পাশ্চাত্যে জীবন ব্যবস্থা (পর্ব-৪)
পাশ্চাত্যে জীবন ব্যবস্থা শীর্ষক ধারাবাহিকের গত পর্বে আমরা বলেছি, ভোগবাদ মানবজাতিকে আত্মবিধ্বংসী পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, সময়, বিশ্রাম, চিকিৎসাসহ সব কিছুরই একটি সীমা রয়েছে, কিন্তু ভোগের যে তাড়না তা সীমাহীন।
ভোগের বাসনার শেষ নেই। ভোগের কারণে যে সুখানুভূতি সৃষ্টি হয়, তা ক্ষণিকের। আর মানুষ এই ক্ষণিকের সুখকে স্থায়ী সুখে পরিণত করার জন্য আরও বেশি ভোগ্যপণ্য ব্যবহার করছে, অবিরাম ছুটে চলেছে। কিন্তু ভোগবাদে যে প্রকৃত সুখ নেই তা সে বুঝতে পারছে না। আসলে ভোগবাদে বিভোর কোনো ব্যক্তি কখনোই এই উপায়ে প্রকৃত ও টেকসই সুখ ও আনন্দ খুঁজে পাবে না, এটা তার মিথ্যা ছুটে-চলা। আজও আমরা ভোগবাদ নিয়ে আলোচনার চেষ্টা করব। তবে পরিবেশের ওপর ভোগবাদের প্রভাবের বিষয়টি আজকের আলোচনায় গুরুত্ব পাবে। আসরের শেষ পর্যন্ত আমাদের সঙ্গেই আছেন, এ প্রত্যাশা রইলো।
বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে ভোগবাদী সমাজ সম্প্রসারিত হচ্ছে। আর এই ভোগবাদ, মানবজাতিকে আত্মবিধ্বংসী পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা ক্রমেই নিজের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছি। আমরা যে পৃথিবীতে বাস করছি সেটাকে বসবাসের অযোগ্য করে তুলছি। বিশেষকরে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখার যে দায়িত্ব তা এড়িয়ে চলছি। ভোগবাদ কীভাবে আমাদেরকে আত্মবিধ্বংসী পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে তা সহজেই বুঝা যায় পরিবেশ ও প্রকৃতির ওপর এর প্রভাব বিশ্লেষণ করলে। ভোগবাদী সমাজ ও সংস্কৃতির ভিত্তিই হলো অতিমাত্রায় পণ্যের উৎপাদন ও এর ব্যবহার। আর যেকোনো পণ্যের কাঁচামালের যোগানদাতা হচ্ছে পরিবেশ ও প্রকৃতি। বর্তমানে মানুষের ভোগ্যপণ্যের মাত্রাতিরিক্ত চাহিদা মেটাতে গিয়ে পরিবেশ-প্রকৃতি ভারসাম্য হারাতে বসেছে। যেমন অতি উৎপাদনের কারণে গ্রিনহাউস ইফেক্ট বা কার্বন নিঃসরণ এবং জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে প্রকৃতির ওপর চাপ বাড়ছে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
অন্যভাবে বলা যায়, স্বাভাবিক নিয়মে প্রকৃতি যতটুকু সম্পদ ও কাঁচামাল দিতে পারে তার চেয়ে বেশি সম্পদ ও কাঁচামাল মানুষ তার কাছ থেকে নিয়ে নিচ্ছে। একই সঙ্গে স্বাভাবিক পন্থায় যতটুকু বর্জ্য ও বিষাক্ত গ্যাস,প্রকৃতি গ্রহণ বা শোষণ করতে পারে তার চেয়ে বেশি বর্জ্য ও বিষাক্ত গ্যাস তাকে গ্রহণ করতে হচ্ছে। এর ফলে প্রকৃতিতে মারাত্মক ভারসাম্যহীন অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। আর মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য যে সুস্থ পরিবেশ দরকার তা নির্ভর করে প্রাকৃতিক ভারসাম্যের ওপর। প্রাকৃতিক ভারাসাম্য থাকার অর্থ হলো পৃথিবীতে তাপমাত্রা,বায়ু ও পানিসহ অন্যান্য উপাদান এমন মাত্রায় থাকবে যা মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যহত করবে না। ওজোন স্তর হলো পৃথিবীর মানুষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঢাল যা মানুষ ও জীবজন্তুকে অতি বেগুনি রশ্মি থেকে বাঁচায়। কারণ, এই ওজোনের স্তর অতি বেগুনি রশ্মিকে শোষণ করে নেয়। পৃথিবীর উত্তাপ বেড়ে যাওয়ার জন্য ওজোনের স্তর ভেঙে যাচ্ছে।
এখন প্রশ্ন হলো পৃথিবীর তাপমাত্রা কেন বাড়ছে? শিল্পবিপ্লবের পর কল-কারখানার সংখ্যা বেড়ে যাওয়াই তাপমাত্রা বাড়ার মূল কারণ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বিশেষকরে উন্নত দেশগুলো ভোগবাদকে কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির যে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে তাতে শিল্প খাতে উন্নয়নের গতি বাড়লেও মানবজাতির অস্তিত্ব সংকট জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। শিল্প খাতে উন্নয়ন জোরদার করতে অবাধে জ্বালানি পোড়ানো হচ্ছে। নতুন নতুন কল-কারখানা তৈরি