মরমি কবি মনসুর হাল্লাজের বক্তব্য ও তার রচনাবলীর প্রভাব
গত পর্বের ধারাবাহিকতায় আজ আমরা মনসুর হাল্লাজের বক্তব্য ও রচনাবলীর প্রভাব সম্পর্কে কথা বলব।
মনসুর হাল্লাজের যেমন অনেক সমর্থক ও অনুরাগী দেখা গেছে যুগে যুগে তেমনি তার অনেক নিন্দুক বা সমালোচকও দেখা গেছে এবং এখনও এ অবস্থা বজায় রয়েছে। ফলে প্রভাবশালী এই ইরানী মনীষীর অবস্থা সম্পর্কে আজও নানা অস্পষ্টতা রয়ে গেছে। মানুষের ওপর মনসুর হাল্লাজের ব্যাপক প্রভাব ছিল তার প্রতি কোনো কোনো মহলের ব্যাপক শত্রুতার অন্যতম কারণ। ইরানি এই মনীষীর জনপ্রিয়তা তৈরির ক্ষেত্রে যতটা না তার রচনাবলীর প্রভাব রয়েছে তার চেয়েও বেশি প্রভাব রেখেছে তার আধ্যাত্মিক চিন্তাধারা এবং করুণ ও নৃশংস মৃত্যু। মনসুর হাল্লাজের অনেক রচনা ও বইয়ের কথা জানা যায়। কিন্তু এসবের বেশিরভাগই টিকে থাকেনি সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে। আধ্যাত্মিক রহস্যময় চেতনায় সমৃদ্ধ মনসুর হাল্লাজ-এর বক্তব্য ও চিন্তাধারাগুলোর অনেকাংশই সবার কাছে বোধগম্য নয়, কেবল এসব বিষয়ে যারা বিশেষজ্ঞ তারাই সেসব বুঝতে সক্ষম। তবে এটা স্পষ্ট যে তার চিন্তা-চেতনা ও বক্তব্যের মূল অক্ষ বা কেন্দ্রবিন্দু হল আল্লাহর প্রেমপূর্ণ ইবাদত ও তাঁর নৈকট্য লাভের বিষয়। মনসুর হাল্লাজ-এর জীবন ও মৃত্যু আবর্তিত হয়েছে এ বিষয়কে ঘিরেই।

মনসুর হাল্লাজ নিজের মধ্যে বড় ধরনের এক আধ্যাত্মিক বেদনা অনুভব করতেন। তার সেই বেদনাটি ছিল আল্লাহর সঙ্গে মিলনের ও একাত্ম হওয়ার বেদনা। এই বেদনা যখন অব্যাহত থাকে তখন তা খোদাপ্রেমের লক্ষণ। মনসুর হাল্লাজের মধ্যে খোদাপ্রেমের যে আগ্নেয়গিরি বিরাজ করছিল তা থেকে এক সময় অগ্নুৎপাত ঘটতে থাকে যা নিয়ন্ত্রণ করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। ফলে তিনি সবার কাছেই বলতেন যে আনাল হক্ব বা আমিই খোদা! মনসুর হাল্লাজের মতে বুদ্ধিবৃত্তি দিয়ে আল্লাহকে জানতে চাইলে মানুষ বিপথগামী ও দিশেহারা হয়ে পড়বে এবং মহান আল্লাহকে নিজের মধ্যেই চিনতে হবে। মনসুর হাল্লাজ বলেছেন, হে মানুষ! মহান আল্লাহ সৃষ্টিকুলকে নিজ দয়া ও অনুগ্রহের বশে সৃষ্টি করেছেন এবং তাদের ওপর প্রকাশমান হয়েছেন। আর এরপর সৃষ্টিকুলকে প্রতিপালনের জন্য ও তাদের সংশোধনের জন্য তাদের কাছ থেকে লুকিয়ে যান। তিনি যদি প্রকাশমান না হতেন তাহলে সবাই তাঁর অস্তিত্বকে অস্বীকার করত। আবার যদি গোপন না হতেন তাহলে সবাই তাঁর প্রতি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে থাকত। সৃষ্টিকুলের জন্য মহান আল্লাহ কখনও এ দুই অবস্থার মধ্যে কেবল যে কোনো এক অবস্থার ওপর বজায় থাকেন না!
মনসুর হাল্লাজ খোদা-প্রেমের সাগরে তার নিমজ্জিত অবস্থা সম্পর্কে নিজ কবিতায় বলেছেন:
এখনও ডুবে আছি প্রেম-দরিয়ায়
উঠছি ওপরে নামছি নিচে
উথাল-পাতাল ঢেউয়ের দোলায়
কখনওবা ডুবছি নিচে
কখনওবা ভাসছি পানির ওপরে
যতক্ষণ না প্রেম নিয়ে যায় আমায়
কুলহীন নীরে
নাম না নিয়েই ডাকলাম তাঁকে আমি
কখনও তাঁর সঙ্গে করিনি বেঈমানি
'আমার আত্মা নিত তোমার আশ্রয় মন্দ এড়াতে
এই ছিল ওয়াদা তোমাতে-আমাতে'!

