পাশ্চাত্যে জীবন ব্যবস্থা (পর্ব-২০)
গত আসরে আমরা পাশ্চাত্যে নারীদের অবস্থান ও নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার শ্লোগান নিয়ে কিছুটা আলোচনার চেষ্টা করেছি। আমরা বলেছি, আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলো নারী অধিকারের বড় বড় স্লোগান দিলেও নারীর প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গী মোটেও সম্মানজনক নয়।
তাই এসব দেশে প্লে-বয় ও হাসলারের মতো ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়। টপলেস বার, স্ট্রিপটিজ ও পতিতাবৃত্তি অবাধে চালু রাখা হয়েছে। হাসলার ও প্লেবয়-এর মতো ম্যাগাজিনে পতিতারা গ্রাহক সংগ্রহের জন্য নিজেদের নাম-ঠিকানা, ফোন নম্বরসহ বিজ্ঞাপন দেয়। অনেকে খোড়া যুক্তি দেন পতিতালয় থাকলে নারী ধর্ষণ ও নির্যাতন কমে। কিন্তু বাস্তবে এই দাবি ভিত্তিহীন।
উন্নত দেশগুলোতে নারীরা পুরুষের চেয়ে বেশি দারিদ্র্যে ভোগেন। পাশ্চাত্যের সমাজবিজ্ঞানীরা এখন ঠাট্টা করে বলেন, দারিদ্র শব্দটিই যেন এখন স্ত্রীলিঙ্গে পরিণত হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের টিভি চ্যানেল 'ইউরোনিউজ' গত বছর এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ইউরোপের জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে রয়েছে এবং এর মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিতে নারীরা। দারিদ্রের ঝুঁকিতে থাকা পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা এক কোটি ২০ লাখ বেশি। এমনকি বিশ্বের সবচেয়ে ধনী রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ওই সব নারী সবচেয়ে দরিদ্র যাদের সন্তান রয়েছে। মার্কিন কংগ্রেসের সদস্য ইলহান ওমর সম্প্রতি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে এক কোটি ৬০ লাখ নারী দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করেন। ২০১৫ সালে বিখ্যাত নির্মাতা কিরবি ডিক নির্মিত ডকুমেন্টারি ফিল্ম দ্য হান্টিং গ্রাউন্ড-এ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিশেষকরে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে যৌন হয়রানির বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।
ছবির নির্মাতা এই বাস্তবতা তুলে ধরেছেন যে, মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রায় এক-চতুর্থাংশ ছাত্রী একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের মাধ্যমে ক্যাম্পাসে ধর্ষণ বা যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। ওই ডকুমেন্টারি ফিল্মে তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে বলা হয়েছে, ৮০ শতাংশ ধর্ষণের ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানানো হয় না এবং ভুক্তভোগীরা পুলিশের কাছেও যান না। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সুস্পষ্ট নির্দেশনা হচ্ছে, পুলিশের কাছে যাওয়ার আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরেই বিষয়টির সমাধান করতে হবে। 'দ্য হান্টিং গ্রাউন্ড' নির্মাতারা ডকুমেন্টারির শেষাংশে দর্শকদের কাছে যে বিষয়টি তুলে ধরেছে তাহলো- হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যদি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত সব ধর্ষণের ঘটনার কথা স্বীকার করে তাহলে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি কার্যত বন্ধ হয়ে যাবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব প্রধান ছিলেন তারাও আত্মহত্যা করবেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কুইনিপাইক ইউনিভার্সিটির সমীক্ষা বিষয়ক সহকারী পরিচালক টিম মালভি ২০১৬ সালের নভেম্বরে এক হাজার ৪১৫ জনের অংশগ্রহণে পরিচালিত এক সমীক্ষার ভিত্তিতে জানিয়েছেন, কর্মক্ষেত্রে নারীরা যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। নারীদের পাশাপাশি পুরুষরাও যৌন হয়রানির শিকার হন। আমেরিকার ৮৮ শতাংশ পুরুষ এবং ৮৯ শতাংশ নারী যৌন হয়রানিকে মার্কিন সমাজের সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। জরিপের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, প্রতি ১০ জন নারীর মধ্যে ছয় জনই যৌন হয়রানির শিকার। হলিউডে যৌন হয়রানির ঘটনা এর চেয়ে অনেক বেশি। হলিউডের পরিবেশ নিয়ে পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, হলিউডের সিনেমায় তৎপর ৯৯ শতাংশ নারী ধর্ষণ এবং যৌন হয়রানির শিকার। হলিউডে যৌন কেলেঙ্কারি এতটাই বিস্তৃত যে ২০১৭ সালে 'মিটু' আন্দোলন শুরু হয়।