হচ্ছে। যান্ত্রিকীকরণের মাত্রা ও হার এতোটাই প্রবল হয়েছে যে, বায়ু ও পরিবেশ দুষণ ও বিনষ্টের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পুরো পৃথিবী অগ্নিগর্ভ ও উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। গাছ-পালা কাটা হচ্ছে অবাধে। নদী-খাল ভরাট করে কল-কারখানা নির্মাণ করা হচ্ছে। তাপমাত্রা পরিমাপক যন্ত্রের তথ্য থেকে এটা স্পষ্ট যে, প্রতি বছরই পৃথিবীর তাপমাত্রা কিছু না কিছু বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে ২০০০ সালের পর থেকে প্রতিবছরের তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন,১৯৯২ সাল থেকে ২০১৪ সাল সময়কালে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৩ ইঞ্চি পর্যন্ত বেড়েছে।
‘ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক' জার্নালে বিজ্ঞানী টিম ফলগার নিজের গবেষণায় দেখিয়েছেন, বিজ্ঞানীদের ধারণার চেয়েও অনেক বেশি হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। শুধু তাই নয়, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে অ্যান্টার্কটিকা ও গ্রিনল্যান্ডের মতো শীতল অঞ্চলের বরফ দ্রুত গতিতে গলছে। তাপ বৃদ্ধির কারণেই বরফ গলছে এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। এছাড়া ভোগবাদকে টিকিয়ে রেখে দ্রুত মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে রাসায়নিক সার,কীটনাশক ওষুধ ও কৃত্রিম রঙ ব্যবহারের মতো নিত্যকার ঘটনাগুলো সারা বিশ্বে পানিদূষণ ঘটাচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে মাছসহ জলজ প্রাণী,বৃক্ষ-তরুলতাসহ জীববৈচিত্র্যের ওপর। অতিমাত্রায় ভোগ্যপণ্যের উৎপাদন না বাড়িয়ে কেবল মৌলিক চাহিদা মেটানোর দিকে নজর দিলে এমন বিপদে পড়তে হতো না।
ভোগবাদে উৎপাদন প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রেতাদের চাহিদার কথা মাথায় রেখে কিছু উৎপন্ন করে না। কোনো একটি পণ্য ক্রেতা কিনবেন কি কিনবেন না,তা আর এখন ক্রেতার মর্জির উপর নির্ভর করছে না বরং,উৎপাদনযন্ত্রের মালিকেরা যা বিক্রয় করতে চান,তা-ই ক্রেতার চাহিদায় পরিণত হয়। ক্রেতার চাহিদার সিংহভাগই এখন কৃত্রিম। ২০১৮ সালে বিশ্বব্যাপী ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো বিজ্ঞাপনের পেছনে খরচ করেছে ৫৮১ বিলিয়ন ডলার। বিশ্বের বহু দেশের জিডিপির চেয়েও বড় আকারের অর্থ বিজ্ঞাপনের পেছনে খরচ করছে এসব প্রতিষ্ঠান। ক্রেতাদেরকে ভোগের প্রতি উৎসাহিত করাই এর উদ্দেশ্য। ক্রেতা ভোগে উৎসাহী না হলেও,কিংবা ক্রেতার চাহিদা না থাকলেও বিজ্ঞাপন,প্রচার-প্রচারণা আর কৃত্রিম চাকচিক্যের মাধ্যমে ক্রেতাকে ঠিকই নিজেদের পণ্যের প্রতি আকৃষ্ট করে ফেলছে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো। আর এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সমাজ আরও ভোগবাদী হয়ে উঠছে। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বারবার এই প্রবণতার বিষয়ে সতর্ক করলেও শিল্পোন্নত দেশগুলো বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছে না।
অনিয়ন্ত্রিত উৎপাদন ও ভোগবাদী সংস্কৃতি লালন ও তা ছড়িয়ে দেওয়ার পেছনে পাশ্চাত্যের ধনী দেশগুলোই সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে। তারা নিজেদের মুনাফার জন্য গোটা বিশ্বেরই অপূরণীয় ক্ষতি করে চলেছে। তারা নিজের ভোগ-বিলাস অক্ষুন্ন রাখতে বিশ্বের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে চাইছে, প্রয়োজনে যুদ্ধ চাপিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু ভোগ ও চাহিদার সীমাকে নিয়ন্ত্রণ করে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য পৃথিবী নিশ্চিত করে যাওয়ার কোনো সদিচ্ছা পাশ্চাত্যে লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। #
পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/ ১৩
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।