ফেব্রুয়ারি ০৩, ২০২১ ১৭:১০ Asia/Dhaka

ইরানের ইসলামী বিপ্লব বর্তমান শতাব্দিতে ইসলামের রাজনৈতিক ও আধ্যত্মিক শক্তির প্রবল উত্থানকে বিশ্বের চিন্তাশীল ও মুক্তিকামী জাতির কাছে অনেকাংশে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে।

ইরানের ইসলামী বিপ্লবের আগে বিশ্বব্যাপী যে দুটি প্রধান রাজনৈতিক ধারা বিশ্বের দেশগুলোর ওপর কর্তৃত্ব করছিল তা হল ধর্মনিরপেক্ষতাকেন্দ্রীক পুজিবাঁদী লিবারেল বা কথিত উদারনৈতিক গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র বা কমিউনিজম। প্রথমটিতে ধর্মকে ধরা হত কেবলই ব্যক্তিগত বিষয় বা সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রান্তিক ও প্রায় প্রভাবহীন একটি বিষয়। আর সমাজতন্ত্রে ধর্ম বা ধর্মাচারের কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিই ছিল না এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নাস্তিক্যবাদী এই মতাদর্শে রাষ্ট্র ও সমাজ-জীবনে ধর্মকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল ও ধর্মকে উপহাস করে বলা হত আফিম। কিন্তু মহান ইমাম খোমেনীর নেতৃত্বে ইরানের ইসলামী বিপ্লব বিশ্বের এ পরিস্থিতিকে বেশ নড়বড়ে করে দেয়। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট সমাজ-বিজ্ঞানী, ইসলামী চিন্তাবিদ, গবেষক ও বিশ্লেষক অধ্যাপক ডক্টর রাশিদ বেনআইসসা  বলেছেন: 'আমি ইরানের মুসলিম জাতি ও বিশ্বের মুসলমানদের অভিনন্দন জানাতে চাই বিশ্বকে এমন এক মহান ব্যক্তিত্বকে উপহার দেয়ার জন্য যাকে বলা হয় ইমাম খোমেনী। তিনি বিশ্বের জন্য মহান আল্লাহর এক বড় উপহার। তার নাম ‘রুহুল্লাহ’ তথা মহান আল্লাহর অনুপ্রেরণা যা তাঁর পক্ষ থেকে আসে বিশ্ব-জগতে। -ইরানের ইসলামী বিপ্লব এর সূচনালগ্ন থেকেই বিশ্ব নেতৃবৃন্দের আলোচনার মূল ফোকাসে রয়েছে। সাবেক মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন, ইরানের ইসলামী বিপ্লব কমিউনিস্ট বিপ্লবের পর সবচেয়ে বড় ভূমিকম্প।' ডক্টর রাশিদ বেনআইসসা আরো বলেছেন:

'কমিউনিস্ট বিপ্লব ছিল ইউরোপীয় সংস্কৃতির ভেতরে একটি কলঙ্ক। কার্ল মার্কস ছিলেন জার্মান। পশ্চিমা সংস্কৃতির ভেতরেই ঘটেছিল কমিউনিস্ট বিপ্লব। কিন্তু ইমাম খোমেনী (র) এসেছেন বাইরের অঞ্চল থেকে। তিনিই আধুনিক যুগে প্রথমবারের মত পশ্চিমা সংস্কৃতির কর্তৃত্ব ও আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। ফলে প্রথমবারের মত পশ্চিমা সংস্কৃতি নিজের ওপর সন্দিহান হয়। বড় বড় নৃতত্ববিদদের অনেকেই এ বিষয়ে অনেক প্রবন্ধ লিখেছেন। তাদের একজন ছিলেন ফ্রান্সে। তিনি বলেছেন, ‘আমরা মুসলমানদের নিন্দা করছি ‘মৌলবাদের’ জন্য। কিন্তু এর বিরোধিতা করার মতো কী রয়েছে আমাদের কাছে?... মূল্যবোধের দিক থেকে আমাদের কিছুই নেই তুলে ধরার মতো। যখন ইমাম খোমেনী জাগিয়ে তুলতে এলেন আমরা তখন সমাজে ধর্মীয় পবিত্রতার বিষয়ে বিতর্ক করছি। কারণ আমরা ব্যক্তিগত জীবন ছাড়া সব কিছু থেকেই ধর্মীয় পবিত্রতাকে ধুয়ে ফেলেছি।’
অধ্যাপক ডক্টর রাশিদ বেনআইসসা আরো  বলেছেন: সে সময় ইংল্যান্ডে আমি একটি বই পড়েছিলাম। বইটার নাম ছিল, ‘বিধাতার দাফন বা শেষকৃত্য’। ভেবে দেখুন ধর্মের কি অবস্থান ছিল তখন! অর্থাৎ ধর্মীয় কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে তখনও চলছিল মানুষের বিদ্রোহ। পশ্চিমা সমাজ-ব্যবস্থায় মহান স্রস্টার কোনও ভূমিকা ছিল না সে সময়। আর এ অবস্থায় মুসলিম সংস্কৃতিতে জন্ম-নেয়া এক ব্যক্তি এগিয়ে এসে বললেন, না, সমাজে আল্লাহর ভূমিকা রয়েছে।  আর তা হচ্ছে কর্তৃত্বকামী অবস্থান। এটা হচ্ছে সরকারের অবস্থানের চেয়েও উঁচু অবস্থান তথা সর্বোচ্চ অবস্থান। সরকার এই অবস্থানের অধিকারী নয়। সরকার এ প্রশ্নের উত্তর দেয় যে কিভাবে পরিচালনা ও শাসন করতে হবে। কিন্তু কোন্‌টি ভালো ও কোন্‌টি খারাপ তা বলে দেন সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ। 

