সুরা বুরুজের প্রাথমিক পরিচিতি ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা
সুরা বুরুজ পবিত্র কুরআনের ৮৫ তম সুরা। মহানবীর (সা) পক্ষ থেকে ইসলামের দাওয়াত শুরু হওয়ার প্রথম দিকে নাজেল হয়েছিল এ সুরা। মক্কি এ সুরায় রয়েছে ২২ আয়াত।
সুরা বুরুজের প্রথম আয়াতে আকাশের বুরুজ-এর শপথ নিয়েছেন মহান আল্লাহ। এখানে বুরুজ বা মিনারগুলো বলতে মহাকাশে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান ও চলার পথগুলোকে বা ১২ স্তরের আসমানি পর্যায় বা মিনারগুলোকে বোঝানো হয়েছে। আকাশের মিনারগুলো বা বুরুজ বলতে গ্রহ-নক্ষত্র, সৌরজগত ও ছায়াপথ শোভিত সমগ্র মহাকাশও হতে পারে বলে অনেকে মনে করেন। কোটি কোটি ছায়াপথ ও গ্রহ-নক্ষত্র-শোভিত মহাকাশ মহান আল্লাহর অশেষ ক্ষমতা, সুপরিকল্পনা ও নিয়ম-মাফিক সৃষ্টিশীলতা এবং সৃষ্টির ঐকতানের সাক্ষ্য বহন করছে।
যে কোনো মক্কি সুরার মত সুরা বুরুজেরও লক্ষ্য হল শত্রুদের মোকাবেলায় মু’মিনদের মনোবল চাঙ্গা করা এবং প্রতিরোধ চালিয়ে যেতে তাদেরকে উৎসাহ দেয়া।
আখদুদের অধিবাসীদের ঘটনা, কাফেরদের প্রতি হুঁশিয়ারি, আল্লাহর পথে প্রতিরোধ ও ধৈর্যে অবিচল মু’মিনদের প্রতি সুসংবাদ, ফেরাউন ও সামুদ জাতির কাহিনী, পবিত্র কুরআনের মহত্ত্ব ও এর অসাধারণ গুরুত্ব সুরা বুরুজের কয়েকটি আলোচ্য বিষয়।
সুরা বুরুজের চার নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, গর্তের অধিপতি নির্যাতকরা ধ্বংস হোক্ বা তারা ধ্বংস হয়েছে। - এখানে যুন-ওয়াস নামক রাজার ঘটনার দিকে ইশারা করা হয়েছে। সে ছিল ইয়েমেনের বিখ্যাত হুমাইর গোত্রের শেষ রাজা। যুন-ওয়াস ইহুদি ধর্ম গ্রহণ করে এবং হুমাইর গোত্রের একদল মানুষ তাকে অনুসরণ করত। যুন-ওয়াস জানতে পারে যে নাজরান অঞ্চলের একদল মানুষ এখনও খ্রিস্ট ধর্ম মেনে চলে। যুন-ওয়াস নাজরানে গিয়ে সেখানকার অধিবাসীদের জড় করো তাদেরকে ইহুদি ধর্ম গ্রহণ করতে বলে। অনেক পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও নাজরানবাসী জানায় যে ইহুদি হওয়ার চাইতে তারা বরং শহীদ হতে প্রস্তুত। যুন-ওয়াসের নির্দেশে এক বিশাল গর্ত তৈরি করে তা জ্বালানি কাঠ দিয়ে ভরা ভরে নাজরানী খ্রিস্টানদের একদলকে সেখানে ফেলে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়। অন্য এক দলকে তরবারি দিয়ে কেটে টুকরো টুকরো করা হয়। নিহতদের মোট সংখ্যা ছিল ২০ হাজার।

নাজরানের খ্রিস্টানদের যুন-ওয়াসের গণহত্যার হাত থেকে পালিয়ে রোম সম্রাটের সাহায্য চায়। রোমান সম্রাট জানান আবিসিনিয়ার বাদশাহ নাজ্জাশির কাছে চিঠি দিয়ে নাজরানের খ্রিস্টানদের সাহায্য করার অনুরোধ জানান। নাজ্জাশি ছিলেন খ্রিস্টান। তিনি কাছাকাছি অঞ্চলের শাসক হওয়ায় ইয়েমেনে অভিযান চালানো তার জন্য ছিল সহজ। নাজ্জাশি শহীদদের রক্তের বদলা নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং সেনা নিয়ে ইয়েমেনে যান। এক কঠিন যুদ্ধে যুন-ওয়াসের বাহিনী নাজ্জাশির বাহিনীর কাছে হেরে যায়।
