ইসলাম ও শিশু অধিকার শীর্ষক ধারাবাহিকের গত আসরে আমরা শিশুদের বয়ঃপ্রাপ্তির বিষয়ে পবিত্র কুরআনে ব্যবহৃত কয়েকটি শব্দ ও পরিভাষা নিয়ে আলোচনা করেছি। আমরা বলেছি কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে হুলুম, নিকাহ ও আশাদ শব্দ দিয়ে বয়ঃপ্রাপ্তির দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। বয়ঃপ্রাপ্তি ইস্যুতে হুলুম ও নিকাহ শব্দের ব্যবহার নিয়ে খানিকটা ব্যাখ্যা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি আমরা। আজ এসব বিষয়েই আরও বিস্তারিত আলোচনা করব।

ইসলামের দৃষ্টিতে শিশুকালের শেষ সীমা নিয়ে কথা হচ্ছিল। শিশুকালের শেষসীমা নিয়ে কথা বলতে গেলে কুরআনের এ সংক্রান্ত তিনটি শব্দ আলোচনায় আসে। এগুলো হলো-'হুলুম', 'নিকাহ' ও 'আশাদ'। পবিত্র কুরআনে হুলুম শব্দের মাধ্যমে এমন একটি বয়সের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে যখন থেকে শিশুর মধ্যে যৌন অনুভূতি কাজ করে এবং শিশুর মধ্যে এ সংক্রান্ত কিছু পরিবর্তন ঘটে। বালাগুন নিকাহ'র মাধ্যমে এমন এমন অবস্থার কথা বলা হচ্ছে যখন একজন মানব সন্তানের মধ্যে যৌন অনুভূতির পাশাপাশি বৈবাহিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা এবং পরিবার গঠনের সামাজিক সক্ষমতা তৈরি হয়। অন্যভাবে বলা যায়, একজন মেয়ে বা ছেলে কেবল তখনি বিয়ে তথা পরিবার গঠনের যোগ্য হয় যখন সে নিজেই পরিবার গঠনের সামাজিক সক্ষমতা অর্জন করে ও চিন্তাগত দিক থেকেও পরিবার গঠনের পর্যায়ে পৌঁছায় এবং একটি পরিবার পরিচালনা করতে পারে। কাজেই বালাগুন নিকাহ পরিভাষার মাধ্যমে শুধু যৌন সক্ষমতা অর্জনকে বোঝানো হয় নি, যেমনটি 'হুলুম' পরিভাষার মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে।

বয়ঃপ্রাপ্তির কথা বোঝাতে গিয়ে কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে 'আশাদ' শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। বয়ঃপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে হুলুম ও নিকাহ শব্দের চেয়ে 'আশাদ' শব্দের ব্যবহার হয়েছে তুলনামূলক বেশি। ইরানের বিখ্যাত মুফাস্সিরে কুরআন আল্লামা তাবাতাবায়ি'র মতে, মানব সন্তান যখন দৈহিক ও শারীরিক দিক থেকে পরিপূর্ণতা অর্জন করে এবং তার শিশুসুলভ বৈশিষ্ট্যগুলো লোপ পায় তখনি সেটাকে বালাগা আশাদা বলা হয়। পবিত্র কুরআনের তাফসির গ্রন্থ আল-মিজানে তিনি বলেছেন, বালাগা আশাদা'র বয়স হচ্ছে ১৮ বছর। তার মতে, বালাগা আশাদা হচ্ছে শিশুকালের সমাপ্তি। এরপর বয়সের নতুন পর্যায় শুরু হয় এবং বৃদ্ধকাল শুরুর আগ পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। বয়ঃপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে আশাদ, নিকাহ ও হুলুম শব্দের ব্যবহার বিশ্লেষণ করলে এটা স্পষ্ট হয় যে, পবিত্র কুরআনে শিশুকাল সমাপ্তির সুনির্দিষ্ট কোনো বয়স উল্লেখ করা হয় নি। বয়ঃপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে ছেলে ও মেয়ে শিশুর মধ্যে পার্থক্যের কথাও কুরআনে আসে নি। কুরআনের বিভিন্ন আয়াত থেকে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় যে, বয়ঃপ্রাপ্তি হচ্ছে একটি প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। শিশুর দৈহিক পরিবর্তন এবং চিন্তাগত উন্নতি এর অর্ন্তভূক্ত। এসব বিষয় যেহেতু প্রাকৃতিকভাবে ঘটে সেহেতু প্রাকৃতিক চিহ্নের ভিত্তিতেই বয়ঃপ্রাপ্তির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

