এপ্রিল ১৯, ২০২০ ২১:০২ Asia/Dhaka

স্বাস্থ্যগত বিষয়ের চেয়ে করোনার প্রভাব অর্থনীতিতে বেশি পড়বে। সারাবিশ্বে অর্থনীতিতে এখন একটা মন্দার আভাস বোঝা যাচ্ছে। এটা অশনিসংকেত। রেডিও তেহরানকে দেয়া সাক্ষাৎকারে একথা বলেছেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক, বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের প্রাক্তন চেয়ারম্যান এবং বর্তমানে বাংলাদেশ ডায়বেটিক এসোসিয়েশনের চীফ কো-অর্ডিনেটর ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা

তিনি বলেন, বাংলাদেশে যেসব প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে সেগুলো অর্থনৈতিক সুচিন্তারই ফল। কিন্তু আমাদের মতো অর্থনীতির দেশে প্রশাসনিক, সার্বিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় যদি বাস্তবায়ন ঠিকমত করা যায় তাহলে আশাকরি এটি ফলপ্রসূ হবে।

ড. আবদুল মজিদ আরো বলেন, প্রণোদনা ও ত্রাণ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যেসব সীমাবদ্ধতা আমাদের আগে থেকেই আছে সেগুলোকে কাটিয়ে উঠতে পারলে আমি মনে করি সামাজিক এবং অর্থনৈতিক যে বিপর্যয় বা দুর্যোগ তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে।

সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ ও উপস্থাপনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।

রেডিও তেহরান: জনাব, ড.মোহাম্মাদ আবদুল মজিদ, সারাবিশ্ব করোনাভাইরাসের মহামারিতে অনেকটা বিপর্যস্ত। বাংলাদেশ এর বাইরে নয়। এ অবস্থায় দীর্ঘদিনের লকডাউনের কারণে আশঙ্কা করা হচ্ছে দেশ অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়বে। আপনার কি মনে হয়?

অতিমারি করোনাভাইরাস

ড.মোহাম্মাদ আবদুল মজিদ: দেখুন, প্রকৃতপক্ষে এই করোনাভাইরাস অতীতের যেকোনো ব্যাধি কিংবা মহাদুর্যোগের চেয়ে একটু আলাদা ধরণের। আর এ কারণেই করোনা আতঙ্কটা অনেক বেশি। কারণ করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব, প্রক্রিয়া, সংক্রমণ এর  সীমা অনেকটাই অজানা। কখন করোনাভাইরাস শেষ হবে তাও অনিশ্চিত। তাছাড়া এখনও পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট করে বোঝা যায় নি কি কারণে করোনা হয় আর কিভাবে সারে! করোনা যতোটা না মানুষের স্বাস্থ্যগত সমস্যা সৃষ্টি করছে তারসঙ্গে বেশি যুক্ত হচ্ছে মানসিক সামাজিক এবং সবশেষে অর্থনৈতিক অবস্থা। স্বাস্থ্য এবং কাজ পরস্পরের সাথে যুক্ত থাকে। তবে যেটা দেখছি তাতে আর্থিকভাবে মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। স্বাস্থ্যগত বিষয়ের চেয়ে করোনার প্রভাব অর্থনীতিতে বেশি পড়বে। সারাবিশ্বে অর্থনীতিতে এখন একটা মন্দার আভাস বোঝা যাচ্ছে। এটা অশনিসংকেত তো বটেই।

রেডিও তেহরান: দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে এবং জনজীবনে কিছুটা স্বস্তি দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কয়েকদফায় প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। এই প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণাকে আপনি কীভাবে দেখছেন এবং আমাদের অর্থনীতিকে সচল রাখার ক্ষেত্রে এই প্রণোদনা প্যাকেজ কতটা সহযোগিতা করবে?

