ইসলাম ও শিশু অধিকার (পর্ব-৮): গর্ভবতী মায়ের মানসিক সুস্থতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
'ইসলাম ও শিশু অধিকার'শীর্ষক ধারাবাহিকের গত আসরে আমরা বলেছি,শৈশব হচ্ছে এমন একটি সময় যখন ব্যক্তির জীবন-প্রণালীর ভিত্তি স্থাপিত হয়। শৈশবকে আনন্দময় এবং সুন্দর ভবিষ্যতের ভিত্তি হিসেবে হিসেবে কাজে লাগাতে বাবা-মায়ের গুরুত্ব অপরিসীম।
স্বামী-স্ত্রীর যৌথ উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় শিশুর জন্ম হলেও জন্মের আগ পর্যন্ত যিনি নিজের গর্ভে বহন করেন এবং সমগ্র অস্তিত্ব দিয়ে শিশুর নিরাপদ আগমন নিশ্চিত করেন তিনি হলেন মা। এ কারণে গর্ভবতী মায়ের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গর্ভবতী মায়ের যত্ম মানেই শিশুর যত্ম। শিশু যাতে মাতৃগর্ভে সুস্থভাবে বেড়ে উঠতে পারে এবং সুস্থভাবে পৃথিবীতে আসতে পারে সেজন্য গর্ভবতী মায়ের বিশেষ সেবা-শুশ্রুষা জরুরি। ইসলাম ধর্মে এসব বিষয়ে সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। জন্মের পর শিশু ও মা-উভয়েরই বিশেষ যত্ম নিতে হবে। শিশুকে শুধু ভালো খাবার ও জামা-কাপড় দিলেই চলবে না,তার জন্য নিরাপদ ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। মায়া-মমতা ও ভালোবাসার ঘাটতি যাতে না হয় সেদিকটি খেয়াল রাখতে হবে। শিশুর জন্য মায়া-মমতা ও ভালোবাসা এতোটাই প্রয়োজন যে,আল্লাহতায়ালা সন্তানের প্রতি ভালোবাসাকে মানুষের জন্মগত বৈশিষ্ট্যের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। যেকোনো স্বাভাবিক ও সুস্থ বাবা-মায়ের মধ্যেই সন্তানের প্রতি ভালোবাসা রয়েছে। অবশ্য এতিম শিশুরা এমন ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়। এ কারণে এতিম শিশুর প্রতি বিশেষ নজর রাখা প্রতিটি মানুষের দায়িত্ব।

যেকোনো সমাজের দুর্বলদের শীর্ষে রয়েছে শিশুরা। তারা ভবিষ্যতের কর্ণধার হলেও অন্যের সহযোগিতা ছাড়া তাদের শৈশব পেরোনো সম্ভব নয়। তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য সার্বক্ষণিক সহযোগিতার বিকল্প নেই। ভবিষ্যতের কর্ণধার এই শিশুদের সার্বিক বিকাশ নিশ্চিত করতে বিশেষ আইন ও নীতিমালা জরুরি। এ কারণেই বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই শিশুদের রক্ষায় বিশেষ আইন ও নীতিমালা রয়েছে। এরপরও বিশ্বের প্রায় সব দেশেই এখনও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। এর একটি বড় কারণ হলো,অবিবেচক অভিভাবক এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ। এসব কারণে এখনও প্রায় সব দেশেই রয়েছে বহু পথশিশু। প্রতিটি সমাজ ও রাষ্ট্রেই শিশুর গুরুত্ব তুলে ধরার পাশাপাশি আইনের প্রয়োগ জরুরি।
শিশু ও বড়দের চাহিদা কখনোই এক রকম নয়। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, শিশুদের জগতটাই পুরোপুরি আলাদা। বড়দের জগতের সঙ্গে ওই জগতের কোনো মিল নেই। এ কারণেই সাধারণত বড়রা যেসব খেলা ও কাজে আনন্দ পায় সেসবে আনন্দ পায় না শিশুরা। তারা তাদের নিজেদেরকে, পারিপাশ্বিকতাকে সর্বোপরি পুরো জীবনটাকেই আলাদাভাবে অনুভব করে। অভিজ্ঞতা না থাকায় তারা বড়দের মতো ভাবতে বা সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। শৈশব কাটানোর মধ্যদিয়ে তারা অভিজ্ঞ হয়ে উঠে এবং সুন্দর ও মসৃণ শৈশব তাদের জন্য সুন্দর ভবিষ্যত নিশ্চিত করে। বড়দের এটা মনেপ্রাণে উপলব্ধি করতে হবে যে, শিশুর চিন্তা-চেতনা ও চাহিদা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এসব বিবেচনায় নিয়েই তাদের সঙ্গে আচরণ করতে হবে। শিশুর জগত ও চিন্তার পরিধি বিবেচনায় নিয়েই তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে, উপযুক্ত আচরণ করতে হবে। শিশু বিষয়ক গবেষণায় এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, শারীরিক যত্মের পাশাপাশি শিশুর মনন ও চিন্তারও যত্ম নিতে হবে।