আমরা পবিত্র কুরআনের দৃষ্টিতে বয়ঃপ্রাপ্তি নিয়ে কথা বলছিলাম। আমরা আগেও বলেছি, শিশুকাল হচ্ছে মানব জীবনের সবচেয়ে স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আগামীর বিশ্ব কেমন হবে তা নির্ভর করছে আজকের শিশুদের ওপর। এ কারণে শিশুদেরকে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে শিশুর সঙ্গে ভালো আচরণ করতে হবে। তাদের অধিকার বাস্তবায়ন করতে হবে। বর্তমানে গোটা বিশ্বেই শিশু অধিকার বাস্তবায়নের কথা বলা হচ্ছে। বাস্তবতা হলো, শিশু অধিকার ইস্যুতে সচেতনতা দিনদিনই বাড়ছে। তবে শিশু অধিকারের বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি হতে সময় লেগেছে বহু বছর। ইতিহাস ঘাঁটলে এর প্রমাণ পাওয়া যায়।

আমেরিকার বিখ্যাত লেখক লুইড ডিমাস তার ' দ্য হিসটোরি অব দ্যা চাইল্ডহুড'  শীর্ষক বইয়ে শিশুর সঙ্গে আচরণের ইতিহাসকে ছয় পর্বে ভাগ করেছেন।

প্রথম পর্ব হচ্ছে শিশু হত্যা। এই পর্বটি চতুর্থ শতাব্দি পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। এ পর্বে শিশুদের সঙ্গে অত্যন্ত সহিংস আচরণ করা হতো। সে সময় বাবা চাইলেই তার সন্তানকে হত্যা করতে পারতো। সন্তানকে অন্যান্য বস্তুর মতো মনে করতো। লুইড ডিমাস তার বইয়ে তৎকালীন অস্ট্রলিয়ায় শিশুদের অবস্থা সম্পর্কে লিখেছেন, সে সময় অস্ট্রেলিয়ায় শিশু হত্যা বৈধ ছিল। একজন স্ত্রী একটি শিশুর বেশি রাখতে পারতো না। দ্বিতীয় সন্তান জন্ম নিলে তাকে হত্যা করা হতো। একই মায়ের গর্ভ থেকে একসঙ্গে কয়েটি শিশু জন্ম নিলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একটি শিশুকে রেখে অন্য সব শিশুকে অথবা সদ্যজাত সব ক'টি শিশুকেই হত্যা করা হতো।

দ্বিতীয় পর্ব হলো শিশুদের ওপর শারিরীক নির্যাতন ও অপমানের পর্ব। চতুর্থ শতাব্দী থেকে চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত সমাজের বেশিরভাগ মানুষ শিশুর অধিকার ও মর্যাদা সম্পর্কে প্রকৃত উপলব্ধি অর্জন করতে ব্যর্থ হন। এই পবে সমাজে এ ধারণা বদ্ধমূল ছিল যে, শিশুর মধ্যে শয়তানি বৈশিষ্ট্য রয়েছে এবং শারিরীক নির্যাতনের মাধ্যমে শিশুকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। শিশুদের মারধর করাকে স্বাভাবিক মনে করা হতো। শিশুকে তার সামর্থ্যের বাইরের কাজ চাপিয়ের প্রবণতা ছিল বেশি। শিশুর জন্য এ সময়টাও ছিল অত্যন্ত কঠিন একটি সময়।

তৃতীয় পর্ব হলো সিদ্ধান্তহীনতার পর্ব। এই পর্বটি চতুর্দশ শতাব্দী থেকে শুরু হয়ে সতের শতাব্দী পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। এ সময় শিশুদের পক্ষে বিভিন্ন মতবাদ সামনে আসে যা আগের মতবাদগুলোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এসব মতবাদ শিশু নির্যাতন কমাতে ভূমিকা রেখেছে। সমসাময়িক সমাজ বিজ্ঞানীদের কেউ কেউ শিশুর অস্তিত্ব ও প্রকৃতির সঙ্গে অপবিত্রতা ও সীমালঙ্ঘনের বৈশিষ্ট্য মিশে থাকার ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। এর ফলে অতীত ধারণার বিষয়ে মানুষের মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। তারা ভাবতে থাকে- শিশু অপবিত্র বলে যে ধারণা এর আগে দেওয়া হয়েছে তা সত্যিই সঠিক কিনা। তবে মানুষ এ পর্বেও শিশুদের বিষয়ে নেতিবাচক ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে ব্যর্থ হয়। শিশু যে শয়তানি ও অপবিত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী নয়- তা এ পর্বেও পুরোপুরি মেনে নিতে পারে নি সাধারণ মানুষ। এ পর্বেও শিশুর বিরুদ্ধে মৃত্যুদ্ণ্ডসহ বিভিন্ন কঠিন শাস্তির প্রচলন ছিল।#  

পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো.আবুসাঈদ/ ৫

খবরসহ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব লেখা ফেসবুকে পেতে এখানে ক্লিক করুন এবং নোটিফিকেশনের জন্য লাইক দিন