নভেম্বর ০৩, ২০১৯ ২১:৫০ Asia/Dhaka

আমরা গত আসরে বলেছি, ইমাম রেজা (আ.)’র শাহাদাতের আগে থেকেই ‘ওয়াকিফিয়াহ’ নামের একটি গোষ্ঠীর উৎপত্তি হয় যারা ইমামকে দেয়া জনগণের খোমস ও যাকাতের বিশাল অর্থ-সম্পদ আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যে ইমাম রেজা (আ.)’র ইমামতকেই বেমালুম অস্বীকার করে বসে।

তারা তাদের ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে ইমামতের ধারাবাহিকতাকে বন্ধ করে দেয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়। এই গোষ্ঠীর লোকজন তাদের ওই ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে যখন দেখতে পায় ইমাম রেজা (আ.)’র বয়স ৪০ পেরিয়ে যাওয়ার পরও তার কোনো সন্তান হচ্ছে না তখন তারা জনগণের মাঝে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করে। বিষয়টি তখনকার সমাজের বেশিরভাগ শিয়া মুসলমানের জন্য ছিল উদ্বেগজনক। কারণ, তারা জানত ইমামতের ধারাবাহিকতা রক্ষা করার জন্য ইমাম রেজা (আ.)’র অবশ্যই একজন পুত্রসন্তান থাকবে।

শেষ পর্যন্ত হিজরি ১৯৫ সালের ১০ রজব মহান আল্লাহর ইচ্ছায় ইমাম রেজার ঘর আলো করে মোহাম্মাদ নামক একজন পুত্রসন্তান জন্মলাভ করেন। ইমামের সন্তানলাভের ঘটনায় শিয়া সমাজে আনন্দ ও খুশির বন্যা বয়ে যায়। কারণ, ইমামতের ধারাবাহিকতা রক্ষা হবে কিনা তা নিয়ে যারা সংশয় সৃষ্টি করেছিল এই সন্তান জন্মলাভের কারণে তাদের সে চক্রান্ত নস্যাৎ হয়ে যায়। এ সম্পর্কে ইমাম রেজা (আ.)’র বোন হাকিমা বলেন, হযরত জাওয়াদ (আ.)’র জন্মের সময় আমার ভাই রেজা আমাকে তাঁর স্ত্রীর দেকভাল করার অনুরোধ জানান। ইমাম জাওয়াদের জন্মের আগে থেকেই আমি প্রসূতির ঘরে অবস্থান করছিলাম।

তিনি আরো বলেন, জন্মের তিনদিনের মাথায় আমাকে অবাক করে দিয়ে ইমাম জাওয়াদ কালিমায়ে শাহাদাত পাঠ করেন এবং বলেন, “আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ অআশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহ।” অর্থাৎ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই এবং আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, হযরত মুহাম্মদ ( সা.) আল্লাহর বান্দা ও রাসুল। আমি নবজাতকের মুখে কালিমার বাণী শুনে হন্তদন্ত হয়ে আমার ভাই ইমাম রেজা (আ.)’র কাছে ছুটে যাই। সব শুনে ইমাম বলেন, হাকিমা! তুমি এর পরে এ ধরনের আরো বিস্ময়কর ঘটনা প্রত্যক্ষ করবে।

পূর্ববর্তী ইমামদের যুগে জাইদিয়া, ইসমাইলিয়া এবং ওয়াকিফিয়া নামক কিছু আলাদা ফেরকা বা উপদল সৃষ্টি হলেও ইমাম জাওয়াদ (আ.)’র যুগে নতুন করে কোনো উপদল সৃষ্টি হয়নি। ভ্রান্ত ওয়াকিফিয়া মতবাদে বিশ্বাসীরা সপ্তম ইমামের মাধ্যমে ইমামের ধারা শেষ হয়ে গেছে বলে যে অপপ্রচার শুরু করেছিল ইমাম জাওয়াদ (আ.) কার্যকরভাবে তা প্রতিহত করতে সক্ষম হন। তিনি এক ভাষণে বলেন: আমার পরে ইমাম হচ্ছেন আলীর সন্তান। তাঁর নির্দেশকে আমার নির্দেশ মনে করবে এবং তাঁর বক্তব্যকে আমার বক্তব্য বলে ধরে নেবে।”

