জানুয়ারি ১৬, ২০১৯ ২০:৩৬ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠান 'কুরআনের আলো'র আজকের পর্বে সূরা সাবার ২২ থেকে ২৪ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা শুরু হবে। এই সূরার ২২ ও ২৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

قُلِ ادْعُوا الَّذِينَ زَعَمْتُمْ مِنْ دُونِ اللَّهِ لَا يَمْلِكُونَ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ فِي السَّمَاوَاتِ وَلَا فِي الْأَرْضِ وَمَا لَهُمْ فِيهِمَا مِنْ شِرْكٍ وَمَا لَهُ مِنْهُمْ مِنْ ظَهِيرٍ (22) وَلَا تَنْفَعُ الشَّفَاعَةُ عِنْدَهُ إِلَّا لِمَنْ أَذِنَ لَهُ حَتَّى إِذَا فُزِّعَ عَنْ قُلُوبِهِمْ قَالُوا مَاذَا قَالَ رَبُّكُمْ قَالُوا الْحَقَّ وَهُوَ الْعَلِيُّ الْكَبِيرُ (23)

“বলুন, তোমরা আল্লাহ ব্যতীত যাদেরকে (নিজেদের উপাস্য) মনে করতে তাদেরকে আহবান কর।  তারা আসমান ও জমিন (সৃষ্টি ও পরিচালনায়) অণু পরিমাণ কোন কিছুর মালিক নয়, এতে তাদের (অর্থাৎ কল্পিত উপাস্যদের) কোন অংশও নেই এবং তাদের কেউ আল্লাহর সহায়কও নয়।” (৩৪:২২)

“যার জন্য আল্লাহ অনুমতি দেন, তার জন্য ছাড়া আল্লাহর কাছে কারও সুপারিশ ফলপ্রসূ হবে না। যখন তাদের মন থেকে ভয়-ভীতি দূর হয়ে যাবে, তখন তাদের জিজ্ঞাসা করা হবে, তোমাদের পালনকর্তা কি বললেন? তারা জবাবে বলবে, তিনি সত্য বলেছেন এবং তিনিই সবার উপরে মহান।” (৩৪:২৩)

মক্কার মুশরিক ও মূর্তি পূজারিদের উদ্দেশ করে এই দুই আয়াত নাজিল হয়েছে। এখানে যুক্তিপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করে মুশরিকদের ভ্রান্ত বিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। বলা হচ্ছে: তোমরা আল্লাহর সঙ্গে কিছু উপাস্যকে শরীক মনে করছ এবং ভাবছ বিশ্বজগত পরিচালনার কিছু কাজ তারা করে থাকে। সত্যিই যদি তাই হয় তাহলে এখন তাদেরকে ডেকে তোমাদের সমস্যার সমাধান করে দিতে বলো। তাদেরকে যদি এই সৃষ্টিজগতের কোনো কাজে অংশ নিতে হয় তাহলে তাদেরকে হয় আসমান ও জমিনের কিছু অংশের মালিক হতে হবে, অথবা বিশ্বজগত সৃষ্টি ও পরিচালনায় আল্লাহর অংশীদার হতে হবে কিংবা অন্তত আল্লাহর একজন সহযোগী হতে হবে। কিন্তু বাস্তবে তাদের কল্পিত উপাস্যরা এসবের কিছুই নয়।

মুসলমানদের একটি বিশ্বাস হচ্ছে, কিয়ামতের দিন নবী-রাসূল ও আল্লাহর ওলীগণ কোনো কোনো বান্দার মুক্তির জন্য শাফায়াত বা সুপারিশ করতে পারবেন। প্রশ্ন আসতে পারে, এই শাফায়তাকারীগণের সঙ্গে মুশরিকদের কল্পিত উপাস্য বা মূর্তিগুলোর কি পার্থক্য রয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তরে পরের আয়াতে বলা হচ্ছে: নবী-রাসূল এবং আল্লাহর বিশেষ আওলিয়াগণকে আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন এবং অন্যান্য সৃষ্টির মতো তাদেরও নিজস্ব কোনো ক্ষমতা নেই। কিন্তু আল্লাহ তায়ালাই তাদেরকে কিছু মানুষের শাফায়াত করার অনুমতি দিয়েছেন।

আমরা সবাই জানি, মহান আল্লাহ মানুষকে সঠিক পথ প্রদর্শনের জন্য পৃথিবীতে নবী-রাসূলগণকে পাঠিয়েছেন এবং নিজের আদেশ-নিষেধগুলো ওহী বা ঐশী বাণী আকারে তাদের কাছে প্রেরণ করেছেন। নবী-রাসূলগণ আল্লাহর সে বিধান সঠিকভাবে মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। এসব মহাপুরুষকে আল্লাহ তায়ালা সুপারিশ করার অনুমতি দিয়েছেন। মুমিনদের একদল যারা তাদের ধর্মীয় কর্তব্য পালনে উদাসীনতা দেখিয়েছেন তারা নবী-রাসূলদের কাছে গিয়ে আল্লাহ ও তাদের মধ্যে মধ্যস্থতা করার দাবি জানাবেন যাতে আল্লাহ তাদের তওবা কবুল করেন। এভাবে তারা তওবা করার পাশাপাশি নবী-রাসূল ও আউলিয়াদের কাছে ধর্না দিয়ে তাদের সন্তুষ্টি অর্জনের পাশাপাশি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করার চেষ্টা করবেন।

এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১. মানুষের নানা অযোগ্যতা ও অসম্পূর্ণতা থাকার জন্য পার্থিব জগতের বিভিন্ন কাজে তাকে অংশীদার বা সহযোগী গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু বিশ্বজাহানের একমাত্র অধিপতি আল্লাহ তায়ালার এ ধরনের কোনো অংশীদার বা সহযোগীর প্রয়োজন নেই।

২.  ইসলামি পরিভাষায় শাফায়াতের অর্থ এই নয় যে, যিনি শাফায়াত করবেন তিনি আল্লাহর চেয়ে বেশি দয়ালু হয়ে গেছেন। বরং মহান আল্লাহ নিজেই তার বিশেষ প্রিয় বান্দাদেরকে শাফায়াত করার অনুমতি দিয়েছেন।

সূরা সাবা’র ২৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

  قُلْ مَنْ يَرْزُقُكُمْ مِنَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ قُلِ اللَّهُ وَإِنَّا أَوْ إِيَّاكُمْ لَعَلَى هُدًى أَوْ فِي ضَلَالٍ مُبِينٍ (24)

“বলুন, আসমান ও জমিন থেকে কে তোমাদেরকে রিযিক দেয়। বলুন, আল্লাহ।  এবং অবশ্যই আমাদের অথবা তোমাদের মধ্যে (যেকোনো একদল) সৎপথে অথবা স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে আছি।” (৩৪:২৪)

আগের আয়াতে আল্লাহ তায়ালা যে এই বিশ্বজগতের স্রষ্টা সে বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। আর এই আয়াতে বলা হচ্ছে, শুধু সৃষ্টি নয় রিজিকের মালিকও আল্লাহ। এখানে প্রশ্ন উত্থাপন করে বলা হচ্ছে: কে তোমাদের জন্য রিজিকের সংস্থান করেছেন? কে তোমাদের জন্য মেঘমালা ও বৃষ্টি প্রেরণ করেন যাতে শুকনো ও মৃত ভূমি কৃষিকাজের উপযোগী হওয়ার জন্য জীবন ফিরে পায়? কে তোমাদের ফসল উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় সূর্যের আলো বিকিরণ করেন? আসমান ও জমিন থেকে এতসব আয়োজন কার নির্দেশে প্রস্তুত হয়?

মক্কার মুশরিক ও কাফিরদের উদ্দেশ করে আরো বলা হচ্ছে: তোমরা এসব কাজে আল্লাহর সঙ্গে অন্য অংশীদার সাব্যস্ত করছ অথচ এতসব দয়া ও নেয়ামত এক আল্লাহর পক্ষ থেকেই সংঘটিত হয়; তাঁর কোনো অংশীদার বা সহযোগীর প্রয়োজন নেই। আল্লাহর রাসূল (সা.) কাফেরদের উদ্দেশ করে আরো বলেন, তোমাদের বিশ্বাস ও আমাদের বিশ্বাসে আকাশ-পাতাল ব্যবধান রয়েছে। তোমরা চিন্তা করে দেখো, যদি আমাদের বিশ্বাস সঠিক হয় তাহলে গ্রহণ করো আর যদি সঠিক মনে না হয় তাহলে বর্জন করো।

বিশ্বনবী (সা.) এখানে নিজে থেকে কোনো স্থিরসিদ্ধান্ত ঘোষণা করে একথা বলেননি যে, আমরাই সঠিক পথে রয়েছি এবং তোমরা বিভ্রান্তিতে নিমজ্জিত রয়েছে। বরং তিনি ভদ্রজনচিতভাবে বলেছেন, তোমাদের এবং আমাদের মধ্যে যেকোনো একদল হেদায়েতপ্রাপ্ত হয়ে সঠিক পথে রয়েছি এবং অপরদল রয়েছি স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে। আমাদের উভয়দলের উচিত যুক্তি ও বিচারবুদ্ধি দিয়ে বিশ্লেষণ করে দেখা কোন পক্ষ সত্যের পথে রয়েছে। এরপর অপরদলের উচিত সে পথ গ্রহণ করা।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় কয়েকটি বিষয় হচ্ছে:

১. মানুষকে সত্যের পথে দাওয়াত দেয়ার ক্ষেত্রে একতরফাভাবে নিজের বক্তব্য চাপিয়ে দেয়ার পরিবর্তে মাঝেমধ্যে প্রশ্ন করা উত্তম। এটি কুরআনে কারিমের পদ্ধতি। প্রশ্ন করলে শ্রোতা বিষয়বস্তু সম্পর্কে চিন্তা করার সুযোগ পায় এবং চিন্তা করলে যেকোনো মানুষের সামনে সঠিক পথের দরজা উন্মুক্ত হয়ে যেতে পারে।

২. মানুষ যদিও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে মাঠে ফসল ফলাতে সক্ষম কিন্তু ফসল উৎপাদনের প্রতিটি উপাদান আসে আল্লাহর পক্ষ থেকে। মাটি, পানি, অনুকূল আবহাওয়া ইত্যাদি ছাড়া মানুষের পক্ষে কৃষিকাজ কিংবা পশুপালন করা সম্ভব ছিল না।  রিজিক যে একমাত্র আল্লাহর হাতেই রয়েছে এগুলো তার প্রমাণ।#