ড.মোহাম্মাদ আবদুল মজিদ: আপনি যথার্থই বলেছেন। বাংলাদেশের সরকার এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সামগ্রিকভাবে কিন্তু অর্থনীতির বিষয়ে বিশেষভাবে নজর দিয়েছেন। যেসব প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে সেগুলো অর্থনৈতিক সুচিন্তারই ফল। কিন্তু আমাদের মতো অর্থনীতির দেশে প্রশাসনিক, সার্বিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় যদি বাস্তবায়ন ঠিকমত করা যায় তাহলে আশাকরি এটি ফলপ্রসূ হবে। তবে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যেসব সীমাবদ্ধতা আমাদের আগে থেকেই আছে সেগুলোকে কাটিয়ে উঠতে পারলে আমি মনে করি সামাজিক এবং অর্থনৈতিক যে বিপর্যয় বা দুর্যোগ তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। 

রেডিও তেহরান: প্রণোদনা প্যাকেজে বাংলাদেশের কৃষকদের জন্য যে আর্থিক সহযোগিতার ঘোষণা দেয়া হয়েছে তাতে ব্যাংক থেকে শতকরা ৪ ভাগ সুদে কৃষকদের ঋণ দেয়া হবে। অনেকে বলছেন এই ঋণ কর্মসূচি খুব একটা সফল হবে না। কারণ অনেক ক্ষেত্রেই গ্রামের কৃষকরা ঋণের বোঝা কাঁধে নিতে চান না এছাড়া ব্যাংকের নানা রকমের প্রক্রিয়াগত জটিলতা থাকে। আপনার কি তাই মনে হয়?

কৃষকদের জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ

ড.মোহাম্মাদ আবদুল মজিদ: দেখুন, আমি ঐ জটিলতার কথাটাই বলছিলাম। কারণ কৃষকদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুযোগ সুবিধা দেয়ার বিষয়ে গত পঞ্চাশ বছরের যে অভিজ্ঞতা রয়েছে সেটি খুব বেশি ভালো না। আমাদের কৃষকরা আসলে নীরবে কাজ করতে ভালোবাসেন। তারা ব্যাংকের পেছনে দৌঁড়ানো খুব বেশি পছন্দ করেন না। কৃষি ব্যাংকের কৃষি ঋণের অভিজ্ঞতাগুলো আমাদের খুব বেশি ভালো না। সেজন্য সুদের হার শতকরা ৪ ভাগ নাকি ৫ ভাগ তার চেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, যে কৃষকের ঋণের প্রয়োজন সে বিনাকষ্টে সহজে সেটা পাবে কি না, তাদের কাছে যাবে কি না? 

আমাদের সকলের প্রত্যাশা কৃষকদেরকে প্রত্যক্ষভাবের চেয়ে অপ্রত্যক্ষভাবে সুযোগ-সুবিধাগুলো পাশে থেকে যদি যোগান দেয়া যায় তাহলে তারা নিজেদের চেষ্টায় এগিয়ে যেতে পারবে। আর সাহায্য পাওয়ার জন্য তাদের যদি অপেক্ষা করতে হয় এবং সেই সাহায্য না পাওয়াতে কৃষককে যদি থমকে যেতে হয় তাহলে সেখানে তারা চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়বে।

রেডিও তেহরান: করোনা মোকাবেলায় সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন রকমের ত্রাণ সামগ্রী বিতরণের ব্যবস্থা করা হয়েছে কিন্তু অনেক জায়গায় দোকানের মালামাল চুরি করা কিংবা লুটপাটের অভিযোগ আসছে এবং আমরা গণমাধ্যমে এ নিয়ে নানা খবর দেখছি। যদিও প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মাত্র কয়েকটি জায়গায় এরধরনের ঘটনা ঘটেছে এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। তো এ বিষয়টি কিভাবে দেখছেন আপনি?

ড.মোহাম্মাদ আবদুল মজিদ: দেখুন, আসলে এ ব্যাপারে সামাজিক অবকাঠামো এবং সামাজিক ব্যবস্থাকে বিবেচনায় নিতে হবে। কোনো বিষয়ে কর্মসূচি গ্রহণ এবং বাস্তবায়নের  ক্ষেত্রে  সামাজিক অবকাঠামো এবং সামাজিক ব্যবস্থাকে অবশ্যই গুরুত্বের সাথে নিতে হবে। যেমন ধরুন, ১০ টাকায় চাল পাওয়া যাচ্ছে এবং মানুষ সেটা লাইন ধরে নিচ্ছে। ঠিক এসময় বাজারে চালের দাম ৩০/৪০ টাকা। এখানে একটা (imbalance) অবস্থা তৈরি হয়েছে। অর্থাৎ দামের বিশেষ একটা পার্থক্য তৈরি হয়েছে। ফলে এখানে স্বাভাবিকভাবেই একটা দুর্নীতি করার সুযোগ এসে যায়।

