আগস্ট ১১, ২০১৯ ১৮:৫৫ Asia/Dhaka

আশা করছি আপনারা প্রত্যেকে ভালো আছেন। গত আসরে আমরা বলেছি, ইমাম জাফর সাদেক (আ.) বনি উমাইয়া ও বনি আব্বাসের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব থেকে নিজেকে কার্যকরভাবে দূরে রাখতে পেরেছিলেন। একইসঙ্গে তিনি এসব শাসকগোষ্ঠীর জুলুম ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার বিশেষ করে শাসকদেরকে সহযোগিতা করার আহ্বান তিনি বার বার প্রত্যাখ্যান করেন।

ইমাম ও তাঁর অনুসারীদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে বনি আব্বাসীয় শাসক মানসুর গোয়েন্দা বাহিনীকে লেলিয়ে দেয় এবং এই বাহিনী ইমাম ও তাঁর শিয়াদের জীবনকে দুর্বিসহ করে তোলে। এ অবস্থায় ইমাম জাফর সাদেক (আ.) জালেম শাসকের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নয়া পন্থা অবলম্বন করেন। তিনি নিজের ঘনিষ্ঠজনদেরকে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে গোপনে তৎপরতা চালানোর আহ্বান জানান। শিয়া ফিকাহবিদগণ এই পন্থাকে ‘তাকিয়া’ নাম দিয়েছেন। তাকিয়া অর্থ হুমকির মোকাবিলায় আত্মরক্ষার্থে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক তৎপরতায় গোপনীয়তা অবলম্বন করা।

ঈমান রক্ষার বৃহত্তর স্বার্থে ক্ষণিকের জন্য বাস্তবতা গোপন করার এই পন্থার কথা পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে। সূরা আলে ইমরানের ২৮, সূরা নাহলের ১০৬ এবং সূরা মু’মিনের ২৮ নম্বর আয়াতে এ বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে। ইমাম জাফর সাদেক (আ.) এসব আয়াত থেকে শিক্ষা নিয়ে তাঁর অনুসারীদের কিছু দিক-নির্দেশনা দেন। তিনি তাঁর একজন শিয়াকে বলেন: তোমরা তোমাদের উন্নত নৈতিক চরিত্র প্রদর্শনের মাধ্যমে মানুষকে আমাদের দিকে আহ্বান জানাবে এবং কখনোই গোপন পরিকল্পনা প্রকাশ করবে না। ইমাম আরো বলেন: যে কেউ আমার কথা গোপন না রেখে প্রকাশ করে দেবে সে যেন আমার বিরুদ্ধে তরবারি হাতে নিল।

অবশ্য শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে গোপনীয়তা বজায় রাখা অত্যন্ত কঠিন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই ‘তাকিয়া’অবলম্বন করতে না পারার কারণে অত্যাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে বিপ্লব ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। কেবলমাত্র বিচক্ষণ মানুষের পক্ষেই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদিতে গোপনীয়তা রক্ষা করা সম্ভব হয়। ইমাম সাদেক (আ.) তাকিয়ার গুরুত্ব তুলে ধরতে গিয়ে আরো বলেন, যে ব্যক্তি আমার গোপন বিষয়গুলো প্রকাশ করে দিল সে আমাকে হত্যা করার চেয়েও মারাত্মক অপরাধ করল।

অবশ্য এখানে বলে রাখা ভালো যে, গোপনীয়তা বজায় রাখার অর্থ শত্রুর বিরুদ্ধে সংগ্রাম বন্ধ করে দেয়া নয় বরং বিপ্লবের বৃহত্তর লক্ষ্য অর্জনের স্বার্থে এটি একটি কৌশল। শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ইমাম জাফর সাদেক (আ.)’র পক্ষে প্রকাশ্যে রাজনৈতিক সভা-সমাবশে করা সম্ভব না হলেও তিনি এক মুহূর্তের জন্য সংগ্রাম বন্ধ রাখেননি। বারবার কৌশল পরিবর্তন করে তিনি বিপ্লবী তৎপরতা অব্যাহত রেখেছেন।

অবশ্য ইমাম যদি কখনো উপলব্ধি করতেন যে, সেই মুহূর্তে তাকিয়া করার প্রয়োজন নেই তখন তিনি তার যুগের বিপ্লবীদের প্রতি প্রকাশ্যে সমর্থন জানাতেন। এ সম্পর্কে তিনি নিজের একজন সহযোগীকে বলেন: যেসব অত্যাচারী শাসক আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনিত না হয়ে জোর করে ক্ষমতা দখল করেছে তাদেরকে সমর্থন দানকারী ব্যক্তিরা যত বড় খোদাভীরুতাই অর্জন করুক না কেন তারা দ্বীনের অন্তর্ভূক্ত নয়।  এরপর ইমাম সাদেক (আ.) সূরা বাকারার ২৫৭ নম্বর আয়াতের কথা উল্লেখ করে বলেন: যারা কুফরী করে এবং অত্যাচারী জালিম শাসকদের অভিভাবকত্ব মেনে নেয়; তারা তাদেরকে (ঈমানের) আলো থেকে বের করে (কুফর ও জুলুমের) অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়।