ডক্টর রাশিদ বেনআইসসা আরো বলেছেন: সরকার দৈনন্দিন নানা সমস্যার সমাধান দেয়।কিন্তু ওলিয়ে ফকিহ বা সর্বোচ্চ ইসলামী আইনবিদ হচ্ছেন এমন একজন জ্ঞানী ব্যক্তি যিনি খোদায়ী কর্তৃত্ব বা সার্বভৌমত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। তিনি পুনরুদ্ধার করেছেন সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের সেই ভূমিকা যার মাধ্যমে সমাজের মূল্যবোধগুলো সম্পর্কে বৈধতা ও দিক-নির্দেশনা দেয়া যায়। আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের অধিকারী হওয়ার পাশাপাশি তিনি একজন জ্ঞানী ব্যক্তি। তিনি একজন আরেফ। তিনি সেই বিরল ব্যক্তিদের একজন যিনি পুনর্গঠন করেছেন এরফান যাকে বলা হয় তাসাওউফ যাতে রয়েছে জ্ঞান, যুক্তি ও রাষ্ট্র। এইসব ব্যক্তিগত যোগ্যতার দিক ছাড়াও ইমাম খোমেনীর ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী ইচ্ছাশক্তি। ফলে তিনি ছিলেন আপোষহীন। সবাই তাকে কিছুটা নমনীয় ও কম উচ্চকিত হওয়ার পরামর্শ দিলেও তিনি কখনও আপোষ করতেন না।
অধ্যাপক ডক্টর রাশিদ বেনআইসসা আরো  বলেছেন: 
হ্যাঁ, ইনিই ছিলেন ইমাম খোমেনী যিনি বদলে দিয়েছেন বিশ্বকে। আমরা দেখছি এখন সারা বিশ্বে তার প্রভাব। তার অনুসারীরা তার দেখানো ওই পথেই চলছেন এবং ইরানের বর্তমান সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ীও চলছেন সেই পথেই কিছু ঘরোয়া অনিবার্য অনিয়ম সত্ত্বেও। কারণ, সব ইরানিকেই পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। বাইরের প্রচারমাধ্যমগুলোর প্রভাবে অনেকেই বিভ্রান্ত হন। এসব প্রচারমাধ্যম বিকৃত খবর পরিবেশনসহ নানাভাবে বাস্তবতাকে বিকৃতভাবে তুলে ধরে। কিন্তু এখনও ইরানের ক্ষমতা রয়ে গেছে ইমাম খোমেনী (র)’র হাতেই। আর এ জন্যই ইরানের নেতৃবৃন্দকে বজায় রাখতে হচ্ছে স্বাধীনচেতা মনোভাব ও নতজানু না হওয়ার এবং সব সময় মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার দিকে লক্ষ্য রাখার প্রবণতা।
সবাই যখন মরহুম ইমাম খোমেনীকে পরামর্শ দিচ্ছিলেন ইহুদিবাদী ইসরাইলের সঙ্গে ইরানের রাষ্ট্রীয় ও কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন না করার তখন তিনি তাদের এই উপদেশে কান দেননি। অনেক ইরানিও এ পরামর্শ দিয়েছিলেন তাকে। তাদের যুক্তি ছিল এটা যে যখন বিশ্বের বৃহত্তম অনারব সুন্নি রাষ্ট্র তুরস্ক ইহুদিবাদী ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখছে এবং এই দখলদার ও বর্ণবাদী শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক রাখছে বিশ্বের বৃহত্তম আরব রাষ্ট্র মিশরও তখন আমরা কেন আমাদের দেশকে বিপদের দিকে ঠেলে দেব? কিন্তু ইমাম খোমেনী তাদের এ পরামর্শে কান না দিয়ে ইসরাইলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করলেন।

মরহুম ইমাম খোমেনীর আপোষহীন ইসলামী ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে ডক্টর রাশিদ বেনআইসসা আরো বলেছেন: ইসলামী ইরান বিগত ৪০ বছরে পশ্চিমা শক্তিগুলোর চাপে সৃষ্ট বিচ্ছিন্নতার যে সমস্যায় ভুগছে তার অবসান কেবল একটি আহ্বানেই হতে পারত। ইরানি প্রেসিডেন্ট আহমাদিনেজাদ যদি ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে বলতেন যে আমরা তোমাদের সেই শিল্প-কারখানাগুলোকে ফিরিয়ে দেব তোমাদের কাছে যা আমরা দিয়ে দিয়েছি ফিলিস্তিনিদেরকে, তাহলে তারা ইরানের এ সমস্যার সমাধান করতো। কিন্তু ইমাম খোমেনী এ বিষয়কে একটি রেড-লাইন বা লাল-সীমানা হিসেবে ঘোষণা করে গেছেন। এই সীমার মধ্যে রয়েছে মুসলমানদের ভূমি ও ৫০ লাখ ফিলিস্তিনি শরণার্থীর ভাগ্য, ইত্যাদি। অর্থাৎ এসব বিষয়ে কোনও আপোষ করা যাবে না। আর এটাই হল ইসলামের ইচ্ছাশক্তি যা আপোষহীন ও অদম্য। আর এই মহান ব্যক্তিকেই উপহার দিয়েছে ইসলাম ও মুসলমানরা বিশ্বের কাছে।

পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আবু সাঈদ/০৩

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