"নিশ্চয়ই মানুষ লোভাতুর ও অস্থির প্রকৃতির সৃষ্ট হয়েছে": সুরা মাআরিজ
গত পর্বের আলোচনায় আমরা সুরা মাআরিজের ১৯ থেকে ২২ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যা শুনেছি। ওইসব আয়াতে মহান আল্লাহ সাধারণ মানুষ ও বিশ্বাসী নামাজিদের তথা সৎ ও ভালো মানুষদের পার্থক্য তুলে ধরে বলছেন:
(১৯) নিশ্চয়ই মানুষ লোভাতুর ও অস্থির প্রকৃতির সৃষ্ট হয়েছে। (২০) তাকে দুঃখ বা ক্লেশ স্পর্শ করলে খুবই বিচলিত হয়ে পড়ে বা হা-হুতাশ করে। (২১) এবং কল্যাণ তাকে স্পর্শ করলে তথা ঐশ্বর্যশালী হলে কৃপণতা করে। (২২) কেবল নামাযীরা ছাড়া (যারা নিয়মিত নামাজ আদায় করে যায়)। এরপর সুরা মাআরিজের ২৬ থেকে ২৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ সৎ ও ভালো মানুষদের আরও কয়েকটি বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে বলছেন: এবং যারা প্রতিফল দিবসকে সত্য বলে বিশ্বাস করে এবং যারা তাদের পালনকর্তার শাস্তির সম্পর্কে ভীত-কম্পিত। নিশ্চয় তাদের পালনকর্তার শাস্তি থেকে নিঃশঙ্ক থাকা যায় না। এবং যারা তাদের শরীরকে ব্যভিচার থেকে মুক্ত রাখে তথা যৌন-অঙ্গকে সংযত রাখে। অবশ্য তাদের স্ত্রী অথবা মালিকানাভুক্ত দাসীদের বেলায় সংযম বজায় না রাখলেও তারা তিরস্কৃত হবে না।
মানুষের যৌন চাহিদা বেয়াড়া ও বিপজ্জনক প্রবৃত্তিগুলোর অন্যতম। তাই এ প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণে রেখে বৈধ ও সঠিক পন্থায় ব্যবহার করা উচিত। যৌন প্রবৃত্তি মানব সমাজের বহু সংকট ও বিচ্যুতির উৎস। তাই একে সংযত রাখা তথা বৈধতার সীমানার মধ্যে এ প্রবৃত্তিকে সীমিত রাখা খোদাভীতির অন্যতম শর্ত। আর এ জন্যই পবিত্র কুরআনে নামাজ ও দরিদ্রদের সাহায্য দেয়ার কথা এবং বিচার দিবসের প্রতি বিশ্বাস ও খোদায়ী শাস্তির ভয়ের কথা তুলে ধরার পরপরই এই প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণের ওপর জোর দেয়া হয়েছে।
-ভালো ও সৎ মানুষের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল আমানতদারী বা বিশ্বস্ততা ও চুক্তি বা অঙ্গীকার রক্ষার স্বভাব। আমানত রক্ষা করা বলতে কেবল বস্তুগত আমানত নয়, আধ্যাত্মিক ও খোদায়ি আমানত রক্ষা করাকেও বোঝায়। মহান আল্লাহর দেয়া নানা নেয়ামত হচ্ছে মানুষের কাছে তাঁরই আমানত। মানুষের কাছে মহান আল্লাহর সবচেয়ে বড় আমানত হল আল্লাহর মনোনীত একমাত্র ধর্ম তথা ইসলাম ও পবিত্র কুরআন। তাই এ দুয়ের সুরক্ষার জন্য সক্রিয় থাকা ঈমানের অন্যতম শর্ত।
-সুরা মাআরিজের ৩৩ ও ৩৪ নম্বর আয়াতে ভালো ও সৎ এবং যোগ্য মানুষের আরও দু'টি বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে বলা হয়েছে: এবং যারা তাদের সাক্ষ্যদানে সরল-নিষ্ঠাবান বা অবিচল এবং যারা তাদের নামাযে যত্নবান।–

ন্যায়ানুগ সাক্ষ্য দেয়া ও সত্যকে গোপন না করা মানব-সমাজে ন্যায়-বিচার প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রধান ভিত্তি। তাই পবিত্র কুরআন বিভিন্ন আয়াতে মুসলমানদেরকে সঠিক ও সত্য সাক্ষ্য দিতে বলেছে এবং সত্য গোপন করাকে গোনাহ বলে উল্লেখ করেছে।