মনসুর হাল্লাজের মৃত্যুর পর তার চিন্তাধারার প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন বেশিরভাগ প্রখ্যাত সুফি-সাধক ও আরেফরা। তার চিন্তাধারা অনেক কবির ওপর প্রভাব ফেলেছিল ও সামগ্রিকভাবে সমাজকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। প্রখ্যাত মরমি কবি ও সুফি সাধক ফরিদউদ্দিন আত্তার, মাওলানা রুমি, হাফেজ এবং আধুনিক যুগের কবি শাফিয়ি কাদকানি ও ইরানের বাইরে সিরিয় কবি আদুনিসের মত ব্যক্তিত্বকে নাড়া দিয়েছেন মনসুর হাল্লাজ। বিশেষ করে হিজরি ষষ্ঠ শতকের মরমি কবি ও সুফি সাধক ফরিদউদ্দিন আত্তার নিশাপুরির কবিতা চিন্তা-ভাবনা, দৃষ্টিভঙ্গী ও শব্দ ব্যবহারের দিক থেকে মনসুর হাল্লাজের নৈকট্যের স্বাক্ষর বহন করছে। আত্তার তার তাজকিরাতুল আওলিয়া নামক বিশ্বখ্যাত বইয়ে মনসুর হাল্লাজ-এর জীবনী খুব দরদ দিয়ে এবং হৃদয়গ্রাহী ও মর্মস্পর্শী ভঙ্গিতে তুলে ধরেছেন। আত্তার তার মানাত্বিক আত্তাইর তথা পাখিদের কথা বা সম্মেলন শীর্ষক বইয়ে মনসুর হাল্লাজ-এর দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। আত্তারের কবিতায়ও মনসুর হাল্লাজ এবং তার চিন্তাধারার প্রতি গভীর অনুরাগ স্পষ্ট।
মনসুর হাল্লাজ ও আত্তারের জীবনের মধ্যেও বেশ মিল রয়েছে। মনসুর হাল্লাজ-এর মত আত্তারের জীবন ও মৃত্যুর তারিখও অস্পষ্ট। দু'জনই জনগণের সঙ্গে গভীরভাবে মিশতেন ও তাদের দুঃখ-বেদনায় গভীর কষ্ট অনুভব করতেন। শাসকগোষ্ঠী বা সরকারের সঙ্গে এ দু'জনেরই বনিবনা ছিল না যদিও এই বনিবনা না হওয়ার ধরণ ছিল ভিন্ন রকম। তারা দু'জনই শাসকদের প্রশংসা করতেন না, বরং জুলুম ও বলদর্পিতার বিরুদ্ধে কথা বলতেন। তাদের উভয়ের বক্তব্য থেকেই বোঝা যায় লোক-দেখানো আচার-আচরণ বা কপটতা তাদের মধ্যে ছিল না। একনিষ্ঠতা ছিল তাদের ভূষণ। তাদের দুজনকে নিয়েই অর্থাৎ মনসুর হাল্লাজ ও ফরিদউদ্দিন আত্তারকে নিয়ে অনেক অলৌকিক বা কল্প-কাহিনী শোনা যায়। আসলে তাদের চিন্তাধারা ও আত্মিক অবস্থা ছিল এতই অভিন্ন প্রকৃতির যে মনে হয় যেন আত্তারের মধ্যেই আবারও হাল্লাজের আত্মার আবির্ভাব ঘটেছিল। আত্তার যেন মনসুর হাল্লাজ-এর কথাগুলোকেই ভিন্নভাবে তুলে ধরেছেন।
মাওলানা রুমি ফরিদউদ্দিন আত্তারের মৃত্যুর বহু বছর পর আত্তারের ওপর মনসুর হাল্লাজ-এর গভীর প্রভাব সম্পর্কে লিখেছেন: আমার যাবার ব্যাপারে কোনো ভয় পাবেন না ও দুঃখ-ভারাক্রান্ত হবেন না। কারণ মনসুর হাল্লাজ রাজিআল্লাহু আনহুর নুর ১৫০ বছর পর ফরিদউদ্দিন আত্তারের রুহের ওপর প্রকাশ পেয়েছে এবং তার পথপ্রদর্শক বা মুর্শিদে পরিণত হয়েছে।
আত্তারের 'মানাত্বিক আত্তাইর' তথা পাখিদের কথা বা সম্মেলন শীর্ষক বইয়ের কবিতার অনেক পংক্তিতে মনসুর হাল্লাজের বক্তব্যের প্রতিফলন দেখা যায়।#
পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ১৯
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।