তবে অন্য এক বর্ণনায় জানা যায়, এক হাবশি বা আবিসিনিয় নিগ্রোকে হাবশিদের জন্য নবী নিযুক্ত করা হয়েছিল। যুন ওয়াস ছিল তাদের এক রাজা। সে প্রজাদের দিয়ে তার ও মূর্তির উপাসনা করাত। নবী যথাসাধ্য তাদের সতর্ক করেন, কিন্তু অল্প ক'জন ছাড়া কেউ ঈমান আনেনি। পরিশেষে রাজার বাহিনীর হামলায় নবীর বহু সাহাবী শহীদ হন। আর অনেক সাহাবি হন বন্দি। তাঁদের জন্য ৪০ গজ লম্বা ও ১২ গজ চওড়া পরিখা বা গর্ত খনন করে তা আগুনে পূর্ণ করা হয়।
এরপর ঘোষণা করা হল, যেসব আবিসিনিয় মূর্তি ও রাজা যুন-ওয়াসকে পূজার ধর্মমতে বিশ্বাসী তারা আলাদা হয়ে যাক। আর যারা নবীর ধর্মমতে বিশ্বাসী তারা ঐ পরিখায় লাফিয়ে পড়ুক! মুমিনরা সানন্দে পরস্পরের হাত ধরাধরি করে তাতে লাফিয়ে পড়ছিলেন। যখন এক নারীর পালা এল যার কোলে তার এক মাসের শিশু ছিল, তিনি দ্বিধান্বিত হলেন, কিন্তু শিশুটি আল্লাহর মহিমায় বলে উঠল, ‘আম্মা! তুমি ভয় পেয়ো না, আমাকে নিয়েই লাফিয়ে পড়।’ বস্তুত তিনিও তাতে পড়লেন। এদিকে আল্লাহ পরিখার ওপর বাতাস বইয়ে দিলেন যা পুরো পরিখার আগুনকে উড়িয়ে নিয়ে রাজা ও তার বাহিনীর ওপর নেমে আসে। এভাবে আল্লাহ ওই জালিমদের পুড়িয়ে মারলেন। অথচ মুমিনদের কিছুই হল না, তাঁরা সবাই আগুনহীন পরিখা হতে অক্ষত অবস্থায় বের হয়ে আসলেন।
মহান আল্লাহর দয়া, ক্রোধ ও ইচ্ছা এবং ক্ষমতা যে সর্বোচ্চ ও চূড়ান্ত পর্যায়ের তা সুরা বুরুজে স্পষ্ট করা হয়েছে। একমাত্র আল্লাহই যে উপাস্য হওয়ার যোগ্য তা এতে ফুটে উঠেছে। এ সুসংবাদও এ সুরায় দেয়া হয়েছে যে মহান আল্লাহ উপস্থিত রয়েছেন সবখানে এবং তিনি সবই দেখছেন। তিনি মু’মিনদের ধৈর্য ও প্রতিরোধও দেখে থাকেন। অন্যদিকে মহান আল্লাহর ক্ষমতা কাফেরদের জন্য সতর্কবাণী। আল্লাহ কিছুকাল পর্যন্ত কাফেরদের কাজে বাধা দেননি বলে তার মানে এ নয় যে তিনি ওই সময় পর্যন্ত দুর্বল ছিলেন! বরং তিনি মু’মিনদের পরীক্ষার জন্যই তা করে থাকেন। মহান আল্লাহর ক্ষমতাই সর্বত্র বিজয়ী ও কাফেরদের পরিণতি হল যন্ত্রণাদায়ক ধ্বংসাত্মক শাস্তি ঠিক যেভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে ফেরাউন ও তার সহযোগীরা এবং ধ্বংস হয়ে গেছে সামুদ জাতি।
সুরা বুরুজের ২১ নম্বর আয়াতে পবিত্র কুরআনের মহত্ত্ব আর সত্যতা তুলে ধরে বলা হয়েছে, কুরআনকে অসত্য, কবিতা, জাদু ও ভাগ্য-গণনাকারী বলে অপবাদ দেয়া অর্থহীন। সুরা বুরুজের শেষ দুই আয়াতে পবিত্র কুরআনের মহা-মর্যাদা তুলে ধরা হয়েছে। এর বিষয়বস্তু ব্যাপক। আইন, শিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, বিশ্বাস, নৈতিকতা, উপদেশ, প্রথা ও ইতিহাসসহ বহু কল্যাণময় ও জরুরি বিষয় রয়েছে এই মহাগ্রন্থে। আলকুরআনে নেই কোনো ভুল, অসত্য, বিচ্যুতি, অতিরঞ্জন ও অপূর্ণতা। এখানে মহানবী (সা)কে সান্ত্বনা দিয়ে মহান আল্লাহ বলছেন, আপনাকে কবি, জাদুকর, পাগল ও গনক ইত্যাদি বলে যেসব অপবাদ দেয়া হচ্ছে তাতে আপনি দুঃখ পাবেন না; আপনার আশ্রয়স্থল সুদৃঢ়, সুস্পষ্ট, সহজ এবং আপনার মদদদাতা হচ্ছেন মহামহিম ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ।#
পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আবু সাঈদ/ ২৯
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।