ভালো ও সৎ এবং যোগ্য মানুষের আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য হল তারা নামাজের ব্যাপারে যত্নবান। অর্থাৎ তারা নামাজের নামাজের নানা দিক ও আদব-কায়দা পুরোপুরি মেনে চলেন। এসব আদব-কায়দার কারণে তারা যেমন পাপ থেকে দূরে থাকেন তেমনি নামাজেও মহান আল্লাহর সঙ্গে তাদের প্রেমময় মনোসংযোগও বজায় থাকে। এসব দিকের প্রতি তারা যত্নশীল থাকেন বলে নামাজ কবুল হওয়ার ক্ষেত্রে সম্ভাব্য বাধাগুলো দূর হয়ে যায়।
নামাজ মানুষ ও সমাজকে সুস্থ এবং পবিত্র রাখার সবচেয়ে বড় মাধ্যম। নামাজের প্রতি যত্নশীলতা বলতে নফল নামাজ ও নামাজের নফল বা সুন্নাতগুলোর প্রতি যত্নশীলতার বিষয়টিকেও বোঝায় বলে কোনো কোনো ইসলামী বর্ণনা রয়েছে।
সুরা মাআরিজের ৩৫ নম্বর আয়াতে আদর্শ মানুষের পুরস্কারের বিষয়ে বলা হয়েছে:
তারাই জান্নাতে সম্মানিত হবে।– অর্থাৎ সৎ ও ভালো মানুষ তথা মুমিনের যেসব বৈশিষ্ট্যের কথা এতক্ষণ সুরা মাআরিজে বলা হয়েছে সেসব অর্জনের সুফল বা পুরস্কার হল বেহেশত। আর সেখানে তারা চিরকাল ধরে থাকবেন।
সুরা মাআরিজের ৪০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন:
আমি শপথ করছি উদয়াচল ও অস্তাচলগুলোর পালনকর্তার,নিশ্চয়ই আমি সক্ষম!
-মহান আল্লাহর এ শপথ থেকে বোঝা যায় পশ্চিম ও পূর্বের সংখ্যা অনেক। সূর্যের অবস্থানের আলোকে বছরের প্রতি দিনেই রয়েছে পৃথক পূর্ব ও পৃথক পশ্চিম। সূর্য প্রতি দিনই এক নতুন অবস্থান থেকে উদয় হয় ও অস্ত যায়। তাই একটি বছরে মোট পূর্ব ও পশ্চিমের সংখ্যা ৩৬৫টি। ‘পূর্ব ও পশ্চিমগুলোর প্রভু’র শপথ নেয়ার তাৎপর্য সম্ভবত এটাই যে মহান আল্লাহ যখন সূর্যকে প্রতিদিনই নিখুঁত এক গাণিতিক হিসাবে নতুন অবস্থানে রাখতে পারছেন তাহলে তিনি মানুষের মৃত্যুর পর আবারও তাদেরকে জীবিত করতেও পারবেন। সূর্যের অবস্থান পরিবর্তনের এই গাণিতিক ব্যবস্থা এতই নিখুঁত যে কোটি কোটি বছর ধরে এই সুশৃঙ্খল ব্যবস্থার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।
সুরা মাআরিজের আগের আয়াতের আলোকে মৃত্যুর পর মানুষের পুনরায় উত্থান বা পুনর্জীবন ঘটার বিষয়ে অবিশ্বাসীদের উদ্দেশে সুরা মাআরিজের ৪১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন: নিশ্চয়ই আমি সক্ষম তাদের পরিবর্তে উৎকৃষ্টতর মানুষ সৃষ্টি করতে এবং এটা আমার সাধ্যের অতীত নয়।
মহান আল্লাহ যখন মানুষ সৃষ্টি করেছিলেন তখন তাঁর কাছে এমন জীবের কোনো অতীত দৃষ্টান্ত বা নক্শা ছিল না। তাই মানুষকে মৃত্যুর পর আবারও অবিকল আগের মত করে বা আগের চেয়েও সুন্দর ও সুঠামভাবে জীবনে ফিরিয়ে আনা মহান আল্লাহর জন্য কোনো কঠিন কাজ নয়, বরং তা করা সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পী আল্লাহর জন্য খুবই সহজ।#
পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আবু সাঈদ/ ১৭