ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস (পর্ব-৫৫): পারস্য উপসাগরকেন্দ্রীক যুদ্ধ
আমরা ইরাকি শহরগুলো লক্ষ্য করে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার দাবি সম্পর্কে ইমাম খোমেনী (রহ.) কি বক্তব্য দিয়েছিলেন তা নিয়ে কথা বলেছি। আজ আমরা ইরাকের প্রতি পশ্চিমা দেশগুলোর অস্ত্র সাহায্য অব্যাহত থাকার পাশাপাশি পারস্য উপসাগরে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়া সম্পর্কে আলোচনা করব।
ইরানের আবাসিক এলাকায় ইরাকের সাদ্দাম বাহিনীর বর্বরোচিত হামলায় নারী ও শিশু নির্বিশেষ হাজার হাজার বেসামরিক নাগরিক নিহত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ইরানের কোনো কোনো মহল থেকে ইরাকেও একই ধরনের পাল্টা হামলা চালানোর দাবি জানানো হয়। কিন্তু ইসলামি ইরানের মহান নেতা ইমাম খোমেনী (রহ.) এই দাবি প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ইরাকি জনগণ এমনিতেই সাদ্দামের নির্যাতনে দুঃসহ জীবন কাটাচ্ছে। কাজেই সাদ্দাম সরকারের হামলার প্রতিশোধ ইরাকি জনগণের কাছ থেকে নেয়া ঠিক হবে না। তিনি ইসলামের সুমহান শিক্ষা তুলে ধরে বলেন, আগ্রাসন প্রতিহত করার সময়ও কাপুরুষোচিত আচরণ করা যাবে না।
যুদ্ধের এ পর্যায়ে ইরাকের আগ্রাসী সরকার ইরানের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান খাত তেল রপ্তানি বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা চালায়। ইরাকি সেনারা ইরানের তেল ট্যাংকারগুলোর পাশাপাশি পারস্য উপসাগরে অবস্থিত ইরানের তেল ভাণ্ডার ও সমুদ্রবন্দরগুলোর ওপর হামলা চালাতে শুরু করে। এসব হামলা নিখুঁতভাবে পরিচালনা করার জন্য ফ্রান্স সরকার বাগদাদকে সামরিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা করে। প্যারিস ১৯৮৩ সালের অক্টোবর মাসে পাইলটসহ পাঁচটি সুপার এটেনডার্ড যুদ্ধবিমান বাগদাদের হাতে তুলে দেয়।
ফ্রান্সের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্লোদ চেসন জঙ্গিবিমান হস্তান্তর সম্পর্কে পরবর্তী সময়ে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ইরাক-ইরান যুদ্ধে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে প্যারিস সে সময় এ কাজ করেছিল।
ফরাসি যুদ্ধবিমানগুলো হাতে পাওয়ার পর পারস্য উপসাগরে ইরানি বাণিজ্যিক জাহাজগুলোর ওপর ইরাকের হামলা চালাতে সুবিধা হয়। এভাবে যুদ্ধের শুরু থেকেই ইরাকের সাদ্দাম সরকারকে নানাভাবে সহযোগিতা করে আসছিল ফ্রান্স। এর পাশাপাশি ফ্রান্স ইরানের ইসলমি সরকার বিরোধী সন্ত্রাসী মোনাফেকিন গোষ্ঠীর সদস্যদেরকে আশ্রয় দেয় এবং তাদেরকে ইরানের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ইরাকে পাঠানোর ব্যবস্থা করে।
ইমাম খোমেনী (রহ.) ফ্রান্সে মোনাফেকিন গোষ্ঠীকে আশ্রয় দেয়ার প্রতিক্রিয়ায় ১৯৮৩ সালের ২০ নভেম্বর এক ভাষণে বলেন, ফরাসি জাতির জেনে রাখা উচিত তারা তাদের অতীত ইতিহাস নিয়ে যত গর্বই করুক বর্তমান ফ্রাঁসোয়া মিতেরঁ সরকার তাদের মানসম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিচ্ছে। তাদের উচিত এখনই এই সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার ব্যবস্থা করা।
ইরাকি বাহিনী ফ্রান্সের জঙ্গিবিমান দিয়ে ইরানের তেল ট্যাংকার ও সমুদ্রবন্দরগুলোতে হামলা চালাতে থাকে। এর ফলে ধ্বংসপ্রাপ্ত তেল ট্যাংকার থেকে সাগরে তেল ছড়িয়ে পড়ে এবং পরিবেশের ক্ষতি হয়। রাজধানী তেহরান, আবাদান, সিরাজ ও কেরমানশাহে অবস্থিত ইরানি তেল শোধনাগারগুলোতে ইরাকের বিমান হামলার ফলে এসব কেন্দ্রের ব্যাপক ক্ষতি হয় এবং ইরানের তেলজাত পণ্য উৎপাদন অর্ধেকের নীচে নেমে আসে। যুদ্ধে ইরানের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দিন দিন বাড়তে থাকে। ১৯৮৩ সালের ১৬ জানুয়ারি ইরানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ইরানের তেল স্থাপনাগুলোতে ইরাকি হামলা ও তেল রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ইরান তখন পর্যন্ত পাঁচ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল।
