ফেব্রুয়ারি ০৪, ২০২০ ১৮:১৯ Asia/Dhaka

সুরা ফিল পবিত্র কুরআনের ১০৫তম সুরা। মক্কায় অবতীর্ণ এ সুরায় রয়েছে ৫ আয়াত। ফিল শব্দের অর্থ হাতি। ইয়েমেনের বাদশাহ আবরাহার বিশাল হস্তি-বাহিনী ধ্বংসের বিবরণই এ সুরার আলোচ্য বিষয়।

প্রথমেই এ সুরার অনুবাদ শোনা যাক। অসীম দয়াময় ও অনন্ত করুণাময় আল্লাহর নামে:

(১) তুমি কি প্রত্যক্ষ করনি তোমার প্রতিপালক হস্তিবাহিনীর (২) সাথে কী আচরণ করেছিলেন? (২) তিনি কি তাদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেননি? (৩) তিনি তাদের ওপর পাঠিয়েছেন ঝাঁকে ঝাঁকে আবাবীল পাখি, (৪) যারা তাদের ওপর কঙ্কর নিক্ষেপ করে। (৫) অতঃপর তিনি তাদের চর্বিত তৃণ-সদৃশ করে ধ্বংস করেন।

হযরত আবদুল মুত্তালিবের যুগে ইয়েমেনের বাদশাহ আবরাহা পবিত্র কাবা ঘরের প্রতি মানুষের আকর্ষণ লক্ষ্য করে হিংসায় বিভোর হয়ে কাবাঘর ধ্বংসের সিদ্ধান্ত নেয়।  হস্তি-সওয়ার বাহিনীসহ এক বিশাল সেনাদল নিয়ে সে যখন কাবার কাছে পৌঁছে তখন আল্লাহ তাদের ওপর  আবাবিল পাখির ঝাঁক পাঠান। ওই পাখিগুলো উড়ন্ত অবস্থায় ঠোঁট ও ডানা থেকে আবরাহার বাহিনীর ওপর ছোট ছোট কঙ্কর ছুঁড়লে ওই সেনাদল দলিত মথিত হয়ে ধ্বংস হয়ে যায়। এভাবে কাবা-ঘর ধ্বংসের হাত থেকে সুরক্ষিত থাকে।

ইতিহাসে এসেছে: ইয়েমেনের শাসক জুনাওয়াস নাজরানের খ্রিস্টানদের ওপর নৃশংস নির্যাতন করতেন যাতে তারা খ্রিস্ট ধর্ম ত্যাগ করে। সেখানকার একজন খ্রিস্টান নির্যাতনের মুখে প্রাণ বাঁচিয়ে পালিয়ে গিয়ে রোমে এসে সেখানকার তৎকালীন সম্রাটের কাছে ঘটনা তুলে ধরে। রোমের খ্রিস্টান সম্রাট আবিসিনিয়ার রাজা নাজ্জাশির কাছে এক চিঠি পাঠিয়ে নির্যাতনের প্রতিশোধ নেয়ার নির্দেশ দেন। নাজ্জাশি ৭০ হাজার সেনার এক বিশাল বাহিনী ইয়েমেনে পাঠান আরিয়াত নামক এক সেনাপতির নেতৃত্বে। আবরাহাও ছিল এই বাহিনীর অন্যতম সেনা-কমান্ডার। যুদ্ধে জুনাওয়াস হেরে যায় এবং আরিয়াত হন ইয়েমেনের শাসক। কিছুকাল পর আবরাহা সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে আরিয়াতকে হত্যা করে নিজেই ইয়েমেনের শাসক হয়। এ খবর নাজ্জাশির কাছে গেলে তিনি আবরাহাকে দমনের সিদ্ধান্ত নেন। এ খবর পেয়ে আবরাহা দ্রুত আনুগত্য স্বীকার করে এবং নাজ্জাশিও তাকে ক্ষমা করে ওই পদে বহাল রাখেন। এ অবস্থায় আবরাহা নিজেকে খ্রিস্ট ধর্মের মহান খাদেম বা সেবক হিসেবে তুলে ধরার জন্য ইয়েমেনে অসাধারণ সুন্দর ও বড় ধরনের একটি গির্জা নির্মাণ করে।

