পাশ্চাত্যে জীবন ব্যবস্থা (পর্ব-২২)
গত আসরে আমরা পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে শিশুদের অবস্থা নিয়ে খানিকটা আলোচনা করেছি। আজকের আসরে আমরা সেসব দেশের শিশুদের মধ্যে দারিদ্র সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার চেষ্টা করব।
কেউ কেউ মনে করেন,কেবল দরিদ্র উন্নয়নশীল দেশগুলোর শিশুরাই দারিদ্রে ভোগে। কিন্তু খোদ ইউনিসেফ বলছে,উন্নত দেশগুলোতেও দরিদ্র শিশুর সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। এর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিশুদের মধ্যে দারিদ্রের হার গোটা বিশ্বের গড় হারের চেয়েও বেশি। এর আগে জার্মান সংবাদ মাধ্যম ডয়চে ভেলে তাদের ওয়েবসাইটে ইউনিসেফের এক পরিসংখ্যান তুলে ধরে উন্নত দেশগুলোকে সতর্ক করে দিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে,উন্নত দেশগুলোতে বসবাসকারী ব্যাপক সংখ্যক শিশুও চরম দারিদ্রের মধ্যে রয়েছে। এই বিষয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থা 'সেভ দ্য চিলড্রেন'এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে,ইতালিতে কেবল ২০১৮ সালেই ১২ লাখ ৬০ হাজার শিশু চরম দারিদ্রে ভুগেছে। ইউরোনিউজ বলছে,ইতালিতে প্রতি সাতটি শিশুর মধ্যে একটি শিশু দারিদ্রের কারণে স্কুল ত্যাগ করে। বলা হচ্ছে,ছয় কোটি ১০ লাখ জনসংখ্যা অধ্যুষিত ইতালি হচ্ছে ইউরো অঞ্চলের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি।
সেভ দ্য চিলড্রেন এর প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে,ইউরোপ মহাদেশের যেসব দেশে দরিদ্র শিশুর সংখ্যা বেশি তার একটি হলো ইতালি। বিভিন্ন সূত্রের পরিসংখ্যানে বলা হচ্ছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে বসবাসকারী শিশুদের মধ্যে দারিদ্রের গড় হার ২০ শতাংশ। ফ্রান্সে প্রতি পাঁচটি শিশুর মধ্যে একজন দারিদ্র্যের শিকার। ব্রিটেনের সামাজিক মূল্যায়ন কমিশন বা এসএমসি এক রিপোর্টে জানিয়েছে,সেদেশের প্রায় সাড়ে ৪৫ লাখ শিশু দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করছে, যা মোট ব্রিটিশ শিশুর ৩৩ শতাংশ। ব্রিটেনের উত্তর-পশ্চিমের ল্যাঙ্কাশায়ারের উপকূলবর্তী মোরক্যাম্বে টাউনের একটি স্কুলের অধ্যক্ষ শিউন কলিংউড বলেছেন,তার স্কুলের শিক্ষার্থীরা সব সময় খুবই ক্ষুধার্ত থাকে। শিক্ষার্থীরা স্কুলে প্রবেশের পরপরই ডাস্টবিনে খাবার খোঁজে বেড়ায়। শিউন কলিংউড আরও জানিয়েছেন,তার স্কুলের ৩৫ জন শিক্ষার্থীর পরিবার ফুড ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ ত্রাণের খাবার খেয়ে তারা বেঁচে থাকে। তিনি আরও বলেছেন,এই স্কুলের শিক্ষাথীদের পরিবারের মধ্যে ত্রাণের খাবারের ওপর নির্ভরশীলের সংখ্যা হয়তো বাস্তবে আরও অনেক বেশি। কারণ সব পরিবারের খাদ্যের উৎস সম্পর্কে স্কুল অবহিত নয়।
এবার ইউরোপের আরেক ধনী রাষ্ট্র জার্মানি প্রসঙ্গে আসা যাক। অনেকের ধারণা অর্থনৈতিক দিক থেকে সমৃদ্ধ জার্মানির শিশুদেরকে অন্তত দারিদ্র ছুতে পারে না। কিন্তু বাস্তবতা এমনটি নয়। ধনী এই দেশটির শিশুদের মধ্যেও ক্রমেই বাড়ছে দারিদ্র। বিভিন্ন গবেষণায় ওঠে এসেছে,সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জার্মান শিশুদের মধ্যে দারিদ্র্য ২০ শতাংশ বেড়েছে। জার্মান পত্রিকা 'হানুফারশে অলগাইনা সেইতুং' সেদেশে শিশুদের মধ্যে দারিদ্র বৃদ্ধি প্রসঙ্গে লিখেছে, জার্মানিতে প্রায় ২০ লাখ শিশু ‘হার্টস-ফোর'নামের সংগঠনের সামাজিক সেবার উপর নির্ভরশীল এবং জার্মানির মতো সমৃদ্ধ দেশের জন্য শিশু দারিদ্র্যের এই হার লজ্জাজনক। জার্মানির সংবাদ মাধ্যম ডয়েচে ভেলে ইউনিসেফের একটি রিপোর্টের ভিত্তিতে সেদেশের শিশুদের মধ্যে দারিদ্র সম্পর্কে লিখেছে,অনেকেই নতুন কাপড়-চোপড়ের মুখ দেখে না,বড় ভাই-বোনদের পুরানো জামা-কাপড় পরেই জীবন চালিয়ে নিতে হচ্ছে তাদে। স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও আয়োজনে অংশগ্রহণ করাও অর্থের অভাবে সম্ভব হয় না অনেকের পক্ষে। ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় পিছিয়ে পড়তে হচ্ছে পড়াশোনায়। নেমে যাচ্ছে শিক্ষার মান। বাবা-মার অর্থাভাব থাকলে সন্তানদেরও এইভাবে বরণ করে নিতে হয় দারিদ্র্য।
