ইসলাম ও শিশু অধিকার (পর্ব-৭): কন্যাশিশু মেরে ফেলার প্রবণতা
পবিত্র ইসলাম ধর্ম আবির্ভাবের আগে বিশ্বের প্রায় সর্বত্রই শিশুদের অবস্থা ছিল অত্যন্ত নাজুক। তাদেরকে ন্যূনতম অধিকারও দেওয়া হতো না।
অভাব-অনটনের কথা বলে শিশুদের হত্যা করা হতো। এ জন্য কোনো শাস্তির সম্মুখীন হতে হতো না। কন্যাশিশু মেরে ফেলার প্রবণতা ছিল সবচেয়ে বেশি। কিন্তু পবিত্র ইসলাম ধর্ম আবির্ভাবের পর শিশু হত্যাকে মারাত্মক অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
শিশুর সার্বিক বিকাশের জন্য যা কিছু প্রয়োজন,তার সবই প্রস্তুত করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে ইসলাম। ইসলাম ধর্মমতে,পৃথিবীতে শিশুর আগমনের সুস্থ পরিবেশ তৈরির প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে একজন ভালো জীবনসঙ্গী নির্বাচন করা। কারণ ইসলাম মনে করে অনাগত সন্তানেরও ভালো বাবা-মা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। এটি শিশু অধিকারেরই অংশ। বাবা-মা সৎ ও ধার্মিক না হলে শিশুরও একই পথে চলার আশঙ্কা থেকে যায়। জীবনসঙ্গী নির্বাচনের ধারাবাহিকতায় ইসলাম ধর্ম মাতৃগর্ভে থাকা ভ্রূণের বিশেষ যত্মের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। জন্মের পর সঠিক উপায়ে সন্তানকে গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে। ধার্মিক ও সচ্চরিত্রবান জীবনসঙ্গী নির্বাচনের মাধ্যমে সন্তানদেরকেও ধার্মিক ও সচ্চরিত্রবান হিসেবে গড়ে তুলতে বলেছে পবিত্র ইসলাম ধর্ম। রাসূলে খোদা হজরত মুহাম্মাদ (স.) স্ত্রী নির্বাচনের বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিতে গিয়ে বলেছেন,স্ত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রে সাধারণত চারটি বিষয় লক্ষ্য করা হয়। এগুলো হলো-ধন-সম্পদ,বংশ-পরিবার,সৌন্দর্য এবং ধার্মিকতা। মহানবী বলেছেন, এগুলোর মধ্যে ধার্মিকতাকে বেছে নিন,কারণ ধার্মিকতার মধ্যে রয়েছে কল্যাণ।
প্রতিটি শিশুরই রয়েছে বিশেষ অধিকার। কিন্তু সেই অধিকার রক্ষার ক্ষমতা শিশুর নেই। এ কারণে শিশু অধিকার রক্ষা ও নিশ্চিত করতে ইসলাম ধর্ম বাবা-মা এবং রাষ্ট্র ও সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে। অনেক শিশুর বাবা-মা নেই। তাদের অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব হচ্ছে অভিভাবকের। কাউকে না কাউকে এ ধরণের শিশুর দায়িত্ব নিতে হবে। প্রয়োজনে সরকারকে এ ধরনের শিশুর দায়িত্ব নিতে হবে। অবশ্য প্রতিটি দেশেই এ সংক্রান্ত আইন রয়েছে। শিশু অধিকার লঙ্ঘিত হলে আইনের মাধ্যমে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। শিশুদের কেউ কেউ নানা সমস্যা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। তাদের জন্যও বিশেষ যত্মের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া প্রতিটি রাষ্ট্র ও সমাজেই রয়েছে অসংখ্য এতিম শিশু। এর বাইরে বাবা-মা থাকার পরও অনেক শিশু তাদের সঙ্গ পায় না। বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের কারণে অনেক সময়ই তাদের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে। শিশুদেরকে এ ধরণের পরিস্থিতি রক্ষা করতে বার বার আহ্বান জানিয়েছে পবিত্র ইসলাম ধর্ম।