'মিটু' আন্দোলনের শুরুটা হয়েছিল এভাবে। হলিউডের প্রভাবশালী প্রযোজক হার্ভি ওয়াইনস্টিনের বিরুদ্ধে ৪০ জনেরও বেশি নারী যৌন নির্যাতনের অভিযোগ করেন। এরপর অনেকেই মুখ খুলতে শুরু করেন। হলিউডের বড় বড় অভিনেতা, পরিচালক, প্রযোজক, উপস্থাপক এমনকি মার্কিন রাজনীতিবিদরাও ফেঁসে যান। উঠে আসে জর্জ বুশ এবং বিল ক্লিনটনের মতো ব্যক্তিত্বদের নামও। ফাঁস হতে থাকে মার্কিন সংসদে যৌন নিগ্রহের ঘটনাও। অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস জানিয়েছে, মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের কিছু নারী সদস্য তাদের পুরুষ সহকর্মীর মাধ্যমে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। যৌন কেলেঙ্কারির ঘটনা হোয়াইট হাউসকেও নাড়া দেয়। ডেইলি মেইল লিখেছে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের আইনজীবী যৌন নিগ্রহের শিকার ১০০ জন নারীকে বিপুল অংকের অর্থ দিয়েছেন যাতে তারা ট্রাম্পের সাথে তাদের যৌন সম্পর্কের কথা প্রকাশ না করে।
নারীদের অনিরাপত্তা কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, ইউরোপেও বিভিন্ন পেশার নারীরা এই সমস্যার সম্মুখীন। যদিও প্রচার চালানো হয় এবং বলা হয় যে, ব্যাপক আইনি সুরক্ষার কারণে ইউরোপীয় দেশগুলো কম ঝুঁকিতে রয়েছে। কিন্তু নানা সমীক্ষা ও পরিসংখ্যান থেকে এর উল্টো চিত্রটিই পাওয়া যায়। ইউরোপীয় পার্লামেন্ট যারা মানবাধিকারের স্লোগান দেয় এবং অন্য দেশগুলোকেও দিকনির্দেশনা দেওয়ার চেষ্টা করে সেখানকার চিত্র একবার পর্যালোচনা করে দেখা যাক। সানডে টাইমস জানিয়েছে, ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যরা অন্তত ৮৭ জন নারী ও ছয় জন পুরুষকে যৌন নির্যাতন করেছেন। সুইডেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্গট ওয়ালস্ট্রমও 'মিটু' আন্দোলনে যোগ দিয়ে বলেছেন, "আমি নিজেও সর্বোচ্চ রাজনৈতিক স্তরে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছি।" সুইডেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন বক্তব্যে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ ইউরোপের যেসব দেশে ধর্ষণের হার সবচেয়ে বেশি সুইডেন তার একটি। এই দেশে প্রতি চারজন নারীর একজন ধর্ষণের শিকার হন।
ব্রিটিশ সংবাদপত্র দ্য গার্ডিয়ান জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থাগুলোতে কর্মরত নারীরাও ব্যাপকভাবে যৌন নিগ্রহের শিকার। তবে এই নির্যাতন ঘটে গোপনে। নির্যাতনের শিকার নারীরা দৈনিক গার্ডিয়ানকে জানিয়েছে, বিশ্বের সবচেয়ে বড় এনজিওগুলো, জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন এবং ক্ষুদ্র দাতব্য প্রতিষ্ঠানেও নারীদের যৌন হয়রানির ঘটনা ব্যাপকভাবে ঘটছে। কিন্তু এ ধরনের হয়রানি প্রতিরোধে এই সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে সুব্যবস্থা নেওয়া হয় না। পাশ্চাত্যের দেশগুলোর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং গণমাধ্যমগুলোই প্রামাণ্য তথ্য উপস্থাপন করে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, তাদের দেশে যৌন স্বাধীনতার ফলে ধর্ষণসহ যৌন নিগ্রহ কমেনি বরং বেড়েছে। কিন্তু পাশ্চাত্যের দেশগুলোর নানা মহল থেকে সব সময় এই দাবি করা হয় যে, যৌন স্বাধীনতা এবং লিঙ্গ ভিত্তিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে তারা সমাজে নারীর সক্রিয় উপস্থিতি নিশ্চিত করতে পেরেছে। আসলে এসবই শ্লোগান। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ি বলেছেন, পাশ্চাত্যে নারীকে ভোগ, সাজসজ্জা, পুরুষের সামনে প্রদর্শন ও যৌনতার প্রতীক এবং পুরুষের যৌন রোমাঞ্চ উপভোগের মাধ্যম হিসেবে গণ্য করা হয়।#
পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/ ২৫
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।