ডিসেম্বর ০৫, ২০২০ ১৬:৪০ Asia/Dhaka

আজ আমরা ইরানের বিখ্যাত সুফি-সাধক ও আরেফ এবং মরমি কবি নুরউদ্দিন আবদুর রহমান জামি’র জীবন নিয়ে কথা বলব।

মাওলানা নুরউদ্দিন আবদুর রহমান জামি ছিলেন হিজরি নমব শতকের বা খ্রিস্টিয় পঞ্চদশ শতকের বিখ্যাত মরমী কবি, লেখক ও সুফি-সাধক। তাঁর খ্যাতি কেবল তৎকালীন ইরান ও আশপাশের অঞ্চলেই সীমিত থাকেনি। জামির খ্যাতি গোটা পশ্চিম এশিয়া, এশিয়া মাইনর, মধ্য এশিয়া ও ভারত উপমহাদেশেও ছড়িয়ে পড়েছিল। বিশ্ববিশ্রুত এই কবির জন্ম হয়েছিল তৈমুরি শাসনামলে ইরানের খোরাসান প্রদেশের  জ’ম অঞ্চলে ৮১৭ হিজরি বা ১৪১৪ খ্রিস্টাব্দে। বলা হয় ৭ নভেম্বর তার জন্মদিন।

 গবেষকদের অনেকেই মনে করেন ফার্সি সাহিত্যে মহাকবি হাফেজের পর জামি হলেন সবচেয়ে বড় বাক্য-বাগীশ। তাঁর পূর্বপুরুষরা ইস্ফাহানে বসবাস করতেন। তাতার তুর্কিদের হামলার প্রেক্ষাপটে সৃষ্ট নৈরাজ্যের সময় তারা খোরাসানে হিজরত করতে বাধ্য হন এবং জ’ম অঞ্চলের খারজের্দ বা খারগের্দ গ্রামে বসবাস করতে থাকেন। অবশ্য জামির বাবা তার এই ছেলের জন্ম নেয়ার কয়েক বছর আগেই সপরিবারে হেরাতে যান ও সেখানেই স্থায়ীভাবে থেকে যান। এই পরিবার যতদিন জ’ম অঞ্চলে ছিল ততদিন পর্যন্ত পারিবারিক নাম হিসেবে দাশতি শব্দটি ব্যবহার করত। কিন্তু হেরাতে চলে আসার পর থেকে তারা পারিবারিক নাম হিসেবে জামি ব্যবহার করতে থাকেন। 

জ’ম অঞ্চলের খারজের্দ বা খারগের্দ সে যুগে হেরাতেরই অংশ ছিল। আর হেরাত ছিল বৃহত্তর খোরাসান বা প্রাচীন খোরাসানের অংশ। খারজের্দেই প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করেন জামি। বাবার কাছেই তিনি ফার্সি সাহিত্য এবং আরবি ব্যকরণ চর্চা করেছেন। পরে উচ্চ শিক্ষা অর্জনের জন্য বাবার সঙ্গেই চলে আসেন হেরাতে। হেরাত বর্তমানে আফগানিস্তানের অংশ। সে যুগে নিযামিয়া ছিল হেরাতে জ্ঞান-বিজ্ঞান শেখার অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। এখানেই জামি বড় বড় শিক্ষকদের কাছে আরবি ভাষা ও সাহিত্য, যুক্তিবিদ্যা, দর্শন, গণিত ও ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে পড়াশুনা করেছেন। আরও বেশি জ্ঞান অর্জন ও খ্যাতিমান শিক্ষকদের কাছে পড়ার আগ্রহ জামিকে সমরকন্দ অঞ্চলে টেনে নিয়ে যায়। সে যুগে সমরকন্দ ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্যের বিশ্বখ্যাত কেন্দ্র। অসাধারণ মেধা, প্রখর স্মৃতিশক্তি ও যুক্তি তুলে ধরার ক্ষমতা জামিকে উজ্জ্বল তারকার খ্যাতি এনে দেয়। যুক্তিবিদ্যা, দর্শন, ইসলামী আইন, হাদিস, গণিত, জীববিজ্ঞান ও সঙ্গীতে তিনি বড় ধরনের বিশেষজ্ঞ ছিলেন বলে গবেষকরা মনে করেন।  এইসব শাস্ত্রে পারদর্শী হওয়ার পর জামি ঝুঁকে পড়েন ইরফান বা  রহস্যময় খোদাপ্রেম-তত্ত্বের দিকে। আর এই আগ্রহ তাকে আবারও হেরাতে ফিরিয়ে আনে। এখানে অভিজ্ঞ ও খ্যাতিমান আরেফদের কাছে তিনি সুফিবাদ ও খোদাপ্রেমের তালিম নিতে থাকেন এবং সা’দউদ্দিন মোহাম্মাদ কাশগরির শিষ্য হন। আধ্যাত্মিক খোদা-প্রেম সাধনায় তিনি এতটাই অভিজ্ঞ হন যে তার মুর্শিদ কাশগরির মৃত্যুর পর তিনিই হন নাক্‌শবান্দ তরিকার প্রধান গুরু।

