নভেম্বর ১০, ২০২০ ১৫:২১ Asia/Dhaka

গত কয়েকটি আসরে আমরা পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে মানসিক চাপ, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা এবং বিষণ্ণতার মতো সমস্যা বৃদ্ধির নানা দিক নিয়ে খানিকটা আলোচনা করেছি। আজকের আসরে আমরা পাশ্চাত্যের মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি প্রসঙ্গে আলোচনার চেষ্টা করব।

আজকের আলোচনা শুরু করব আমাদের এক বন্ধুর কানাডা সফরের স্মৃতিচারণ দিয়ে। আমাদের এক বন্ধুর পরিবারের কয়েকজন সদস্য কানাডার টরেন্টোতে থাকেন। সেখান থেকে ফিরে আমাদের সঙ্গে সফরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে এই বন্ধু বলেন, " কানাডার টরেন্টাতে আমি যে বাড়িতে ছিলাম তার কাছেই একটা বিশাল পার্ক আছে। পার্কের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে একটি নদী। নদীর ওপর একটি ব্রিজ আছে। সেখানে দাঁড়ালে চারপাশের মনোরম দৃশ্য বেশ উপভোগ্য মনে হয়। আসলেই চমৎকার পরিবেশ। আমি ব্রিজে দাঁড়িয়ে সব কিছুকে উপভোগ করতাম। প্রতিদিন সেখানে যেতাম এবং কিছু সময় কাটাতাম। কিন্তু এই ব্রিজে উঠেই অনেক তরুণ-তরুণী আত্মহত্যা করে। আমি এখনও বুঝতে পারি না কানাডার তরুণ-তরুণীরা কেন এত সুন্দর একটি ব্রিজ থেকে ঝাপ দিয়ে আত্মহত্যা করে!"

বন্ধুর স্মৃতিচারণের পর মার্কিন সাংবাদিক, লেখক ও রাজনৈতিক কর্মী মাইকেল স্নাইডারের একটি বাক্য খুব মনে পড়ছে। তিনি আত্মহত্যা সংক্রান্ত এক নিবন্ধে লিখেছেন, "মানুষের জন্য যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তাহলো জীবনের অর্থ ও লক্ষ্য খুঁজে পাওয়া।"

বৈষয়িক উন্নতি সত্ত্বেও পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে আত্মহত্যার প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে। এসব দেশে অস্বাভাবিক মৃত্যুর অন্যতম কারণ হচ্ছে আত্মহত্যা। আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিবেদনগুলোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী পৃথিবীতে বছরে আট লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে। এছাড়া এর অন্তত ২০ গুণ মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। মৃত্যুবরণকারীদের সঙ্গে আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়া মানুষের সংখ্যাকে যোগ করলে আত্মহত্যার প্রবণতার ভয়াবহতা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আত্মহত্যার অর্থ বোঝেন না এমন মানুষ হয়তো কম আছেন। স্বেচ্ছায় জীবনের ইতি ঘটানোর নামই আত্মহত্যা। পবিত্র ইসলাম ধর্মে আত্মহত্যা হারাম। যাইহোক যারা মানসিক অসুস্থতা, বিশেষ করে বিষণ্ণতা, হতাশা, ব্যক্তিত্ব ও আবেগের সমস্যা, মাদকাসক্তি আর সিজোফ্রেনিয়ায় ভুগছেন, তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। এ ধরণের ব্যক্তিরা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে হতাশ।

আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীতে প্রতি ঘণ্টায় ১৯ জন মানুষ আত্মহত্যা করেন। পৃথিবীতে মৃত্যুর অষ্টম কারণ হচ্ছে আত্মহত্যা। নারীদের তুলনায় পুরুষের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। এছাড়া ১৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সী মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা যায়, কারণ সাধারণভাবে এই বয়সে এসে মানুষকে জীবনযাপনের ক্ষেত্রে অন্যকে বেশি সমস্যা ও জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়। ফ্রান্সে প্রতি বছর ক্যান্সারে যে সংখ্যক মানুষ মারা যায় তার চেয়ে বেশি মানুষ আত্মহত্যা করে। ফ্রান্সে প্রতি বছর আত্মহত্যা করে প্রায় দুই লাখ মানুষ। এর মধ্যে ১৫ থেকে ২০ বছর বয়সী তরুণীদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। ফ্রান্সের জাতীয় স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৭ সালের প্রতিবেদনে বলেছে, সেদেশে তিন বছরের ব্যবধানে আত্মহত্যার সংখ্যা ২২ শতাংশ বেড়েছে। অবশ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি।