শিশুর জন্মের পর প্রথমেই যাদের প্রতি তার দেখাশোনা ও বড় করার দায়িত্ব বর্তায় তারা হলেন বাবা-মা। এরপর ক্রমান্বয়ে স্বজনসহ আশেপাশের মানুষদের ওপর শিশুর সুন্দরভাবে বেড়ে উঠার সুযোগ সৃষ্টির দায়িত্ব বর্তায়। এরপর সমাজ ও রাষ্ট্রও শিশুর ব্যাপারে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়। তবে শিশুকে সঠিকভাবে লালন-পালনের জন্য এ সংক্রান্ত জ্ঞান ও তথ্য জানা দরকার। কীভাবে শিশুদের সঙ্গে কথা বলা উচিত, কী ধরণের আচরণ করলে তারাও ভালো আচরণে অভ্যন্ত হবে-এসব নানা বিষয়ে বাবা-মা তথা অভিভাবকদের জ্ঞান থাকা উচিত। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, শিশু বিকাশের নানা দিক রয়েছে। এগুলো হলো- দৈহিক বিকাশ, ভাষাগত বিকাশ, আবেগ-অনুভূতির দিক থেকে বিকাশ, চিন্তাগত বিকাশ, সামাজিক বিকাশ এবং ব্যক্তিত্বের বিকাশ। এ বিষয়গুলো সম্পর্কে উপযুক্ত জ্ঞান থাকলে শিশুর সার্বিক বিকাশ আরও মসৃন হয়। প্রতিটি শিশুরই একেক বয়সে একেক ধরণের চাহিদা সৃষ্টি হয়। সেসব চাহিদা কথাও মাথায় রাখতে হবে।
যেকোনো সমাজেরই মূল ভিত্তি হচ্ছে পরিবার। আর প্রতিটি সন্তান হচ্ছে সমাজের ভবিষ্যৎ। ইসলাম ধর্মে পরিবার গঠনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কারণ সৎ ও সুস্থ পরিবার সুস্থ ও যোগ্য প্রজন্ম নিশ্চিত করে। স্বামী ও স্ত্রী যখন সন্তান নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তখন তাদের উভয়ের মানসিক প্রশান্তি জরুরি। এ কারণে পরস্পরের মানসিক ও শারীরিক অবস্থার দিকে দু'জনেরই বিশেষ নজর থাকা উচিৎ। শুধু তাই নয়,পরিবারের অন্য সদস্যদেরও এ বিষয়ে সতর্কতা জরুরি।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, শিশু গর্ভে থাকা অবস্থায়, বুকের দুধ খাওয়ার বয়সে এবং পরবর্তীতে সন্তানকে ভালোভাবে বড় করে তোলার ক্ষেত্রে মায়ের ভূমিকা অস্বীকার্য। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মূল কারিগরই হচ্ছে আজকের মা ও বাবা। এ কারণে মা-বাবা হওয়ার জন্যও প্রস্তুতি নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।
ইসলাম ধর্মে কার্যত জন্মের আগে থেকেই শিশুর সুন্দর ভবিষ্যত গড়ে তোলার প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে। এর মাধ্যমে জন্মের আগেই শিশুর অধিকারের প্রতি ইসলাম নজর দিয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক কোনো সনদ বা কনভেনশনে এ বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করা হয় নি। আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার বিষয়ক সনদ এমনকি মানবাধিকার বিষয়ক সনদগুলোতেও সৎ ও সুস্থ শিশুকে পৃথিবীতে আসার সুযোগ করে দেওয়ার কথা বলা হয় নি। অবশ্য আন্তর্জাতিক সনদগুলোতে শিশুকাল শুরুর সময়ও স্পষ্ট করা হয় নি। সন্তান জন্ম দেওয়ার আগে ও পরে বাবা-মা'কে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে বলেছে ইসলাম ধর্ম, যাতে বা-মায়ের কোনো ভুল বা দোষের কারণে অসুস্থ শিশুর জন্ম না হয় এবং পরবর্তীতেও শিশু অসুস্থ হয়ে না পড়ে। একইসঙ্গে খেয়াল রাখতে হবে, বাবা-মায়ের উদাসিনতা ও অবহেলার কারণে যেন সন্তান পশ্চাৎপদ না হয় এবং দুঃখ-কষ্টের মধ্যে না পড়ে। মনে রাখতে হবে, শিশুর শারীরিক, মানসিক, নৈতিক ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসহ প্রায় সব কিছুতেই বাবা-মায়ের প্রভাব পড়ে। কাজেই শিশুকে সুস্থ ও সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে বাবা-মা'কে সব দিক থেকে সতর্ক হতে হবে। নিজের আচার-আচরণে সমস্যা থাকলে তা সংশোধন করতে হবে।#
পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো.আবুসাঈদ/ ৭
খবরসহ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব লেখা ফেসবুকে পেতে এখানে ক্লিক করুন এবং নোটিফিকেশনের জন্য লাইক দিন
ট্যাগ