ইরানি পণ্য সামগ্রী: ইরানি আখরোট এবং এর গুণ
ইরানের জলে-স্থলে, ক্ষেত-খামারে, বাগ-বাগিচায়, কল-কারখানায় উৎপাদিত হয় বিচিত্র সামগ্রী।
এর পাশাপাশি খনি থেকে উৎপন্ন বিভিন্ন সামগ্রী এবং ইরানি নরনারীদের মেধা ও মনন খাটিয়ে তৈরি করা হয় বিভিন্ন শিল্পপণ্য। আলোচনা করেছিলাম ইরানের তেল-বহির্ভুত রপ্তানি পণ্য বাদাম নিয়ে। বলেছিলাম যে, শুষ্ক ফলের মধ্যে অন্যতম রপ্তানি পণ্য হলো বাদাম। বাদামের পুষ্টিগুণ এবং ওষুধি গুণ নিয়েও আলোচনা করার চেষ্টা করেছি।
আজকের আসরে আমরা আলোচনা করার চেষ্টা করবো আখরোটের অর্থনৈতিক মূল্য এবং এর নিরাময়ের গুণ নিয়ে। আখরোটকে ইংরেজিতে ওয়ালনাট বলে। এই আখরোটের অর্থনৈতিক মূল্য অনেক বেশি। আখরোটের মতো আখরোট গাছেরও বিচিত্র ওষুধি গুণ রয়েছে। আখরোট গাছের পাতা, ছাল-বাকল ও ফল, আখরোট গাছের শেকড়, ডাল ও বৃন্ত ইত্যাদি সবকিছুই খাদ্যপণ্যের বিচিত্র শিল্পে এমনকি ফার্নিচারের কাজে, ওষুধ শিল্পে ব্যবহৃত হয়। গবেষকরা বলছেন,দুঃচিন্তা কমাতে শরীরকে সাহায্য করে আখরোট। কেননা এতে থাকে ‘পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট’ যা দুচিন্তাগ্রস্ত অবস্থায় রক্তচাপ কমাতে সহায়তা করে। আরও দেখা যায়, ‘অ্যাভারেজ ডায়াস্টলিক ব্লাড প্রেশার’ কমাতেও আখরোট অত্যন্ত উপকারী।

আখরোট গাছের ইতিহাস বিশেষ করে এ গাছের জন্ম কখন কোথায় হয়েছিল তা সুস্পষ্ট নয়। কেউ কেউ মনে করেন আখরোটের জন্ম মানব জন্মেরও আগে হয়েছিল। বিভিন্ন লেখা বা প্রাচীন তথ্যপঞ্জি থেকে বোঝা যায় আখরোট গাছ খ্রিষ্টপূর্ব শত শত বছর আগে লাগানো হয়েছিল। এশিয়া মাইনর, পশ্চিম এশিয়া, হিমালয়ের পাদদেশ এবং চীনের বিভিন্ন এলাকাকে আখরোট গাছের প্রাথমিক জন্মভূমি বলে ইতিহাসে পাওয়া যায়। আখরোট গাছ সাধারণ গাছের মতোই। তবে এর উচ্চতায় তারতম্যের কথা বলা হয়েছে। বিভিন্ন তথ্য-উৎসে আখরোট গাছের উচ্চতা দশ থেকে চল্লিশ মিটার বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আখরোট গাছের রঙ বেশ সুন্দর। গাছ এবং গাছের শাখাগুলো অনেকটা রূপালি সাদা রঙের। আবার কোনো কোনো জাতের আখরোট গাছ ধূসর রঙেরও হয়। আখরোট গাছের পাতা বেশ সুগন্ধিপূর্ণ। এর ফুলগুলোও বেশ সুন্দর। গোলাপি রঙের এবং আলাদা আলাদা।
আখরোট একপ্রকার বাদাম জাতীয় ফল। এই ফল অত্যন্ত পুষ্টিকর যাতে প্রচুর আমিষ এবং অত্যাবশ্যকীয় ফ্যাটি আসিড আছে। এই ফলটি গোলাকার এবং ভেতরে একটি বীজ থাকে। পাকা ফলের বাইরের খোসা ফেলে দিলে ভেতরের শক্ত খোলসযুক্ত বীজটি পাওয়া যায়। এই খোলসের ভেতরে থাকে দুইভাগে বিভক্ত বাদাম যাতে বাদামি রঙের আবরণ থাকে। এটি এন্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ। এই এন্টিঅক্সিডেন্ট তৈলাক্ত বীজকে বাতাসের অক্সিজেন থেকে রক্ষা করে, ফলে তা খাওয়ার উপযোগী থাকে। আখরোট গাছ গ্রীষ্মের প্রচণ্ড তাপ যেমন সহজেই সহ্য করে তেমনি প্রচণ্ড শীতেও তার বেড়ে ওঠায় কোনো সমস্যা হয় না। একটি আখরোট গাছ ফল দিতে বেশ লম্বা সময় নেয়। তিন থেকে বিশ বছর পর্যন্ত সময় নেয় জায়গা ও আবহাওয়াভেদে। তবে পঞ্চাশ কিংবা ষাট বছর বয়সে সবচেয়ে বেশি ফল দেয় আখরোট গাছ। আখরোটের রঙ সবুজ থেকে বাদামি হতে হতে খয়েরি রং ধারণ করলে বুঝতে হবে আখরোট পুরোপুরি পেকে গেছে। এ সময় আখরোট গাছ থেকে না পাড়লে শাস যেমন নষ্ট হয়ে যেতে পারে তেমনি গাছও রোগাক্রান্ত হয়ে পড়তে পারে।