এরপর তিনি ইমাম হাসান আসকারি সম্পর্কেও একই কথা বলেন। তখন সমবেত লোকজন ইমামকে জিজ্ঞাসা করেন, হে রাসূলের সন্তান! হাসানের পর ইমাম কে হবেন? এ প্রশ্ন শুনে ইমাম জাওয়াদ (আ.) কেঁদে ফেলেন। এরপর বলেন, হাসানের পর তাঁর সন্তান মাহদি হবেন ইমাম। মানুষ যখন তাঁকে ভুলে গিয়ে বিপথগামী হয়ে যাবে তখন তিনি বিপ্লব করবেন। শেষ জামানায় সবাই তার আবির্ভাবের অপেক্ষায় থাকবে। কেউ যদি তাঁর আবির্ভাবের সময় নির্ধারণ করে দিতে চায় তবে সে মিথ্যাবাদী কারণ, যখন আল্লাহ তায়ালা ইচ্ছা করবেন তখনই তিনি আবির্ভূত হবেন। তার আগমনের জন্য তাড়াহুড়া করা যাবে না বরং আল্লাহর ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পন করতে হবে।

এত কিছু বলার পরেও ইমাম রেজা (আ.)’র শাহাদাতের পর নবম ইমাম জাওয়াদ (আ.) যখন আট বছর বয়সে ইমামতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন ইমামের বিরোধীপক্ষ ও অজুহাত অন্বেষণকারীরা এই বলে তা মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায় যে, মাত্র আট বছর বয়সী শিশুর ইমামতের মহান দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়। যারা এসব বলতে থাকে তাদের হয় কুরআনের শিক্ষা সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না অথবা তারা ছিল জ্ঞানপাপী। কারণ, পবিত্র কুরআনে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, হযরত ঈসা (আ.) জন্মের পরপরই আল্লাহর ইচ্ছায় কথা বলেছিলেন এবং নিজের মা বিবি মরিয়ম সালামুল্লাহি আলাইহার পবিত্রতা ঘোষণা করেছিলেন। সূরা মরিয়মের ৩০ ও ৩১ নম্বর আয়াতে এ ঘটনা বর্ণিত হয়েছে।

পবিত্র কুরআন থেকে এ ধরনের দ্বিতীয় যে উদাহরণটি দেয়া যায় তা হচ্ছে, আল্লাহ তায়ালা হযরত ইয়াহিয়া (আ.)’র জন্মের আগেই তাঁর পিতা হযরত জাকারিয়া (আ.)কে এই সন্তানের সুসংবাদ দিয়েছিলেন এবং তার নামটি পর্যন্ত বলে দিয়েছিলেন। এমনকি সূরা মরিয়মের ১২ নম্বর আয়াত অনুযায়ী, মহান আল্লাহ হযরত ইয়াহিয়াকে শৈশবেই নবুওয়াত দান করেছিলেন।

এসব আয়াত থেকে একথা প্রতীয়মান হয় যে, নবুওয়াত ও ইমামত আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে নির্ধারিত হয় এবং অন্য কারো এখানে কোনো হাত থাকে না। কিন্তু কিছু বিভ্রান্ত মানুষ এই সত্য বেমালুম অস্বীকার করে বসে।

এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, শুধু ইমাম জাওয়াদ (আ.) নন বরং তাঁর সন্তান ইমাম হাদি (আ.)ও মাত্র আট বছর বয়সে ইমামতের গুরুদায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। এমনকি ইমাম মাহদি (আ.) তাঁর পিতা হযরত হাসান আসকারি (আ.)’র শাহাদাতের পর মাত্র পাঁচ বছর বয়সে ইমাম হন। শিয়া মুসলমানরা বিশ্বাস করেন, ইমামত ও খেলাফত নির্ধারিত হয় একমাত্র আল্লাহর পক্ষ থেকে এবং তিনি সর্বজ্ঞানী হিসেবে ভালো জানেন এ দায়িত্ব কখন কাকে দিতে হবে। সূরা আনআমের ১২৪ নম্বর আয়াতের একাংশে বলা হচ্ছে, আল্লাহ এ বিষয়ে সুপারিজ্ঞাত যে, কোথায় স্বীয় পয়গাম প্রেরণ করতে হবে।

প্রকৃতপক্ষে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)’র ওফাতের পর যদি ইমামগণ মুসলিম সমাজের নেতৃত্বের দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারতেন তাহলে তারা জুলুমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেন এবং সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন। সেক্ষেত্রে বর্তমান সমাজে বিদ্যমান শিরক, কুফর, ঝগড়া, হানাহানি, যুদ্ধ, অন্যায়, অবিচার এগুলোর লেশমাত্র থাকত না। মূলত ইমামতকে অস্বীকার বা উপেক্ষা করার কারণেই মানব সমাজ আজ এই দুরবস্থার মধ্যে পতিত হয়েছে।#

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ / ০৩

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