পাশ্চাত্যে জীবন ব্যবস্থা (পর্ব-২১)
যেকোনো সমাজেই শিশুরা নানা দিক থেকে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির সম্মুখীন। শিশুরা শরীর ও মনের দিক থেকে যেমন ছোট তেমনি তাদের শক্তি ও সক্ষমতাও কম। অন্যের সহযোগিতা তাদের সবচেয়ে বেশি জরুরি।
সুশিক্ষা, সুপরামর্শ, সুপ্রশিক্ষণ ও সঠিক দিকনির্দেশনা না পেলে সব দিক থেকে ক্ষতির শিকার হওয়ার আশঙ্কা তাদেরই বেশি। এ কারণে সারা বিশ্বেই এখন কম-বেশি শিশু অধিকার নিয়ে কাজ হচ্ছে। পাশ্চাত্যের দেশগুলোর পক্ষ থেকে এ বিষয়ে বড় বড় বুলি শোনা যায় সবচেয়ে বেশি। পাশ্চাত্যের দেশগুলো শিশু অধিকারের বিষয়ে বড় বড় কথা বললেও সেদেশেরই বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরিসংখ্যান এবং প্রতিবেদনগুলোতে ভিন্ন চিত্র লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পাশ্চাত্যে বসবাসকারী শিশুরা কি সত্যিই সুখী? তারা কি সত্যিই প্রত্যাশিত আনন্দময় জীবনের অধিকারী?
বর্তমানে পাশ্চাত্যে শিশুরা সবচেয়ে বড় যে সমস্যাগুলোর সম্মুখীন তার উৎস হচ্ছে নৈতিক অবক্ষয়। ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ান ২০১৫ সালের এপ্রিলে ব্রিটেনে শিশু নির্যাতনের বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে ব্রিটেনে ক্রমেই শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে চলেছে, সেখানকার অধিবাসীদের একটা অংশ শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতনকে অত্যন্ত উপভোগ্য বলে মনে করে। শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতন সংক্রান্ত আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও শাস্তির উপযুক্ত ব্যবস্থা না থাকায় এই প্রবণতা বাড়ছে। পত্রিকাটি আরও লিখেছে, ব্রিটেনে প্রতি ছয়টি ছেলে শিশুর মধ্যে একটি শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। মেয়ে শিশুদের ক্ষেত্রে এ পরিসংখ্যান আরও ভয়াবহ। প্রতি চারটি মেয়ে শিশুর মধ্যে একজন যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। দৈনিক গার্ডিয়ানের এই প্রতিবেদনে গণধর্ষণ, মানব পাচার ও শিশু নির্যাতনের মতো অন্যায় কাজে কোনো কোনো সরকারি কর্মকর্তার পৃষ্ঠপোষকতা ও সরাসরি জড়িত থাকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
জার্মানিতেও শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের হার অনেক বেশি। জার্মান পুলিশ এক প্রতিবেদনে বলেছে, সেদেশে প্রতিদিন ৪০টি শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। জার্মান ফৌজদারি পুলিশ বা পিকেএস'র এ সংক্রান্ত পরিসংখ্যান তুলে ধরেছে সুদডয়েচে যেইতুং। সেখানে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে জার্মানিতে ১৪ হাজারের বেশি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এসব শিশুর প্রতি ১০ জনের মধ্যে একজনের বয়স ছয় বছরেরও কম। জার্মান পুলিশের পরিসংখ্যানে আরও বলা হয়েছে, শিশুদের বিরুদ্ধে এ ধরণের অপরাধের হার প্রতিবেদনে উল্লেখিত পরিসংখ্যানের চেয়ে অনেক বেশি, কারণ বেশিরভাগ শিশু তার পরিবারের সদস্য, বন্ধুবান্ধব এবং স্বজনদের মাধ্যমে যৌন হয়রানির শিকার হয়, যার ফলে শিশুদের ওপর এই নির্যাতনের তথ্য খুব একটা ফাঁস হয় না। পুলিশের কাছে অভিযোগও দায়ের হয় তুলনামূলক কম।