বিশ্ব-বিশ্রুত ইরানি কবি রুমির দিওয়ানে শামস ও মসনভি
মওলানা রুমির জীবন ও কর্ম এবং তাঁর কবিতা বা সাহিত্যকর্মের বিষয়বস্তুসহ এসব সাহিত্যের, বিশেষ করে তার কাব্য দিওয়ানে শামস ও মসনভির কিছু মৌলিক উপাদানের দিকে ইঙ্গিত করেছিলাম।
গত পর্বের আলোচনায় আমরা মাওলানা রুমির মসনভির ব্যাপক জনপ্রিয়তার ও এ মহাকাব্যের কালোত্তীর্ণতার নানা কারণ সম্পর্কে কথা বলেছি। আমরা বলেছি এ মহাকাব্যের জনপ্রিয়তার এক বড় কারণ হল এর বিষয়বস্তুর মধ্যে কুরআন ও হাদিসের শিক্ষার প্রাধান্য এবং নবী-রাসুলদের কাহিনীসহ নানা শিক্ষণীয় কাহিনীর সমাহার। আমরা শুনেছি যে মসনভিকে পাহলাভি তথা ফার্সি ভাষার কুরআন বলে আখ্যায়িত করেছেন বিখ্যাত কবি ও সাধক মাওলানা জামি। রুমির মসনভিকে সম্মান দেখিয়ে এই কাব্যকে 'মসনভি শরিফ' বলা হয়।

সাধারণ মানুষের কথ্য ভাষা ও বোধগম্য ভাষার ব্যবহারও রুমির মসনভির জনপ্রিয়তার আরেকটি বড় কারণ।
রুমির কবিতার জনপ্রিয়তার আরেকটি বড় কারণ হল প্রথাগত স্টাইল অনুসরণ না করে রুমি খোদা-প্রেম ও প্রশংসার এক নতুন স্টাইল তৈরি করেছেন। তিনি কেবল কবিতার প্রথমেই খোদার প্রশংসাকে সীমিত রাখেননি। তার কবিতার প্রথম থেকে শেষ পর্যন্তই থাকতো রহস্যবাদী খোদাপ্রেমিক বা আরেফ ও সুফির আকুল বেদনা-ভরা খোদাপ্রেম অনুসন্ধানের আগুন।
রুমির হৃদয়ে খোদাপ্রেমের যে আগুন জ্বলতো তা তিনি প্রথাগত শব্দ বা ভাষা দিয়ে ব্যক্ত না করে অনেক বেশি কাব্যিক-শৈলী ও কোমলতা দিয়ে প্রকাশ করেছেন। বিরহী বা অভিমানী প্রেমিকের প্রেম-বেদনার যে করুণ রস তা রুমি নানা উপমা দিয়ে তুলে ধরেছেন। রুমির বাঁশের বাশী তাই হয়ে উঠেছে প্রবাসে আটকা-পড়া খোদা-প্রেমিকের অব্যক্ত বেদনা প্রকাশের মাধ্যম। খোদা থেকে দূরে থাকার যে দুঃখ তা-ই রুমির বেদনার্ত আত্মার সঙ্গীত। আর মানুষের এই বেদনা প্রকৃতিগত ও বিশ্বজনীন বলেই তা আজও সবার প্রাণে এতো বেশি মধুর হয়ে বাজে। রুমির দিওয়ানে কবির ও মসনভিতে 'নেই' বা বাঁশি শব্দটি ২৮ বারেরও বেশি ব্যবহৃত হয়েছে। মাওলানার দর্শনে 'বাঁশি'র রয়েছে উচ্চতর বিশেষ অর্থ। অতীতের নানা দর্শন ও রূপকথায়ও বাঁশীর ব্যাপক প্রতীকি ব্যবহার দেখা গেছে। কিন্তু রুমির কবিতায় বাঁশী যত বেশি গভীর ও উচ্চতর অর্থবোধক হয়েছে তেমনটি আর কোথাও দেখা যায় না। রুমির বাঁশি নরনারীর সাধারণ কোনো ব্যথা-বেদনা বা ভুলত্রুটির অনুশোচনা তুলে ধরে না, বরং এই বাঁশীর কান্না মানব-আত্মার এমন এক বেদনা যা আত্মাগুলোর মূল উৎস বা আবাসস্থল থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার বেদনা বলেই তার মূল্য অপরিসীম এবং তা অনেক বেশি উঁচু দরের।
রুমির বাঁশির কান্না বা বেদনা পার্থিব চাওয়া-পাওয়ার গণ্ডী এবং বস্তুগত সত্তা ও শরীর নামক সংকীর্ণ জগতের বন্ধন থেকে মুক্তির লক্ষ্যে অসীমের পানে তথা মহান আল্লাহর অসীম একত্বের সত্তার দিকে মিলিত হওয়ার বা সেদিকে ছুটে চলারই আকুতি।
বিশ্লেষকরা মনে করেন রুমি বাঁশির অনুযোগের মধ্য দিয়ে নিজের আমিত্ব ও অহং সত্তাকে বিলীন করতে চেয়েছেন খোদাপ্রেমের অসীম সাগরে। রুমির এই বক্তব্য যেন তার মুখ দিয়ে মহান আল্লাহরই প্রেমময় বাণীর প্রতিধ্বনি এবং প্রেমিক ও প্রেমাস্পদের প্রেমময় সংলাপেরই প্রকাশ।