আমার দৃষ্টিতে এভাবে না করে  এমনভাবে দেয়া যাতে দামের ক্ষেত্রে আলাদাভাবে হিসেব করার সুযোগ থাকবে না। বর্তমানে আমাদের দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের অর্থাৎ স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা বেশ কিছুদিন যাবত একটা অন্য ধরণের অবস্থায় চলে গেছে। একধরণের প্রভাবশালীদের হাতে রয়েছে। এটি আমাদের সমাজ বাস্তবতায় রয়ে গেছে। 

করোনায় প্রান্তিক মানুষদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ

প্রান্তিক মানুষদেরকে যেকোনো সুযোগ-সুবিধা যতই দেয়ার ইচ্ছে থাকুক না কেন সেখানে দেখা যায় একটা মধ্যস্বত্বভোগী চলে আসে। আর সেই মধ্যস্বত্বভোগীরা যদি একটা বিশেষ বলয়ের দ্বারা গড়ে উঠে থাকে তাহলে সেই গোষ্ঠীকে ভেদ করে প্রান্তিক জণগোষ্ঠীকে দিতে যাওয়ার ক্ষেত্রে কাঠামোগত দুর্বলতা রয়েছে। আর সেই দুর্বলতার জন্যই আমার বক্তব্য হচ্ছে যারা প্রণোদনা এবং ত্রাণ সহায়াতার মুখাপেক্ষী তাদের কাছে সরাসরি এটি পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা। কোনো মধ্যস্থতাকারী ছাড়া সরাসরি কিভাবে পৌঁছানো যাবে সে বিষয়টির উপর বিশেষ মনোযোগ দেয়া উচিত।

রেডিও তেহরান: ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ, সেটা কী সম্ভব?

ড.মোহাম্মাদ আবদুল মজিদ: হ্যাঁ সম্ভব হতে পারে। এমন কিছু জিনিষ আছে যা আমরা সরাসরি দিয়ে যাই বা দিয়ে থাকি।

রেডিও তেহরান:ত্রাণের চাল বা অন্যান্য সামগ্রী চুরি এবং লুটপাটের এই ঘটনাটা কি আপনি আমাদের দেশের রাজনৈতিক এবং সামাজিক অবক্ষয়ের লক্ষণ বলে মনে করেন? এখানে সরকারের করণীয় কী?

ড.মোহাম্মাদ আবদুল মজিদ: দেখুন, সমাজ এবং রাজনীতি পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত। সামাজিক অবস্থাটা আপনি কিভাবে রাখবেন সেটা যদি আপনি রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেন তখন পরস্পরের প্রতি তার প্রভাব পড়বে।

আমাদের সবারই জানা আছে যে, ত্রাণ বিলি করতে গেলে মাঝে মাঝে নিরপেক্ষতার বিষয়টি নিয়ে একটা সংকট তৈরি হয়। ফলে যতটা সম্ভব ত্রাণ বিলির সময় নিরপেক্ষতা বজায় রাখা উচিত। আর নিরপেক্ষ রাখার পথ বা পন্থা বের করতে হবে। আর ক্ষেত্রে  প্রয়োজনে তৃতীয় কোনো পদ্ধতিতে যাওয়া সম্ভব কি না সেটাও ভেবে দেখতে হবে। 

আর প্রান্তিক মানুষরাও জানে কার নামের তালিকা হচ্ছে, কাকে ত্রাণ দেয়া হবে কাকে দেয়া হবে না। আমি বলতে চাচ্ছি,  কাঠামোগত পরস্পরবান্ধব বা পরস্পর সহযোগী একটা মনোভবের বিষয়টি যদি না আসে তাহলে সেখানে এই ধরণের টালমাটাল অবস্থা হয়েই থাকে। সেটা কম বা বেশি হতে পারে। আর সেটাকে নিয়ন্ত্রণের জন্য কঠোর হওয়া দরকার। এসব সামগ্রিক বিষয়ের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

রেডিও তেহরান: জনাব ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ, বাংলাদেশের অর্থনীতিসহ সমাজ জীবনে করোনার প্রভাব নিয়ে রেডিও তেহরানকে সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্য আবারও অনেক অনেক ধন্যবাদ।

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ: ধন্যবাদ। #

পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/১৯