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিশু ধর্ষণের চিত্র আরও ভয়াবহ। মার্কিন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান দেখা যাচ্ছে, প্রতি আট মিনিটে একটি শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। আমেরিকান লিগ্যাল সেন্টার ফর ভিকটিমস, শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতনের বিষয়ে পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, প্রতিবছর আমেরিকায় শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতন সংক্রান্ত ঘটনা ঘটে প্রায় ৯০ হাজার। তবে বাস্তবে এ সংখ্যা আরও বেশি। অনেক ঘটনার তথ্যই কখনোই ফাঁস হয় না। দুর্ভাগ্যক্রমে আজ বিশ্বের অনেক দেশেই শিশু নির্যাতনের ঘটনা বাড়ছে। কিন্তু শিশু নির্যাতন এমন একটি অপরাধ যা প্রতিটি বিবেকবান মানুষকে কষ্ট দেয়। বিভিন্ন পন্থায় শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। শারীরিক নির্যাতন ও খারাপ ব্যবহার এর অন্যতম। ফ্রান্সে, শিশুদের বিরুদ্ধে বাবা-মায়ের সহিংসতা মারাত্মকভাবে বেড়েছে, এ কারণে সেখানে প্রতিদিন গড়ে দু'টি শিশু মারা যাচ্ছে। এ কারণে বাবা-মায়েরাও যাতে তার সন্তানদের শারীরিক শাস্তি দিতে না পারে সে ব্যবস্থা নিয়েছে সেদেশের সংসদ। এ ধরণের শাস্তিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু পারিবারিক সহিংসতা আইনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন।
শিশুরাও বর্ণবেষম্যের শিকার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেসব শিশু সহিংসতার শিকার হয় তাদের বেশিরভাগই কৃষ্ণাঙ্গ। রাষ্ট্রীয়ভাবেও কৃষ্ণাঙ্গ শিশুদের প্রতি বৈষম্য করার ঘটনা ঘটছে অহরহ। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যে শত শত কিশোর-কিশোরীকে অন্যায়ভাবে প্রাপ্তবয়স্ক গণ্য করে বিচার করা হয়েছে যদিও তারা প্রাপ্তবয়স্ক ছিল না। এসব কিশোর-কিশোরীকে প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে গণ্য করার কারণে তাদের উপর অনেক কঠিন শাস্তি চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। কারণ প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য যেকোনো অপরাধের শাস্তি শিশু-কিশোরদের তুলনায় অনেক বেশি। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, তারা এক হাজার পাঁচশ' শিশু-কিশোরের সঙ্গে এ ধরণের অন্যায় আচরণের তথ্য রেকর্ড করেছেন যাদের বেশিরভাগই কৃষ্ণাঙ্গ। তাদেরকে কিশোর আদালতে বিচার না করে প্রাপ্ত বয়স্কদের আদালতে বিচার করা হয়েছে।
ইউরোপের মৌলিক অধিকার বিষয়ক সংস্থা জানিয়েছে, ইউরোপে প্রতিবছর প্রায় ২৫ লাখ শিশুকে নানা কারণে বিচার বিভাগের কাছে যেতে হয়, অনেক ক্ষেত্রেই আদালতে হাজির হতে হয়। কিন্তু শিশুদের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করতে হবে সে বিষয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ নেই। এ কারণে তারা শিশু-কিশোরদের সঙ্গে যথেচ্ছ আচরণ করে। তারা একজন ভিকটিম শিশুর সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হবে, তাদের সামনে আইনি প্রক্রিয়ার ব্যাখ্যা কীভাবে উপস্থাপন করতে হবে তা সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা জানে না। বিখ্যাত গবেষক অ্যাস্ট্রিড পোডসিয়াড্লোফোস্কি ইউরোনিউজকে এ সম্পর্কে বলেছেন, শিশু নির্যাতনের মামলায় প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে শিশুরা পুলিশকে সবকিছু খুলে বলে না কারণ তারা জানেই না মামলার বিচারিক প্রক্রিয়াতে তাদের প্রাথমিক বক্তব্যের ভূমিকা ও প্রভাব কতটুকু। কারণ তাদের সামনে এর গুরুত্ব ব্যাখ্যা করা হয় না। বেশিরভাগ শিশু নির্যাতনের মামলায় ভিকটিম শিশুই একমাত্র সাক্ষী।"
এই গবেষকের পরিচালিত সমীক্ষায় দেখা গেছে, শিশুরা বিচার প্রক্রিয়ায় তাদের নিরাপত্তার বিষয়ে আশ্বস্ত হতে পারে না। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের প্রতি আস্থা থাকে না এবং শিশু হিসেবে তারা বিশেষ সহযোগিতা পাবে এমন বিশ্বাসও তাদের মধ্যে খুব একটা জন্ম নেয় না। প্রায় চারশ' নির্যাতিত শিশুর ওপর গবেষণা চালিয়ে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন গবেষক অ্যাস্ট্রিড পোডসিয়াড্লোফোস্কি।#
পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/ ০৬
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।