মে ০৮, ২০২০ ২১:৩৫ Asia/Dhaka

মহামারি করোনাভাইরাস প্রতিরোধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেয়া নির্দেশনা মেনে চলছে বাংলাদেশ। তবে আর্থ-সামাজিকসহ সামগ্রিক বিবেচনায় বাংলাদেশে পুরোপুরি কোয়ারেন্টাইন মেনে চলা সম্ভব নয়। রেডিও তেহরানকে দেয়া সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেছেন ভাইরোলজিস্ট ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন।

তিনি বলেন, করোনায় বাংলাদেশে মৃত্যুর যে সংখ্যা সেটা মহামারিতে খুবই স্বাভাবিক। আর ইউরোপ বা আমেরিকার তুলনায় মৃত্যুর এ সংখ্যা কম।

Image Caption

বিশিষ্ট এ ভাইরোলজিস্ট বলেন, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে, মাস্ক পরে ও স্বাস্থ্যরক্ষার বিধান মেনে ধীরে ধীরে মানুষের কাজ শুরু করা উচিত। যদিও এরইমধ্যে সরকার সেটি শুরু করার নির্দেশনা দিয়েছে। করোনা সংকটকালে তিনি সরকারের পাশাপাশি বিত্তশালীদের গরিবদের সহায়তায় এগিয়ে আসার পরামর্শ দেন।  

পুরো সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো। এটি গ্রহণ ও উপস্থাপনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।

রেডিও তেহরান: জনাব, ডা. মোহাম্মাদ জামাল উদ্দিন, সারাবিশ্বে করনা ভাইরাসের যে মহামারি চলছে; বাংলাদেশ তার বাইরে নয়। বাংলাদেশে সরকারের পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত যে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তাকে কি আপনি যথেষ্ট মনে করছেন?

ডা.জামাল উদ্দিন: দেখুন, বর্তমানে আমাদের মাঝে করোনাভাইরাস বা কোভিড ১৯ নামের যে মহামারি এসেছে সেটি সম্পূর্ণ নতুন। বিশ্ব সাধারণত  প্রায় শতবর্ষ পরপর এরকম একেকটি মহামারি দেখতে পায় বা অভিজ্ঞতা অর্জন করে থাকে। বর্তমানে সারাবিশ্বে মহামারি করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্বের দেশগুলো তাদের সামাজিক অর্থনৈতিকসহ নিজ নিজ সামগ্রিক অবস্থান থেকে করোনা মোকাবেলায় পরিকল্পনা ও উদ্যোগ গ্রহণ করছে। একেকটি দেশকে একেকভাবে পরিকল্পনা নিতে হচ্ছে। আমরা ইউরোপ বা আমেরিকার মতো করে করোনা মোকাবেলায় পরিকল্পনা বা উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারব না। তবে আমাদেরকে আমাদের মতো করে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হয়েছে। আর সাধারণত এধরনের মহামারি কিংবা সংকটকালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কিছু নির্দেশনা ও পরামর্শ থাকে। এবার মহামারি  করোনাভাইরাস ইস্যুতেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা  লকডাউন, কোয়ারেন্টাইনসহ আরও কিছু বিষয়  নির্দেশনা দিয়েছে। একেক দেশে এসব নির্দেশনা একেকভাবে পালন করা হচ্ছে। দেশগুলো তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী এসব নির্দেশনা পালন করছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মহামারি করোনা ইস্যুতে বাংলাদেশকেও লকডাউনের পরামর্শ দিয়েছে। প্রথম দিকে আমাদেরকে কোয়ারেন্টাইনে যাওয়ার পরামর্শ ও নির্দেশনা দেয়। আর কোয়ারেন্টাইন নিয়ে উন্নত বিশ্বের সাথে আমাদের দেশের তুলনা করা চলে না। তারা আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে কোয়ারেন্টাইন যথাযথভাবে মেনে চললেও আমাদের দেশে সেটা সম্ভব না। আমাদের সক্ষমতার অভাব আছে। একইসাথে মানুষ ভয় পায়। দেখুন, যদি আমরা বলি কোনো একজন ব্যক্তি মরণঘাতি রোগ করোনা নিয়ে গ্রামে এসেছে তাহলে তাকে দেখতে মানুষের ভীড় জমে যাবে। আমাদের গ্রামে এমন ঘটনা ঘটেছে। হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকা করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিকে দেয়াল টপকে দেখতে আসা মানুষের ভীড় জমে গেছে। হোম কোয়ারেন্টাইন জিনিষটা কি সেটা জানার আগ্রহ মানুষের! ফলে করোনা প্রতিরোধে যেসব শব্দ বা টার্ম ব্যবহার করা হয়েছে বিশ্বজুড়ে সেইসব শব্দগুলো ঠিক আমাদের দেশের মানুষের জন্য যথাযথ হয় নি বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। 