আবরাহা কাবা ঘরের দিকে না গিয়ে এই গির্জায় এসে ইবাদত বা উপাসনা করতে আরবদের প্রতি আহ্বান জানানোর সিদ্ধান্ত নেয় এবং এ গির্জাকেই হজের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে চায় যাতে জনগণ এখানে এসে এই গির্জার চারদিকেই প্রদক্ষিণ করে। এই লক্ষ্যে আবরাহা আরব দেশে অনেক প্রচারক পাঠায়। কিন্তু এত প্রচার ও প্রচারণা সত্ত্বেও আরবরা এই গির্জার প্রতি আকৃষ্ট হয়নি এবং কাবা ঘরকেও ত্যাগ করেনি। এ অবস্থায় আবরাহা কাবা ঘর ধ্বংসের সিদ্ধান্ত নেয়। আর এই অনেক সেনা হাতিতে চড়ে অগ্রসর হয় এবং মক্কার কাছে পৌঁছার পর ওই সেনারা মক্কার জনগণের সম্পদ ও উট লুট করতে থাকে। তারা মহানবীর (সা) দাদা আবদুল মোত্তালেবের দুইশ উট কেড়ে নেয়। আবরাহা মক্কার শীর্ষ ও সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তির সঙ্গে মক্কা দখলের অভিযান  ও কাবা ঘরের ওপর সম্ভাব্য হামলার প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে কথা বলতে আগ্রহী হয়। লোকজন মহানবীর (সা) দাদা আবদুল মোত্তালেবের দিকে ইঙ্গিত করলে আবরাহার প্রতিনিধি তাঁকে ডেকে আনে। আবদুল মোত্তালেবের চেহারায় ব্যক্তিত্বের ছাপ দেখে আবরাহা দাঁড়িয়ে নম্রভাবে বলে: আপনার কি কিছু চাওয়ার আছে?

আবরাহার এই প্রশ্নের উত্তরে আবদুল মোত্তালিব বললেন, আমার ২০০ উট আপনার সেনারা নিয়ে গেছে। এগুলোকে ফেরত দেয়ার নির্দেশ দিন। আবরাহা বলে উঠল: আপনাকে দেখে তো আমার মনে বেশ শ্রদ্ধার উদ্রেক হয়েছিল, কিন্তু আপনার এ কথা শুনে তো আপনার সম্পর্কে আমার ধারণা বদলে গেল। আমি যখন আপনার ও আপনার বাপদাদার ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত কাবা ঘর ধ্বংস করতে এসেছি তখন আপনি কেবল নিজের দুই'শ উটের কথা বলছেন!? জবাবে আবদুল মোত্তালেব বললেন, 'আমি কেবল আমার উটগুলোর মালিক। আর এই ঘরেরও মালিক রয়েছে তিনি নিজেই তা রক্ষা করবেন।'  - এ কথা শুনে আবরাহা কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়ে। আবদুল মোত্তালেব মক্কায় ফিরে এসে সেখানকার লোকজনকে আশপাশের পাহাড়ে আশ্রয় নিতে বললেন এবং তিনি নিজে কাবা ঘরের পাশে এসে আল্লাহর সহায়তা চান।  

হাতিতে বসা আবরাহার নেতৃত্বাধীন বিশাল সেনাদল যখন কাবাঘরকে ধ্বংস করে দিতে চারদিক থেকে ছুটে আসছিল তখনই সাগরের দিক থেকে এসে হাজির হয় ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি। তাদের সবার সঙ্গে ছিল তিনটি করে ছোট্ট ঢিল বা কঙ্কর। আবরাহার বাহিনীর ওপর এসব ঢিল ছোঁড়া হয় বৃষ্টির মত। ফলে ওই বাহিনী চর্বিত খড়ের মত জমিনে কূপোকাত হয়। আবরাহা নিজেও এসব খোদায়ি ঢিলের আঘাতে আহত হয় এবং ইয়েমেনে পালিয়ে যায়। ইয়েমেনেই সে মারা যায়।

এই গুরুত্বপূর্ণ ও শিক্ষণীয় ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটেছিল খ্রিস্টিয় ৫৭০ সনে। প্রসিদ্ধ বর্ণনা অনুযায়ী এ বছরই জন্ম গ্রহণ করেন ত্রিভূবনের প্রিয় মহানবী (সা)। ওই বছরটিকে আরব দেশে বলা হত হস্তি-বছর বা আমুল ফিল।

জালিম ও খোদাদ্রোহী শক্তিগুলো যত বড় অস্ত্র-শক্তি আর লোকবলের অধিকারীই হোক না কেন মহান আল্লাহর অশেষ শক্তির কাছে তারা যে অসহায় ও অক্ষম এবং খোদাদ্রোহিতা ও খোদার বিরুদ্ধে যুদ্ধের পরিণামে নির্মূল হয়ে যেতে হবে- এই সতর্ক-বার্তা তুলে ধরে সুরা ফিল। সে যুগের সবচেয়ে বড় ও ভয়ানক সামরিক যান ছিল হাতি। অথচ ছোট্ট পাখি ও ঢিল দিয়েই মহান আল্লাহ হাতি-সজ্জিত ক্ষমতা মদমত্ত ওই খোদাদ্রোহী শক্তিকে নির্মূল করেছেন!#

পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আবু সাঈদ/০৪

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