পবিত্র ইসলাম ধর্ম এতিম শিশুদের অধিকার রক্ষা করতে কঠোর নির্দেশনা জারি করে রেখেছে। এতিমদের প্রতি স্নেহ-ভালোবাসা এবং তাদের সঙ্গে সদাচরণের জন্য পবিত্র কুরআন ও হাদিসে সব মানুষকে উৎসাহিত করা হয়েছে। আসলে ইসলাম ধর্ম শিশুদের সর্বোচ্চ অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলেছে। পবিত্র কুরআনে শিশু অধিকার সংক্রান্ত আয়াতের সংখ্যাও শিশু অধিকারের প্রতি ইসলাম ধর্মের ব্যাপক গুরুত্বের প্রমাণ বহন করে। পবিত্র কুরআনের ২১৬টি আয়াতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শিশু অধিকারের কথা বলা হয়েছে। এছাড়া শিশু অধিকার সম্পর্কে রয়েছে হাজার হাজার হাদিস। এখন থেকে ১৪শ'বছর আগে ইসলাম ধর্ম এসব দিকনির্দেশনা দিয়েছে যখন বিশ্বের কোথাও শিশু অধিকার সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান ও কনভেনশন ছিল না। ইসলাম ধর্মে শিশুর দৈহিক ও মানসিক বিকাশ থেকে শুরু করে সব ধরণের চাহিদা মেটানোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
স্বাভাবিকভাবেই এ প্রশ্ন উঠতেই পারে যে,প্রতিটি শিশুওতো মানুষ। তাদের আবার বিশেষ অধিকারের কী দরকার? আসলে প্রতিটি শিশুই একজন মানুষ হিসেবে গণ্য হলেও তারা পূর্ণ সক্ষমতা প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য শৈশব হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। এ সময় সঠিকভাবে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ না ঘটলে সেই ঘাটতি আর কোনো দিন পূরণ হয় না। বিকশিত হওয়ার সুষ্ঠু ও সুন্দর পরিবেশ পেলে একটি শিশু তার পরিবার ও সমাজ এমনকি গোটা বিশ্বের জন্য মহাকল্যাণ হিসেবে দেখা দিতে পারে। অনস্বীকার্য বাস্তবতা হচ্ছে,শিশুর ওপর বাবা-মা এবং আশেপাশের মানুষের ব্যাপক প্রভাব পড়ে। আশেপাশের মানুষের আচরণ তারা অনুকরণ করে এবং তা নিজেদের মধ্যে ধারণ করে।
সূরা নূহের ২৭ নম্বর আয়াতে হজরত নূহ (আ.) আল্লাহকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, 'হে আমার পালনকর্তা,আপনি পৃথিবীতে কোন কাফেরকে অবশিষ্ট রাখবেন না। যদি আপনি তাদেরকে অবশিষ্ট রাখেন,তবে তারা আপনার বান্দাদেরকে পথভ্রষ্ট করবে এবং দুরাচারী ও কাফির ছাড়া অন্য কারো জন্ম দেবে না।'সূরা মারিয়ামের ২৮ নম্বর আয়াতে এসেছে,হজরত ঈসা (আ.)'র জন্মের সময় লোকজন হজরত মারিয়ামকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন,হে হারুনের বোন! না তোমার বাপ কোন খারাপ লোক ছিল,না তোমার মা ছিল কোন ব্যভিচারিণী।
পবিত্র কুরআনের পাশাপাশি বিভিন্ন হাদিস ও ইসলামি সনদে শৈশবকালের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। এখানে এ সংক্রান্ত দু'টি উদাহরণ তুলে ধরছি। ইমাম হাসান (আ.)'র কাছে লেখা এক চিঠিতে হজরত আলী (আ.) বলেছেন,নবজাতকের হৃদয় উর্বর জমির মতো এবং সেখানে যে বীজই বপন করা হয় তাই কাজে আসে। এ কারণে তোমার চিন্তা-চেতনা অন্যত্র ব্যস্ত হয়ে পড়ার আগেই এবং শিক্ষা-প্রশিক্ষণ গ্রহণ তোমার জন্য কঠিন হয়ে পড়ার আগেই আমি তোমাকে গড়ে তোলার প্রতি মনোযোগ দিয়েছি।"
হজরত আলী (আ.) আরও বলেছেন,শৈশবের শিক্ষা,পাথরে চিত্র খোদাইয়ের মতো। এর মাধ্যমে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন,একজন মানুষ শৈশবে যা শেখে তা চিরজীবন তার মনে থাকে। যা শেখে তা তাদের মনে ভেতর গেঁথে যায়। এ কারণে শৈশবকে কাজে লাগাতে হবে এবং এ বয়সেই শিশুকে সচেতনভাবে শিক্ষা দিতে হবে। ভালো শিক্ষা-প্রশিক্ষণ দিয়ে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার সুযোগ করে দিতে হবে। বাবা-মা-ভাই-বোনকে সৎসঙ্গী হিসেবে কাজ করতে হবে। কারণ সৎসঙ্গও শিশুর জন্য জরুরি। #
পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো.আবুসাঈদ/ ৩০
খবরসহ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব লেখা ফেসবুকে পেতে এখানে ক্লিক করুন এবং নোটিফিকেশনের জন্য লাইক দিন