এ সময় ইমামকে প্রশ্ন করা হয়, এই আয়াতে কি কাফিরদের কথা বলা হয়নি? জবাবে ইমাম বলেন, কাফিররা আলোর মধ্যে নেই যে তাদেরকে কেউ অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাবে।  এখানে সেইসব মুসলমানের কথা বলা হয়েছে যারা জান ও মাল রক্ষা বা অর্জন করার লক্ষ্যে কাফির শাসকদের অভিভাবকত্ব মেনে নেয়। এদের পরিণতির কথা এই আয়াতের শেষাংশে এভাবে বলা হয়েছে- এরাই হলো দোযখের অধিবাসী, তারা চিরকাল সেখানেই থাকবে।

ইমাম সাদেক (আ.) তৎকালীন সমাজের গোটা পরিস্থিতি এবং অতীত ইমামদের দুঃখজনক ব্যর্থতা গভীরভাবে পর্যালোচনা করে একথা উপলব্ধি করেন যে, তাঁর মহান পিতা ইমাম বাকের (আ.) যে সাংস্কৃতিক বিপ্লব শুরু করেছিল তাকে একটা চূড়ান্ত পরিণতিতে পৌঁছানো দরকার। কিন্তু এজন্য যে লোকবল প্রয়োজন তা ইমামের ছিল না। তিনি এই ঘাটতি পর্যালোচনা করে দেখতে পান, গভীর রাজনৈতিক ও ধর্মীয় জ্ঞান না থাকার কারণে জনগণের মধ্যে বাতিলের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার ব্যাপারে এই উদাসিনতা দেখা যাচ্ছে। এই উপলব্ধি থেকে ইমাম জাফর সাদেক (আ.) ধর্মীয় কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন যেখান থেকে অনেক বড় বড় রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব বেরিয়ে আসেন।

ইতিহাসবিদরা ইমামের ছাত্র সংখ্যা কমপক্ষে চার হাজার  বলে বর্ণনা করেছেন। অর্থাৎ ইমাম সাদেক (আ.) সেই যুগে ওহী নাজিলের পূণ্যভূমি মদীনায় সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। প্রখ্যাত অনেক শিয়া আলেম যেমন এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জ্ঞান অর্জন করেছেন তেমনি হানাফি মাজহাবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম আবু হানিফাও দুই বছর ইমাম জাফর সাদেক (আ.)’র কাছে দ্বীনি শিক্ষা অর্জন করেন। তিনি ফিকাহ শাস্ত্রে নিজের জ্ঞানকে ওই দুই বছরের শিক্ষার কাছে ঋণী বলে মনে করতেন।

এভাবে দিন দিন ইমাম সাদেক (আ.)’র ধর্মীয় জ্ঞানের প্রভাব মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। জনগণের মধ্যে এত বেশি প্রভাব বিস্তার করা এর আগের কোনো ইমামের পক্ষে সম্ভব হয়নি। বিষয়টিকে স্বাভাবিকভাবেই শাসকগোষ্ঠী ভালোভাবে নিতে পারেনি। বনি আব্বাসের শাসকরা ইমামের বিরুদ্ধে নতুন করে যুদ্ধ শুরু করে।  তারা একদিকে ইউরোপীয় চিন্তাবিদদেরকে রাজদরবারে আশ্রয় দেয় এবং তাদের বইগুলো আরবি ভাষায় অনুবাদ করে ইসলামি চিন্তাধারায় ফাটল ধরায়। অন্যদিকে ইসলামের মধ্যে অনেক ফেরকা ও মাজহাব তৈরি করে মুসলমানদের ঐক্যের ভিত নড়বড়ে করে দেয়। পাশাপাশি ইসলামের রাজনৈতিক চেতনাকে নির্মূল করার লক্ষ্যে সুফিবাদী ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে মুসলমানদের মধ্যে উদাসীনতা ও অলসতার বীজ বপন করে আব্বাসীয় শাসকগোষ্ঠী। এ অবস্থায় এসব ভ্রান্ত কার্যকলাপ ও চিন্তাধারা প্রতিরোধ করার গুরুদায়িত্ব এসে ইমাম জাফর সাদেকের কাঁধে পৌঁছায়।

ইমাম পবিত্র কুরআন ও হাদিসের ওপর গভীর জ্ঞান ও বুৎপত্তিসম্পন্ন একদল ছাত্র তৈরি করেন এবং ইসলামে নতুন করে চালু হওয়া বিদআত ও ভ্রান্ত মতবাদের মোকাবিলায় খাঁটি ইসলামের স্বরূপ তুলে ধরার জন্য এসব ছাত্রকে মুসলিম বিশ্বের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে দেন।#

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ / ১১

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।