জার্মানির একটি শহর গেলসেনকিয়র্শেন’র শিশু দারিদ্রের অবস্থা উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে ডয়েচে ভেলে জানিয়েছে, শহরের প্রতি তিনটি শিশুর একজন সামাজিক ভাতার ওপর নির্ভরশীল। দীর্ঘ সময় ধরে চলা নতুন এক সমীক্ষার ফলাফলে জানা গেছে,সেদেশে শিশু ও কিশোরদের বিকাশে দারিদ্র্য হল সবচেয়ে বড় ঝুঁকি। সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ছেলে-মেয়েদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক সংখ্যকই আর্থিক টানাটানির মধ্যে বসবাস করে। এর প্রধান কারণ মা-বাবার বেকারত্ব। আর বেকারত্বের পেছনেও রয়েছে নানা কারণ,যেমন প্রয়োজনীয় শিক্ষার অভাব,দীর্ঘ দিনের অসুস্থতা কিংবা শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধকতা। এছাড়া অভিবাসীদের সন্তানদেরও অনেক সময় পড়তে হয় দারিদ্র্যের কবলে। ৯০-এর দশকের শেষ দিকে শ্রমিক কল্যাণ সমিতি আভোর উদ্যোগে শুরু হয় ঐ সমীক্ষাটি। ছয় বছর বয়স্ক প্রায় এক হাজার ছেলেমেয়েকে নিয়ে গবেষণাটি চালানো হয়। কয়েক বছর ধরে এইসব ছেলে-মেয়ের সঙ্গে দেখা করে প্রশ্ন করা হয়েছে। দীর্ঘকালীন এই সমীরক্ষার ফলাফলে বলা হয়েছে, দারিদ্রের সম্মুখীন শিশুদের মধ্যে আচরণগত সমস্যা দেখা দেয়। লেখাপড়ায়ও পিছিয়ে পড়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।
জার্মানির বার্টেলসম্যান ইনস্টিটিউটের ২০১৬ সালের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,জার্মানিতে সার্বিভাবে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি হলেও শিশু দারিদ্র্যের মাত্রা বাড়ছে। জার্মানির এই প্রতিষ্ঠানটি আরও জানিয়েছে,গত বছর জার্মানিতে প্রায় ২০ লাখ শিশু দারিদ্র্যের সম্মুখীন হয়েছে এবং দারিদ্রের মধ্যদিয়েই তারা বেড়ে ওঠছে। বার্টেলসম্যান ইনস্টিটিউটের পারিবারিক নীতি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ আনতা এশটাইন এর মতে,শিশুরা যত বেশি দারিদ্রের মধ্যে থাকবে, তাদের ভবিষ্যতটাও তত ভয়াবহ পরিণতির দিকে যাবে। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে পরিবচালিত বিভিন্ন গবেষণার ফলাফলে দেখা যাচ্ছে,যেসব শিশু দারিদ্রের সম্মুখীন তাদের বৃদ্ধি ও বিকাশ স্বচ্ছল পরিবারের শিশুদের চেয়ে কম এবং এ ধরণের শিশুদের স্বাস্থ্যগত সমস্যাও বেশি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রজার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক ডেভিড পাপনোর একটি উক্তি দিয়ে আজকের আসরের সমাপ্তি টানছি। তার এই উত্তিতে উঠে এসেছে মার্কিন শিশুদের সার্বিক অবস্থা। তিনি বলেছেন,"বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণে এটা স্পষ্ট দেশের ইতিহাসে প্রথম এমনটি ঘটছে যে,বর্তমান সময়ের শিশুরা তাদের বাবামায়ের শিশুকালের তুলনায় কম সামাজিক ও মানসিক সুস্থতা ও নিরাপত্তার অধিকারী। কিশোর অপরাধ,হিংসা-বিদ্বেষ,আত্মহত্যার প্রবণতা,মাদকাসক্তি,অবৈধ সম্পর্কের কারণে জন্ম নেওয়া শিশুর সংখ্যা,মানসিক চাপ,উদ্বেগ এবং হতাশার মতো সমস্যাগুলো আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। শিশুদের কল্যাণে অনেক পদক্ষেপ নেয়ার পরও এ ধরণের সমস্যাগুলো ক্রমেই ভয়ানক রূপ নিচ্ছে।#
পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/ ১০
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।