আসমাউল হুসনা (পর্ব-২০)
মহান আল্লাহর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নাম ফাত্তাহ। এর অর্থ উন্মোচনকারী বা প্রসারক।
বৈষয়িক ও আধ্যাত্মিক যে কোনো বিষয় যখন জটিল আকার ধারণ করে বা সংকটের প্যাঁচে আটকা পড়ে তখন সেই সংকট দূর করতে সমাধানের পথ খুলে দেন মহান আল্লাহ। আর এ জন্যই মহান আল্লাহর অন্যতম নাম ফাত্তাহ। মহান আল্লাহ সব জটিল সমস্যা ও অভাব-অভিযোগ এমনভাবে সমাধান করে দেন যে কোনো মানুষ তা কল্পনাও করতে সক্ষম নয়। মানুষের মনে যদি কোনো দুঃখ-বেদনা ও হতাশা থেকে থাকে তাও মহান আল্লাহ দূর করতে পারেন এবং মহান আল্লাহ সংকট বা পরাজয়কে খুব সহজেই স্বাচ্ছন্দ্য, বিজয় ও কল্যাণে বদলে দিতে পারেন। মহান আল্লাহ ফাত্তাহ নামের সুবাদে তাঁর রহমতের দরজাগুলো খুলে দেন। সব সংকট ও বাধা দূর করার মূল চাবি রয়েছে একমাত্র মহান আল্লাহর হাতেই।
মহান আল্লাহ যখন দরিদ্রকে অর্থ সম্পদ দান করেন তখন তখন তার অভাব ও অসচ্ছলতার দুঃখ ও বিষণ্ণতা দূর হয়ে যায়। তিনিই গবেষকের মনকে জ্ঞানগত জটিল সমস্যা সমাধানের সূত্র জানিয়ে দিয়ে করেন প্রশান্ত। এভাবে মহান আল্লাহই খুলে দেন জ্ঞান-বিজ্ঞান ও ঈমানের দরজা।
আরবি ফ'তিহ শব্দটিও ফাত্তাহ'র সমার্থক। যিনি কোনো কাজের বা প্রক্রিয়ার সূচনা করেন তাকে বলা হয় ফ'তিহ। সুরা হামদ্ দিয়ে পবিত্র কুরআন শুরু হয়েছে বলে এই সুরাকে সুরা ফ'তিহ বা ফ'তিহাতুল কিতাবও বলা হয়। কোনো কিছুর চাবিকে আরবিতে বলা হয় মিফতাহ্। ফাত্হ্ শব্দটি দুই ব্যক্তির মধ্যে মধ্যস্থতা করা ও তাদের বিরোধের মীমাংসা করে দেয়া এবং কাজের পথ খুলে দেয়ার অর্থেও ব্যবহার করা হয়।
মহান আল্লাহ সুরা সাবা'র ২৬ নম্বর আয়াতে নিজেকে ফাত্তাহ বলে প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেছেন:
হে নবী! আপনি বলুন, আমাদের পালনকর্তা আমাদেরকে কিয়ামতের দিন বা বিচার-দিবসে সমবেত করবেন, অতঃপর তিনি আমাদের মধ্যে বিরোধ বা সমস্যার যথাযথ সমাধান বা ফয়সালা করবেন। তিনি সর্বোত্তম সমাধানদাতা, সর্বজ্ঞ।–
সুরা আরাফের ১৮৯ নম্বর আয়াতেও দেখা যায় পাপাচারে লিপ্ত নিজ জাতিকে সুপথে ফেরাতে মহান নবী হযরত শোয়াইব (আ) মহান আল্লাহকে বলছেন, ..... ....