ব্রিটেনেও আত্মহত্যার প্রবণতা মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে। আত্মহত্যা রোধে নানা পদক্ষেপ নিয়েও এই প্রবণতা কমানো যাচ্ছে না। ২০১৮ সালের ২৭ মার্চ লন্ডনের কেন্দ্রস্থল দিয়ে যারাই গেছেন তারাই একটি অস্বাভাবিক দৃশ্য লক্ষ্য করেছেন। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছিল একটি সুউচ্চ ভবনের ছাদের কিনারে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে ৮৪ জন পুরুষ। মনে হচ্ছিল এখনই ছাদ থেকে তারা নিচে পড়ে যাবে। আসলে এগুলো ছিল বিভিন্ন সাইজের পুরুষের ভাস্কর্য। ৮৪টি ভাস্কর্য রাখার কারণ হলো সে সময় ব্রিটেনে প্রতি সপ্তাহে ৮৪ জন পুরুষ আত্মহত্যা করতো। শিল্পী মার্ক জেঙ্কিন্‌য এই উদ্যোগের মাধ্যমে লন্ডনের অধিবাসীদেরকে আত্মহত্যার ভয়াবহ প্রবণতার বিষয়ে সজাগ করতে চেয়েছেন।  ব্রিটেনে প্রতি বছর সাড়ে চার হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে। সেদেশে ৪৫ বছরের কম বয়সী মানুষের মৃত্যুর বড় কারণ হচ্ছে আত্মহত্যা।

ব্রিটেনই হচ্ছে প্রথম কোনো দেশ যেখানে আত্মহত্যা রোধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। যখন কোনো দেশে একটি সংকট মোকাবেলার জন্য বিশেষ মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করা হয় তখন তা থেকে যে বার্তাটি স্পষ্ট হয় তাহলো এই সংকটের শেকড় অনেক দূর পৌঁছে গেছে। ব্রিটেনে একাকীত্ব সামলানো বিষয়েও একটি মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সেদেশে একাকীত্ব ও আত্মহত্যা রোধে আলাদা দু'টি মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠার ঘটনা প্রমাণ করে ব্রিটিশ সমাজে মানুষের জীবনযাপন পদ্ধতিতে বড় ধরণের ঘাপলা রয়েছে। ২০১৭ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর ৪৭ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে। আমেরিকায় এক বছরে আত্মহত্যার এই সংখ্যা ২০০১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধে নিহত মার্কিন সেনা সংখ্যার সাত গুণ। মার্কিন রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০০ থেকে ২০১৬ সাল-এই সময়ে আমেরিকায় ১৬ থেকে ৬৪ বছর বয়সী মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা ৩৪ গুণ বেড়েছে।

মার্কিন লেখক ও সাংবাদিক মাইকেল স্নাইডার এই রিপোর্ট উদ্ধৃত করে লিখেছেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় আমেরিকায় জীবনমান অনেক উন্নত বলা হলেও বাস্তবে এখানকার মানুষজন সুখী নয়। আমরা বিনোদনের মধ্যে একেবারে ডুবে আছি। কিন্তু বাস্তবে আগের প্রজন্মগুলোর চেয়ে বর্তমান প্রজন্ম বেশি সুখী হতে পারেনি। আগের প্রজন্মের চেয়ে বর্তমান প্রজন্মের মানুষ অনেক কম সুখী।

যারা আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন তাদের অনেকের সঙ্গেই গবেষকরা কথা বলেছেন। তাদের অনেকের উত্তর হচ্ছে, বাঁচার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু বাঁচার উপায় নেই। এখন প্রশ্ন হলো পাশ্চাত্যের দেশগুলো অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক উন্নতি সাধন করার পরও কেন সেখানকার মানুষেরা আত্মহত্যা করতে চায়? তাদের এ ধরণের অযৌক্তিক ও ঘৃণ্য পথ বেছে নেওয়ার কারণ কী? কীসের ঘাটতি তাদের? #

পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/ ১০

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।