তো যাইহোক আমরা মানুষকে হোম কোয়ারেন্টিনে থাকার পরামর্শ দিয়েছি। কিন্তু দেশের মানুষ সেভাবে হোম কোয়ারেন্টাইন পালন করে নি। বিদেশে থেকে মানুষের দেশে ফিরে আসা ঠেকাতে পারিনি এবং দেশে ফেরার পর তাদেরকে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার পরামর্শ দেয়া হলেও সেভাবে তারা কোয়ারেন্টাইন না মানার ফলে গ্রামে-গঞ্জে করোনা ছড়িয়ে পড়েছে। ঐসব আক্রান্ত ব্যক্তি হাটে-বাজারে ঘুরে বেড়ানো বা বিভিন্ন জায়গায় চলাফেরা করার ফলে অনেক জায়গায় তা সংক্রমিত হয়েছে। 

রেডিও তেহরান: জ্বি, তো বাংলাদেশের সামগ্রিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিলে সেখানকার করোনা পরিস্থিতিতে কি শঙ্কিত হওয়ার কিছু আছে ? 

বিশ্ব মহামারি করোনাভাইরাস

ডা.জামাল উদ্দিন: দেখুন, করোনাভাইরাসকে আটকানো আসলে কঠিন একটি ব্যাপার। যেকারণে একে মহামারি করোনা হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। হোম কোয়ারেন্টাইন, সেলফ কোয়ারিন্টিন এবং লকডাউন যেটাই বলেন না কেন সময় মতো না করা হলে এই করোনাকে নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত কঠিন। 

রেডিও তেহরান: বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর বর্তমান যে সংখ্যা- সেটা খুব বেশি না হলেও এখানে করোনা পরীক্ষার একটা সংকটের কথা বলা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, কিটের অপ্রতূলতা এবং পরীক্ষা কেন্দ্রের স্বল্পতা। এমনকি দেখা যাচ্ছে প্রতিদিন করোনার উপসর্গ নিয়ে সারাদেশে মানুষ মারা যাচ্ছে। নানারকম অভিযোগের কথাও মিডিয়ায় দেখা যাচ্ছে। অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, মে মাসটা বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হবে। তো সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে বিষয়গুলোকে আপনি কিভাবে দেখছেন?

ডা.জামাল উদ্দিন: দেখুন, যেসব বিশেষজ্ঞ 'মে' মাসকে ঝুঁকিপূর্ণ বলছেন তাঁরা ৮ মার্চের বেজলাইন থেকে বলছেন। তবে আমার ধারণা এটি ৮ মার্চ নয়, প্রথম যখন উহান থেকে বাংলাদেশের ছাত্ররা ফিরে এল বা তারও আগের কথা বলব। কারণ বাংলাদেশের সাথে চীনের ব্যবসায়িক ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কারণে মানুষের আসা-যাওয়ার ফলে এখানে করোনার প্রবেশ ঘটেছে। সে অনুযায়ী যদি আমরা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় করোনার চিত্রটা লক্ষ্য করি তাহলে দেখব ইউরোপ বা আমেরিকার মতো কিন্তু মৃত্যুর হার বা সংখ্যা এখানে অত বেশি না। আর আমাদের এখানে বর্তমানে যে মৃত্যুর সংখ্যা সেটা মহামারিতে খুবই স্বাভাবিক। এটুকু এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। 

আর করোনা পরীক্ষার যে কথা বলছিলেন সেটি আসলে সক্ষমতার বিষয়। আমাদের এখন সক্ষমতা আস্তে আস্তে বাড়ছে। বেশি পরিমাণে সংক্রমিত হওয়ার প্রশ্নটা আসে মহামারির একটা বিশেষ পর্যায়ে। যত বেশি পরীক্ষা করা হবে বা সঠিক ব্যবস্থাপনার অধীনে আনা যাবে ততো বেশি শনাক্ত হওয়ার বিষয়টি সামনে আসবে। আর এ মুহূর্তে আমাদের সমাজে আমরা এমন একটা পর্যায়ে এসে গেছি যে, আমি নিজেও যে সংক্রমিত না একথা বলতে পারছি নে। যতক্ষণ না আমি পরীক্ষা করতে পারছি! অর্থাৎ আমার কাছে মনে হচ্ছে হয়তোবা আমরা বেশিরভাগ মানুষ করোনায় সংক্রমিত হয়েছি।

টেস্ট-টেস্ট- টেস্ট করে আমরা একটা সময় খুব বেশি কথা বলছিলাম। কিন্তু এই মুহূর্তে আসলে তার খুব একটা প্রয়োজনীয়তা আছে বলে আমি  মনে করছি না। আমার মনে হয় যে যদি ১৬ কোটি মানুষকে পরীক্ষা করা হয় তাহলে দেখা যাবে ১০ কোটি বা তারও বেশি মানুষের করোনা পজিটিভ ধরা পড়বে। যদি সঠিকভাবে পরীক্ষা করা যায়। অ্যান্টিবডি পরীক্ষার মাধ্যমে এটা আমরা জানতে পারতাম।

রেডিও তেহরান: একজন ভাইরোলজিস্ট ও চিকিৎসক হিসেবে রেডিও তেহরানের শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে কিংবা সাধারণ মানুষের প্রতি আপনার পরামর্শ কী?