ইরানের তেল রপ্তানির প্রধান বন্দর ‘খার্ক’-এর ওপর যুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ইরাকি বাহিনী ধারাবাহিকভাবে হামলা চালিয়ে যায়। এর প্রতিক্রিয়ায় ইরান ওই বন্দরে নিজের সবচেয়ে শক্তিশালী আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোতায়েন করে। ফলে ইরাকি বিমান হামলা অনেকাংশে প্রতিহত করা সম্ভব হয়। আগ্রাসী সাদ্দাম বাহিনীর হামলা সত্ত্বেও যুদ্ধের আট বছরে খার্ক বন্দর থেকে ইরানের তেল রপ্তানি কখনোই বন্ধ হয়নি। সে সময় ইরান ঘোষণা করে, দেশটি মধ্যপ্রাচ্যসহ পারস্য উপসাগরে শান্তি স্থাপনের পক্ষপাতী। কিন্তু যদি বলপূর্বক ইরানের তেল রপ্তানি আটকে দেয়া হয় তাহলে তেহরান হরমুজ প্রণালী দিয়ে পারস্য উপসাগরীয় কোনো দেশের তেল রপ্তানি করতে দেবে না। ইরানের এই হুমকির ব্যাপারে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।
জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ১৯৮৩ সালের ৭ আগস্ট তেহরান সফরে এসে ইরানের সংসদ স্পিকারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে যুদ্ধ বন্ধ করার আহ্বান জানান। ইরান জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানিয়ে দেয়, তেহরান যুদ্ধ বন্ধ করতে রাজি আছে তবে সেজন্য ইরানের শর্তাবলী মেনে নিতে হবে। এ সময় জাপান ইরাককে যে ২০০ কোটি ডলারের ঋণ দিচ্ছিল তেহরান তা বাগদাদকে না দিতে টোকিওর প্রতি আহ্বান জানায়। কিন্তু জাপান দাবি করে, এই অর্থ যুদ্ধের কাজে ব্যয় হবে না বলে দিতে কোনো বাধা নেই। এভাবে যুদ্ধের সময় জাপানও ইরাকের আগ্রাসী সরকারকে অর্থের চালান দিয়ে কার্যত বাগদাদকে যুদ্ধ করতে সাহায্য করে।
যুদ্ধের ময়দানে ইরানের হাতে ইরাক কোণঠাসা হয়ে পড়লে সাদ্দামের সহযোগীরা সরাসরি তেহরানের মোকাবিলায় নেমে পড়ে। পারস্য উপসাগরীয় শেখশাসিত দেশগুলো ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইরাককে সহযোগিতা করার জন্য এ অঞ্চলে সেনা পাঠাতে আমেরিকাকে অনুরোধ জানায়। মার্কিন সরকার এই সুযোগের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করে এবং পেন্টাগন পারস্য উপসাগরে নিজের স্বার্থ রক্ষার লক্ষ্যে একটি পরিকল্পনা তৈরি করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ‘র্যাপিড রিঅ্যাকশন ফোর্স’ নামের একটি বাহিনী গঠন করা হয়। আমেরিকা দুই হাজার মেরিন সেনার একটি বাহিনীকে লেবানন থেকে ভারত মহাসাগর হয়ে পারস্য উপসাগরে পাঠায়। সেইসঙ্গে ১৯৮৩ সালের অক্টোবরে মার্কিন বিমানবাহী রণতরী রেঞ্জারসহ আরো ছয়টি যুদ্ধজাহাজকে ভারত মহাসাগরে পাঠানো হয়।
ইরানের আবাসিক এলাকা ও পারস্য উপসাগরে সেদেশের তেল ট্যাংকারগুলোর ওপর ইরাকি হামলা বেড়ে গেলে জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব পেরেজ ডে কুয়েইয়ার ইরান ও ইরাকে একটি তদন্তকারী দল পাঠান। এই প্রতিনিধিদল ইরাকি বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইরানের বেসামরিক স্থাপনা ও আবাসিক ভবনের ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ দিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ৫৪০ নম্বর প্রস্তাব অনুমোদন করে। জায়ারে, টোগো এবং গায়ানার পক্ষ থেকে এই প্রস্তাবের খসড়া তৈরি করা হয় এবং ১৯৬৩ সালের ৩১ অক্টোবর নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাবটি অনুমোদিত হয়। প্রস্তাবের পক্ষে ১২ ভোট পড়ে এবং মাল্টা, পাকিস্তান ও নিকারাগুয়া এতে ভোটদানে বিরত থাকে। ইরাক-ইরান যুদ্ধ সম্পর্কে এটি ছিল জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের চতুর্থ প্রস্তাব যাতে প্রথমবারের মতো যুদ্ধে দায়ী পক্ষকে চিহ্নিত করার আশ্বাস দেয়া হয়। সেইসঙ্গে ইরান ও ইরাকের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে যুদ্ধ বন্ধের উপায় খুঁজে বের করার জন্য জাতিসংঘ মহাসচিবের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।#
পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ / ২৫
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।