ইরানি কবি মাসউদ সা'দ সালমান-এর জীবন
গত পর্বের ধারাবাহিকতায় আজও আমরা হিজরি পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতকের তথা খ্রিস্টিয় একাদশ শতকের বিখ্যাত ইরানি কবি মাসউদ সা'দ সালমান-এর জীবন ও রচনা সম্পর্কে কথা বলব।
গত পর্বে আমরা জেনেছি হিজরি পঞ্চম শতকের দ্বিতীয়ার্ধের ও ষষ্ঠ শতকের প্রথমার্ধের তথা খ্রিস্টিয় একাদশ শতকের বিখ্যাত ইরানি কবি মাসউদ সা'দ সালমান লাহোরে এক সভ্রান্ত ইরানি পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন। তার বাবা ছিলেন গজনভী সুলতানের একজন বড় কর্মকর্তা। মাসউদ সা'দ সালমান পড়াশুনা ও শিক্ষা-জীবন শেষ করে যৌবনেই রাজদরবারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন ও সুলতান ইব্রাহিমের পুত্র শাহজাদা সাইফউদ্দিন মাহমুদ-এর সঙ্গী হন। সুলতানের এই ছেলে হিজরি ৪৬৯ সনে গজনি সাম্রাজ্যের ভারতীয় অংশের শাসক নিযুক্ত হন। সালমান যুদ্ধের ময়দানে ছিলেন রণকুশলী কমান্ডার এবং শিল্প ও সাহিত্যের আসরে ছিলেন সুরুচিসম্পন্ন মিষ্টিভাষী এক কবি। জীবনের চল্লিশটি বছর সুখ ও সম্মানের মধ্য দিয়ে কাটানোর পর অসম্মান ও দুর্দিনের শিকার হন তিনি। শাহযাদা সাইফউদ্দিনের বিরুদ্ধে সালযুক সম্রাটের সঙ্গে গোপন সম্পর্ক রাখার অপবাদ আনা হলে তার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে কবি মাসউদকে 'নেই' নামক কারাগারে থাকতে হয়েছিল প্রায় দশ বছর। মুক্তিলাভের পর রাজনৈতিক সংকটের কারণে তিনি আরও আট বছর কারাবাসী হন। আর তাই কবি মাসউদ কারাবাসী কবি হিসেবে খ্যাত। 'নেই'-কারাগারেই মাসউদ তার শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলো লিখেছিলেন।
কোনো কোনো জীবনী-লেখক মনে করেন কবি আবু আল ফারাজ রুনি'র প্ররোচনাতেই কবি মাসউদ সা'দ সালমানকে কারাবাসী হতে হয়েছে। কিন্তু এ ধারণা সঠিক হতে পারে না এ কারণে যে মাসউদ সা'দ সালমান নিজেকে কবি রুনি'র ছাত্র বলে মনে করতেন এবং তারা দু'জনই ছিলেন সে যুগের বড় কবি। বরং নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে কবি মাসউদ সেনা-কর্মকর্তা আবুল ফারাজ মানসুর বিন রুস্তাম-এর হিংসা ও প্রচারণার কারণেই জ'বোলেস্তানের একটি দূর্গে বন্দি হন সুলতান ইব্রাহিম গজনভির নির্দেশে। কারাজীবনে অসুখী হলেও আলী খাস নামের একজন প্রভাবশালী বন্ধুর সুবাদে সেখানে অন্যদের তুলনায় আরামেই ছিলেন কবি মাসউদ। এই আলী খাস ছিলেন সুলতানের দরবারের সদস্য। মাসউদ তার প্রশংসা করে খুব সুন্দর একটি ক্বাসিদা লিখেছিলেন। আলী খাস তার বন্ধু মাসউদকে মুক্ত করার জন্য গজনির সুলতানের মন নরম করার চেষ্টা চালান। কিন্তু হিংসুক মহলও বসে থাকেনি। তারা সুলতানকে জানায় যে, জ'বোলেস্তানের যে দূর্গে বন্দি করা হয়েছিল মাসউদকে সেখানে তিনি মুক্ত মানুষের মতই বসবাস করছেন। ফলে সুলতান রেগে দিয়ে কবি মাসউদকে সু নামক দূর্গে স্থানান্তরের নির্দেশ দেন।
সু নামক দূর্গে কবি মাসউদকে খুব কষ্ট দিয়ে রাখা হত। একটি পাহাড়ের ওপর অবস্থিত এ দূর্গের ভেতরে তার পা ডান্ডবেরি বা শেকল দিয়ে বাঁধা থাকত। এ অবস্থায় আলী খাস তাকে মুক্ত করার চেষ্টা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি তার যত্ন নিতেন এবং তাকে ধৈর্য ধরার পরামর্শ দিতেন।