আধ্যাত্মিক খোদা-প্রেম সাধনার ক্ষেত্রে তিনি মহিউদ্দিন আরাবির সুফি-তত্ত্বের অনুরাগী ও অনুসারী ছিলেন। খ্রিস্টিয় পঞ্চদশ শতকে বা হিজরি নবম শতকে ইরফান ও সুফিবাদে বেশ বিচ্যুতি দেখা দেয়া সত্ত্বেও জামি ইরানি ইরফানকে জ্ঞান-ভিত্তিক আদর্শ ও জ্ঞান-কেন্দ্রীকতার ওপর ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। আর এক্ষেত্রে তিনি ব্যবহার করেছেন তার কবিতা ও বিশুদ্ধ রচনাবলী। জামিকে ফার্সি ভাষার শীর্ষস্থানীয় মরমি কবি বলে মনে করা হয়। জামি ইরফান শিক্ষা দেয়ার ক্ষেত্রে আগ্রহী ছাত্রদেরকে সরাসরি নির্দেশনা দিতেন না ও নসিহত করতেন না। বরং আচার-আচরণের মাধ্যমে তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিতেন। তার এ পদ্ধতি সমাজে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।

জামি ছিলেন খুবই বিনয়ী ও ভদ্র । তিনি দরিদ্রতম লোকদের সঙ্গে চলাফেরা করতেন ও তাদের সঙ্গে বসে খাবার খেতেন। তার পোশাক-পরিচ্ছদও ছিল খুবই সাদা-মাটা। মাটিতে বসতেন এবং এ রকম অবস্থায় বন্ধু ও ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলতেন। সুলতানদের দরবারেও তার বিশেষ মর্যাদা ছিল।

অধ্যাপক ডক্টর জাররিনকুবের মতে আবদুর রহমান জামি যদিও সুলতান ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন একজন দরবেশ ও মরমি কবি, কিন্তু তিনিই ছিলেন হেরাতের আধ্যাত্মিক সুলতান! সুলতানরা ও মন্ত্রীরা তাকে সমীহ করতেন।  আমির আলিশির নাওয়ায়ির মত মন্ত্রী ও সুলতান বয়কারোর মত সুলতান এবং মোগল সম্রাট বাবর তাকে সম্মান করতেন জ্ঞানী সাহিত্যিক ও আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে। বড় বড় জীবনীকাররা শ্রদ্ধাভরে তার নাম লিখে গেছেন।

জামি ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দের ৯ নভেম্বর তথা হিজরি ৮৯৮ সনের ১৮ মহররম ৮১ বছর বয়সে হেরাত শহরে ইন্তেকাল করেন।  সেখানে তার গুরু সা’দউদ্দিন কাশগরির মাজারের পাশেই তাকে দাফন করা হয়। জামির কবরটি বর্তমান যুগে তাখত্‌ মাজার নামে খ্যাত। তার দাফন অনুষ্ঠানে সুলতান বয়কারো ও মন্ত্রী আমির আলীশির নাওয়ায়িসহ রাষ্ট্রীয় উচ্চপদস্থ সব কর্মকর্তা ও সর্বস্তরের জনগণ উপস্থিত হয়েছিলেন।#

পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ০৫

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। 

ট্যাগ