হে আমাদের প্রতিপালক আমাদের ও আমাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে ফয়সালা বা ন্যায্য সমাধান করে দিন। নিশ্চয়ই আপনি শ্রেষ্ঠ সমাধানদাতা বা ফয়সালাকারী।-
শোয়াইব নবীর জাতি এই মহান নবীকে হুমকি দিয়ে বলেছিল 'যদি তুমি আমাদের ধর্মে ফিরে না আস তথা আমাদের ধর্ম গ্রহণ না কর তাহলে তোমাকে শহর থেকে বের করে দিব।' এ অবস্থায় তিনি মহান আল্লাহর কাছে ওই দোয়া করেন।
সুরা ফাত্বির-এর দ্বিতীয় আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন,
আল্লাহ মানুষের জন্য অনুগ্রহের মধ্য থেকে যা খুলে দেন, তা ফেরাবার কেউ নেই এবং তিনি যা বারণ করেন বা বন্ধ রাখেন, তা কেউ পাঠাতে বা খুলতে পারে না তিনি ছাড়া। তিনি অনন্য ও অতুলনীয় পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়।-
অর্থাৎ আল্লাহ যদি কাউকে কিছু দিতে চান তাতে বাধা দেয়ার ও তা থেকে বঞ্চিত করার কেউ নেই। আর আল্লাহ যদি কাউকে কোনো নেয়ামত থেকে বঞ্চিত করতে চান তাহলে দুনিয়ার কারো সাধ্য নাই তাকে সেই নেয়ামত দেয়ার। তাই সব সৃষ্টিই কোনো কিছু লাভের জন্য মহান আল্লাহর ফাত্তাহ নামের মুখাপেক্ষী।
পবিত্র কুরআনে সুরা ফাত্হ্ নামে একটি সুরা রয়েছে। এ সুরা সম্পর্কে মহানবী (সা) বলেছেন, সূর্যের আলোর নীচে যা কিছু আছে সেসবের চেয়েও আমার কাছে বেশি প্রিয় ও আনন্দদায়ক হল এই সুরা।
এই সুরার প্রথমেই মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয়তম বান্দাহ ও রাসুলকে বলছেন:
নিশ্চয় আমি আপনার জন্যে এমন একটা ফয়সালা বা সমাধান দিয়েছি, যা সুস্পষ্ট।-

এখানে মুসলমানদের সুস্পষ্ট বিজয়ের কথা বলা হয়েছে। এ এমন এক বিজয় যেখানে মুসলমানরা মুশরিকদের পরাস্ত করা ছাড়াও মুনাফিকদেরও পরাজয়ের স্বাদ পাইয়ে দিতে সক্ষম হন এবং এভাবে বিশ্বে মহতী ও ব্যাপক ধর্মীয় সংস্কার আনতে সক্ষম হন। আর এভাবে মুসলমানরা ইসলামকে একত্ববাদী ও আসমানি ধর্মগুলোর মধ্যে একমাত্র পরিপূর্ণ ও সর্বাত্মক এবং সার্বজনীন ধর্ম হিসেবে তুলে ধরতে সক্ষম হন।
কোনো কোনো মুফাসসির মনে করেন ফাত্হুম মুবিন বলতে এ সুরায় হুদাইবিয়ার সন্ধির কথা বোঝানো হয়েছে। যখন মুশরিকরা এই চুক্তি স্বাক্ষর করে তখন তারা ভেবেছিল তারাই জয়ী হয়েছে, কিন্তু এ চুক্তির ফলে মুসলমানরা রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক শক্তি হিসেবে স্বীকৃতি পায় যা ছিল একটি বড় বিজয়। এ চুক্তির ফলে মুসলমানরা যে হিজাযের একটি সক্রিয় ও প্রভাবশালী গোষ্ঠী তা স্পষ্ট হয়। এ চুক্তির সুবাদেই হিজাযে বড় ধরনের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের সূচনা ঘটে। আর এইসব কারণেই পবিত্র কুরআনে এই চুক্তিকে স্পষ্ট ও প্রকাশ্য বিজয় ও মুসলমানদের প্রতি মহান আল্লাহর অনুগ্রহের পরিপূর্ণতা দান বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