Image Caption

ডা.জামাল উদ্দিন: দেখুন, চিকিৎসক হিসেবে আমি বলব, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে স্বাভাবিক কাজ-কর্ম চালিয়ে নেয়া। এমন একটা দেশে আমি আছি যেখানে আমাকে কাজ করে খেতে হবে। অনেক দিন আমার পক্ষে কাজহীন থাকা সম্ভব না। ফলে আমাদেরকে কাজ করতেই হবে। আর সেটি সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখেই করতে হবে। মাস্ক পরতে হবে। মাস্ক পরাটাও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার একটি অন্যতম উপকরণ। আর যতোটা সম্ভব দূরে থেকে যোগাযোগ স্থাপন করা। কমপক্ষে যেন দূরত্বটা তিনফুট হয়। পাশাপাশি যথাযথভাবে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকা এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা মেনে চলা। তাহলে আমরা করোনার প্রকোপটা ইনশাআল্লাহ ঠেকিয়ে দিতে পারব। 

রেডিও তেহরান: সরকারের প্রতি আপনার কোনো পরামর্শ আছে কি?

পোশাক শ্রমিক

ডা.জামাল উদ্দিন: সরকারের প্রতি আমার পরামর্শ হচ্ছে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে রোস্টার ভিত্তিতে এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ধীরে ধীরে কাজ শুরু করা। যেমন ধরুন আমরা যারা চিকিৎসক তারা কিন্তু কখনও একেবারে কর্মবিরতিতে ছিলাম না। রোস্টার ভিত্তিতে আমরা চিকিৎসা সেবা দিয়েছি। এভাবে সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ শুরু করে দেয়া উচিত। যদিও এরইমধ্যে সরকার সেভাবে শুরু করে দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে বলব ধরুন পোশাক কারখানা চালু করতে গেলে অবশ্যই মালিককে এ ব্যাপারে সহায়তা করতে হবে। কর্মীদেরকে যথাযথ সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। সেটা যদি মালিকরা না করেন সেক্ষেত্রে কিন্তু হিতে-বিপরীত হবে। এক্ষেত্রে সরকারের উচিত পোশাক কারখানার মালিকদেরকে বাধ্য করা। যাতে তারা সরকারের নেয়া করোনা সম্পর্কিত পদক্ষেপগুলো যথাযথভাবে মেনে চলে।

রেডিও তেহরান: জনাব ডা. মোহাম্মাদ জামাল উদ্দিন সবশেষে আপনার কাছে স্বাস্থ্য অর্থনীতি প্রসঙ্গে জানতে চাইব। বিশেষ করে বাংলাদেশে আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে মানুষের অভাব অনটন আছে। বলা হচ্ছে যে প্রায় ৬ কোটি মানুষ অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজ করছে। তারা কর্মহীন হয়ে পড়েছে। এতে সংকটে পড়েছে মানুষ। তো তাদের সম্পর্কে আপনি কি বলবেন?

ডা. জামাল উদ্দিন: দেখুন, আমরা বাংলাদেশের মানুষ স্বাস্থ্য-বিমার আওতায় নেই। যদিও এটি প্রত্যাশিত ছিল। স্বাস্থ্য-বিমার আওতায় আমাদের অবশ্যই যেতে হবে। স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য কিন্তু আমাদের বাজেট নেই। হত দরিদ্রদের জন্য এই মুহূর্ত খুবই ভীতিকর। এখন তাদের খাবারের যোগাড় নেই। আর স্বাস্থ্যখাতের বাজেট তো একেবারেই শূন্য।

এসব বিষয়ে সরকারের পাশাপাশি যারা বিত্তশালী ব্যক্তি আছেন তারা যদি সহানুভূতিশীল হন এবং গরিবদের প্রতি নজর দেন তাহলে তাদের জন্য বেশ উপকার হয়। আর সরকার যদি উন্নত বিশ্বের মতো সবাইকে বিমার আওতায় আনতে পারত তাহলে মানুষ কিছুটা নিরাপত্তা পেত। তো সেটি না থাকায়- বিত্তশালীদের সাহায্য সহযোগিতাই এইমুহূর্তে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এব্যাপারে সবাই এগিয়ে এলে আমার মনে হয় সবাই স্বাস্থ্য-সেবার আওতায় না আসতে পারলেও কাছাকাছি থাকতে পারবে।

রেডিও তেহরান: জ্বি ডা. মোহাম্মাদ জামাল উদ্দিন, বিশ্ব মহামারি করোনায় বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে রেডিও তেহরানের সাথে কথা বলার জন্য আপনাকে আবারও অনেক অনেক ধন্যাবদ।

ডা. জামাল উদ্দিন: আপনাকেও অনেক অনেক ধন্যবাদ।#

পার্সটুডে/ গাজী আবদুর রশীদ/৮

 

ট্যাগ