আখরোট গাছ অর্থনৈতিক দিক থেকেও খুবই মূল্যবান একটি গাছ। এই গাছের বিভিন্ন অংশ যেমন পাতা, ছাল, ফল, শেকড়, বৃন্ত, কাণ্ড ইত্যাদি বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়। খাবারে কাজে লাগে, ফার্নিচার তৈরিতে কাজে লাগে, ওষুধ তৈরিতেও ব্যবহার করা হয়। আখরোট এমন একটি ফল যে ফলটি কাঁচা এবং শুকনো-দুই অবস্থায়ই ব্যবহার করা হয়। শারীরিক সুস্থতা এবং সুষম খাবার বলতে যা বোঝায় আখরোট সেরকম খাবারের নিশ্চয়তা দেয়। আখরোটের শাস যেমন খুব সুস্বাদু তেমনি এর তেলও যথেষ্ট উপাদেয়। আখরোটের শাসে রয়েছে প্রচুর প্রোটিন, সুগার, পানি, ভিটামিন, খনিজ উপাদান এবং ফ্যাটি উপাদান। আখরোটে রয়েছে স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধিকারী উপাদান। পারকিনসন্স এবং অ্যালজাইমার রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কমে যায় আখরোট খেলে। আখরোটে রয়েছে ওমেগা-থ্রি। গবেষণায় দেখা গেছে ওমেগা-থ্রি মাইগ্রেন, স্ট্রেস, মানসিক অবসাদ, বিষন্নতার মতো সমস্যা নিরসনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
আখরোটের ফ্যাট মানুষের হার্টের সুস্থতার জন্য খুবই কার্যকরী। আমাদের শরীরে দুই ধরনের চর্বি বা কোলেস্টেরল থাকে। একটিকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয় এলডিএল কোলেস্টেরল । এলডিএল মানে হলো লো ডেনসিটি লাইপো প্রোটিন। এলডিএল ধমনির দেয়ালে ক্ষতিকর প্লাক তৈরি করে,তাই একে খারাপ কোলেস্টেরল বলা হয়। আরেক প্রকারের কোলেস্টেরল হলো এইচডিএল বা হাইডেনসিটি লাইপো প্রোটিন। এইচডিএল ধমনির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার সময় এলডিএল কোলেস্টেরলকে সরিয়ে দিতে সাহায্য করে। এতে হৃদরোগের ঝুঁকি কমে। এ জন্য এটিকে ‘ভালো কোলেস্টেরল’বলে। শরীরে বাজে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেড়ে গেলে উচ্চ রক্তচাপ,হৃৎপিণ্ডের নানা ধরনের অসুখ,হার্ট অ্যাটাক ইত্যাদি সমস্যা হয়। আখরোট খেলে ভালো কোলেস্টেরল বৃদ্ধি পায় এবং খারাপ কোলেস্টেরল কমে যায়। এর ফলে এলডিএলের ফলে সৃষ্ট রোগ-ব্যাধি থেকে মুক্তি পাবার সুযোগ তৈরি হয়।
আখরোট খেলে ফুসফুসের বিচিত্র রোগ-ব্যাধি যেমন ফুসফুসে বায়ু চলাচল বাধাগ্রস্ত হওয়া, শ্বাস- প্রশ্বাসে সমস্যার সৃষ্টি হওয়া, অ্যাজমা ইত্যাদি রোগ-ব্যাধির উপশম হয়। কিডনি কিংবা পিত্তথলিতে পাথর হওয়া, হার্ট অ্যাটাক থেকেও রক্ষা করে আখরোট। বলা হয়ে থাকে ডুমুর এবং কলার সঙ্গে আখরোট খেলে ইন্দ্রিয়শক্তি এবং মস্তিষ্কশক্তিও বৃদ্ধি পায়। শরীরে আয়রন বৃদ্ধিতে সহযোগিতা করে আখরোট। আখরোটে ফসফরাসের মজুদও রয়েছে বেশ। মাছ, চাউল কিংবা ডিমে যে পরিমাণ ফসফরাস রয়েছে আখরোটেও প্রায় সম পরিমাণ ফসফরাস রয়েছে বলে মনে করা হয়।#
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/ মো:আবু সাঈদ/ ০১
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।