প্রফেসর আব্দুল হোসাইন যাররীন কুব তাঁর সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে খোদার সাক্ষাৎ' নামক মৌলাভির জীবনীমূলক গ্রন্থে লিখেছেন-মৌলাভি তাঁর মাসনাভি এবং অন্যান্য গযলে উচ্চতর রহস্যময় চিন্তা এবং শিক্ষাগুলোকে কবিতার মতো করে রচনা করেছেন। তাঁর নিজের জীবনটাও সেই ছোট্ট বেলা থেকেই আধ্যাত্মিকতার সিঁড়ি অতিক্রম করে করে অগ্রসর হয়েছে। তিনি তো কবিতা লেখেন নি,কবিতাকে মূর্তমান করেছেন। আমার মতে মৌলাভির অ-রচিত কবিতাগুলো অর্থাৎ তাঁর আধ্যাত্মিক রহস্যঘেরা জীবনেতিহাস উপলব্ধি করা ছাড়া তাঁর কবিতা উপলব্ধি করা সম্ভব হবে না। কারণ তাঁর জীবন এবং কবিতার মধ্যে রয়েছে বিস্ময়কর অভিন্নতা ও সমন্বয়।'
মাওলানা রুমি নিজেকে বাঁশির মতো ভাবতেন। বাঁশির যেমন ভেতরটা খালি, আর অন্য কেউ তার ভেতর ফুঁ দিলে বাঁশির সুরেলা ভাষা তৈরী হয়,তেমনি মাওলানার ভেতরটাও ছিল খালি। কেউ একজন তাঁর ভেতরে ফুঁ দিলেই কেবল তিনি ভাষা পেতেন,আর সেই ভাষাই কাব্যাকারে লিখিত হয়। মাওলানার সেই সুর সৃষ্টিকারী ও ভাষা দানকারী সত্ত্বাটি ছিলেন তাঁরই গুরু মহান আধ্যাত্মিক সাধক শামসে তাব্রিযি।
মাওলানা রুমির মসনভিতে কুরআনের ব্যাপক প্রভাব দেখা যায়। কুরআনে যেমন প্রসঙ্গক্রমে বিভিন্ন গল্প-কাহিনীর অবতারণা করা হয়েছে,তেমনি রুমি তার মাসনাভিতেও নিজের বিভিন্ন চিন্তাদর্শ বর্ণনা প্রসঙ্গে গল্প-কথার আশ্রয় নিয়েছেন। রুমি একজন মুসলমান হিসেবে কুরআন এবং আসমানি মতাদর্শগুলোর প্রতি গভীরভাবে মনোযোগী ছিলেন। গবেষণায় দেখা গেছে রুমি কুরআনের অন্তত ২ হাজার ২০০ টি আয়াতের প্রতি সরাসরি ইঙ্গিত করেছেন কিংবা বলা যায় কবিতার আঙ্গিকে মৌলাভি আসলে কুরআনের আয়াতেরই ব্যাখ্যা করেছেন। অন্য কথায়
কবি জালালুদ্দিন রুমি কুরআনের এক তৃতীয়াংশ আয়াতই তাঁর মাসনাভিতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ব্যবহার করেছেন। এ কারণেই হিজরী ত্রয়োদশ শতকের বিখ্যাত মরমী কবি মরহুম হাজ্জ্ব মোল্লা হাদী সাবজেভরি মাওলানা রুমির মাসনাভিকে কুরআনের তাফসীর এবং রুমিকে কুরআনের একজন মুফাসসির বলে উল্লেখ করেছিলেন।
রুমির মসনভির বয়স আট শ'বছর পেরিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও আজো তার আলো পৃথিবীর সাহিত্য ও সংস্কৃতির ভূবনকে কেনো ভীষণভাবে আলোকিত করে যাচ্ছে তার রহস্য লুকিয়ে আছে এ মহাকাব্যের কুরআন-মুখিতার মাঝেই।
কেনো প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বহু মনীষী এমনকি ইকবাল লাহোরী আর হেগেলের মতো দার্শনিকরাও মাওলানার ভাবধারায় উজ্জীবিত হয়েছিলেন তার রহস্যও লুকিয়ে আছে এই একই কারণের মাঝে। ইরানের বহু আরেফও মসনভির সূরা পান করেছেন এবং এই উদ্যানের আধ্যাত্মিক সুগন্ধি অনুভব করেছেন। এটা স্পষ্ট যে মসনভির সমুদ্রের রহস্যময় অতলে এখনো রয়েছে নতুন নতুন মুক্তা। রসিকমাত্রই সেখান থেকে যতো প্রয়োজন কুড়িয়ে নিতে পারবে। রুমির রচনার প্রতি বর্তমান পাশ্চাত্যের গভীর অনুরাগ তারই প্রমাণ বহন করছে।#
পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ২
খবরসহ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব লেখা ফেসবুকে পেতে এখানে ক্লিক করুন এবং নোটিফিকেশনের জন্য লাইক দিন