সু দূর্গে বাহরামি নামের একজন বৃদ্ধ বন্দি ছিলেন অত্যন্ত জ্ঞানী ও মুক্ত-মনা। জীবন ও জগৎ সম্পর্কে তার অনেক অভিজ্ঞতা ছিল। তিনি ভবিষ্যৎ ও পরিবার সম্পর্কে হতাশ আর ম্রিয়মান কবি মাসউদকে খুশি ও প্রশান্ত রাখতে তাকে নানা ধরনের হৃদয়গ্রাহী বাণী ও শিক্ষণীয় কাহিনী শোনাতেন। ফলে মাসউদ খুবই শান্ত ও আশাবাদী হয়ে উঠতেন এসব বাণী ও কাহিনী শুনে। ওই জ্ঞানী বৃদ্ধ বাহরামি জ্যোতির্বিদ্যা জানতেন। মাসউদ তার কাছ থেকে জ্যোতির্বিদ্যা শেখেন।
প্রথম দু'টি দূর্গে সাত বছর ধরে কারাবাসের পর মাসউদ সাদকে পাঠানো হয় নয়ি বা নেই নামক দূর্গের কারাগারে। এখানে কবিকে কাটাতে হয়েছে তিন বছর। এ দূর্গের কারাজীবন ছিল তার জন্য আরও বেশি কঠিন। ফলে এখানে লেখা তার কবিতাগুলো হয়েছিল অনেক বেশি মর্মস্পর্শী ও উদ্দীপনাময়।
কবি মাসউদের কারাবন্দিত্বের দিনগুলোতে তার বন্ধু-মহল ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা সুলতান ইব্রাহিমের কাছে তার মুক্তির জন্য দেন-দরবার ও প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন। অবশেষে আবদুল মালেক আবুল কাসেমের প্রচেষ্টায় কবি মাসউদ রাজকীয় ক্ষমা লাভ করে মুক্তি পান। মুক্তি পাবার পর কবি মাসউদ লাহোরে ফিরে যান। কিন্তু তখন তিনি অনেক দুর্বল ও দুঃখ-ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েন।
সুলতান ইব্রাহিম মারা গেলে তার ছেলে মাসউদ গজনির সুলতান হন। মাসউদ তার এক ছেলেকে গজনি সাম্রাজ্যের ভারতীয় অংশের শাসক করে পাঠান এবং আবু নাসর্ পার্সিকে তার সহযোগি করেন। আবু নাসর্ ছিল কবি মাসউদের পুরনো বন্ধু। তিনি কবি মাসউদকে চালান্দর অঞ্চলের শাসক করেন। কিন্তু বেশি দিন না যেতেই পার্সির বিরুদ্ধে মারাত্মক অভিযোগ ওঠে। ফলে তাকে ও তার সব বন্ধুকে কারাগারে পাঠানো হয়। এবার মারাঞ্জ নামাক দূর্গে বন্দি হন কবি মাসউদ। এখানে তিনি ৮ বছর ছিলেন।
কোনো কোনো সূত্রমতে জীবনের শেষ কয়েক বছরে কবি মাসউদ বিচারকের কাজ ছেড়ে দিয়ে আত্মশুদ্ধি, ইবাদত ও আধ্যাত্মিক সাধনায় মগ্ন হয়েছিলেন। কিন্তু প্রামাণ্য নানা তথ্য-সূত্র থেকে জানা যায় মাসউদ কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার পর রাজকীয় পদ বা বড় পদবীর পেছনে না ছুটলেও রাজ-দরবার পরিত্যাগও করেননি। জীবনের শেষ বছরগুলোতে তিনি গজনির মাসউদ পাঠাগার নামক বিশাল পাঠাগার পরিচালনাসহ নানা সাংস্কৃতিক কাজে ব্যস্ত ছিলেন। মাসউদ সাদ সালমান হিজরি ৫১৫ বা ৫১৬ সনে তথা খ্রিস্টিয় ১১২১ বা ১১২২ সনে গজনিতে মারা যান বলে মনে করা হয়। ফার্সি, আরবি ও হিন্দি ভাষায় তিনটি কাব্য বা দিওয়ান রেখে গেছেন কবি মাসউদ সাদ সালমান। কিন্তু বর্তমান যুগে কেবল তার ফার্সি কাব্যটি ও তার কিছু আরবি কবিতা টিকে আছে। তার অনেক কবিতায় নানা দুঃখ ও বেদনার রস খুব মর্মস্পর্শী ভাষায় তুলে ধরা হয়েছে। এসব কবিতা পাঠকের চোখে অশ্রু নিয়ে আসে।#
পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ০১
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।