হুদাইবিয়ার চুক্তির সুবাদে মুসলমানদের বিজয় ছিল বড় ধরনের অলৌকিক বিজয়ের সমতুল্য। কারণ মুসলমানরা কোনো ধরনের হতাহতের শিকার না হয়ে ও কোনো আর্থিক ক্ষতির শিকার না হয়েই এমন বড় নৈতিক বিজয় অর্জন করে যে তা আরব উপদ্বীপে মুশরিক ও শত্রুদের নির্মূল হয়ে যাওয়ার পথও খুলে দেয়। হুদাইবিয়ার সন্ধির ফলে প্রথমে মদিনায় ও পরে হিজায এবং নজদ্ অঞ্চলে একটি ইসলামী সরকার সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়।
সুরা ফাত্হ্-এ বলা হয়েছে হুদাইবিয়ার সন্ধির পর বিশ্বাসী মু'মিনরা মহানবীর (সা) সঙ্গে এক অঙ্গীকারে আবদ্ধ হন। আর এই অঙ্গীকার বা বাইয়াতই ছিল এক বড় বিজয়। মহানবীর প্রতি মু'মিনদের আনুগত্যের ঘোষণা মুসলমানদের জন্য একের পর এক নানা বিজয় অর্জনের পথ খুলে দেয় এবং মুসলমানদের ঐক্য জোরদারের পাশাপাশি ইসলামী সরকার ও সমাজও শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
হুদাইবিয়ার চুক্তির ফলে সূচিত নানা বিজয়ের মধ্যে একদিকে যেমন মুমিনদের একনিষ্ঠতা প্রকাশ পেয়েছে অন্যদিকে দুর্বল মুসলমানদেরও চেনা সহজ হয়েছে। কারণ একদল মুসলমান এ চুক্তির কারণে মক্কায় পৌঁছতে না পারায় অসন্তুষ্ট হয় এবং এ বিষয়টিকে মুসলমানদের জন্য পরাজয় বলে মনে করেছিল। অথচ মহানবী (সা) এই সন্ধিকে পর্যায়ক্রমিক নানা বিজয়ের সূচনা বলে উল্লেখ করেছিলেন।
হুদাইবিয়ার সন্ধির ফলে মুসলমানরা নিশ্চিন্তে ও নির্ভয়ে তথা মানসিক প্রশান্তি নিয়ে সব ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে ও শক্তিমত্তা এবং যোগ্যতার বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হন। ফলে মহানবী (সা) একত্ববাদী মিশনকে সফল করতে সক্ষম হন এবং ইসলাম ও ঈমান লাভ করে নিরাপত্তার ছায়া।
মহান আল্লাহর ফাত্তাহ নামের গুণে রঙিন হতে হলে আমাদেরকেও মানুষের বস্তুগত ও নৈতিক সমস্যা সমাধানে নিজ নিজ সাধ্য অনুযায়ী ফাত্তাহ'র ভূমিকা বা সহায়ক কাজের পথ খুলে দেয়ার ভূমিকা রাখতে হবে। আর নিজেদের জন্যও আল্লাহর রহমতের দরজা খুলতে ও সমস্যার সমাধান বা চাহিদা পূরণের কাজের মাধ্যমগুলো অর্জনের জন্য খুব জোরালোভাবে সক্রিয় হব এবং এ জন্য আল্লাহর সহায়তা কামনা করব।
সুরা আরাফের ৯৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
আর যদি সে জনপদের অধিবাসীরা ঈমান আনত এবং পরহেজগারি অবলম্বন করত, তবে আমি তাদের প্রতি আসমানি ও পার্থিব নেয়ামত সমূহ উন্মুক্ত করে দিতাম। কিন্তু তারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে। সুতরাং আমি তাদেরকে পাকড়াও করেছি তাদের কৃতকর্মের বদলাতে।
اللَّهُمَّ إِنِّی أَفْتَتِحُ الثَّنَاءَ بِحَمْدِکَ، وَ أَنْتَ مُسَدِّدٌ لِلصَّوَابِ بِمَنِّکَ، وَ أَیْقَنْتُ أَنَّکَ أَنْتَ أَرْحَمُ الرَّاحِمِینَ فِی مَوْضِعِ الْعَفْوِ وَ الرَّحْمَةِ، وَ أَشَدُّ الْمُعَاقِبِینَ فِی مَوْضِعِ النَّکَالِ وَ النَّقِمَةِ، وَ أَعْظَمُ الْمُتَجَبِّرِینَ فِی مَوْضِعِ الْکِبْرِیَاءِ وَ الْعَظَمَةِ
পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ১১
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।