সন্তান গ্রহণের বা ধারণের প্রাথমিক পর্যায় থেকেই বাবা-মাকে হতে হবে খুব সতর্ক
আদর্শ মানুষ গড়ার কৌশল (পর্ব-১০)
শিশুরা পবিত্র মানবীয় প্রকৃতি নিয়ে জন্ম নেয়। তাকে সঠিক পথে রাখতে ও সুশিক্ষা দিতে হলে মা-বাবা এবং শিক্ষকদেরকে হতে হবে দূরদর্শী, সচেতন, দক্ষ ও সৎ। উৎসাহ দেয়াটা শিশুদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেয়ার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।
যে কোনো ভালো কাজের ব্যাপারে উৎসাহ ও স্বীকৃতি পাওয়ার প্রত্যাশা মানব প্রকৃতির এক স্বাভাবিক দিক। যথাসময়ে ও পরিকল্পিতভাবে কোনো বিষয়ে উৎসাহ দেয়াটা শিশুর মনে গভীর প্রভাব ফেলে এবং তা অনেকটা অলৌকিক প্রভাবকের মত কাজ করে। ডক্টর জেমস ডবসনের মতে শিশুদের প্রশিক্ষণ দেয়ার ক্ষেত্রে এবং তাদের মধ্যে দায়িত্ববোধ জাগিয়ে তুলতে কোনো বিষয়ে আগ্রহী করা ও উৎসাহ দেয়াটা সবচেয়ে কার্যকর কৌশলগুলোর অন্যতম। শিশুরা নিজ থেকেই দায়িত্বশীল হতে চায় না। তাদেরকে দায়িত্বশীল করা বাবা-মায়েরই দায়িত্ব।
কোনো শিশু যখন নানা খেলনা নিয়ে তার খেলাধুলা শেষ হওয়ার পর খেলনাগুলো গুছিয়ে রাখে তখন তাকে যদি একটি মিষ্টি হাসি দিয়ে বলা হয়: সাবাস তুমি কত সুবোধ, বুদ্ধিমান ও সুশৃঙ্খল! অথবা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে তার মা তাকে আদর করেন কিংবা তাকে যদি কিছু একটা উপহার দেন তাহলে পরবর্তী দিনগুলোতেও সে এই একই কাজ করবে। অন্য কথায় শিশুরা কোনো ভালো কাজের জন্য উৎসাহ পেলে তারা ওই কাজ নিয়মিত করবে দায়িত্বপূর্ণ বৈধ কাজ হিসেবে এবং তা তাদের অভ্যাসে পরিণত হবে।
যে কোনো মানুষই অন্য মানুষের সুদৃষ্টি পেতে চায়। তারা ভালো কাজের জন্য অন্যদের কাছে কৃতজ্ঞতা পাওয়ারও আশা করেন। অন্যরা যখন বলবে যে একটা খুব ভালো ও বড় কাজ করলেন- তখন আমরা সন্তুষ্ট হই এবং অপেক্ষাকৃত বেশি তৃপ্তি অনুভব করি। ফলে আমরা আবারও এ ধরনের ভালো কাজ করার এবং ভালো আচরণ করার উৎসাহ পাব। প্রশংসা করে উৎসাহ দেয়া শিশুদের ক্ষেত্রে অনেক বেশি প্রভাব ফেলে। আসলে উৎসাহ পাওয়াটা মানুষের এক স্বাভাবিক চাহিদা।
আধুনিক যুগের মনস্তাত্ত্বিক ও গবেষকরা উৎসাহ প্রদানের বিষয়টিকে খুব গুরুত্ব দিয়ে থাকেন এবং শিশুদের প্রশিক্ষণ দেয়ার ক্ষেত্রে এ বিষয়কে এক কার্যকর মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেন। শিশুরা একবার কোনো ভালো কাজের জন্য বাবা-মা এবং বড়দের কাছে বাহবা পেলে ও পুরস্কার পেলে তারা ভবিষ্যতে বার বার ও ব্যাপক মাত্রায় একই ধরনের ভালো কাজ করতে আগ্রহী হবে। উৎসাহ দেয়া ও প্রেরণা যোগানো শিশুদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসকেও সবল করে। আত্মবিশ্বাসী শিশু এমন কোনো কাজ করবে না যা আশপাশের সবার কাছ থেকে নিন্দা কুড়াবে।
উৎসাহ পাওয়ার বিষয়টি শিশুর মনে এমন আনন্দ যোগায় ও ভালো স্মৃতি হয়ে বিরাজ করে যে সে উৎসাহদাতাদের নিজের খুব আপন মনে করে এবং উৎসাহ পাওয়ার সুবাদে সে বাবা মায়ের প্রতি অনেক বেশি অনুরাগী হয়ে পড়ে। ফলে বাবা-মায়ের পরামর্শ ও উপদেশগুলোকে সে খুব সহজেই গ্রহণ করে। আর এভাবে উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা শিশুর নানা ধরনের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটায়।
ভালো কাজের ব্যাপারে শিশুকে উৎসাহ দেয়ার সময় লক্ষ্য রাখা দরকার যে উৎসাহ প্রদান যেন বাস্তব ধরনের হয়। উৎসাহের ভাষা ও বক্তব্য যেন অতিরঞ্জিত না হয়। শিশুর ভালো আচরণ ও ভালো কাজের প্রতিদান হিসেবে তাকে বস্তুগত কিছু উপহার দেয়াটাও উৎসাহ যোগানোর অন্যতম কার্যকর পন্থা।
শিশু সারা দিনে যেসব ভালো কাজ বা আচরণ করেছে সেগুলো লক্ষ্য করে নোট করে নিতে পারেন বাবা মা। এরপর দিনশেষে সেইসব ভালো কাজ ও আচরণের কথা তুলে ধরে তাকে উৎসাহ দেয়া যেতে পারে। ফলে শিশু নিজের সম্পর্কে খুব ভালো অনুভূতি অর্জন করবে।
শিশুদের উৎসাহ দেয়ার জন্য খুব স্নেহপ্রবণ হওয়া, তাদের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলা, মাথায় আদর করে হাত বুলানো, জড়িয়ে ধরে আদর করা বা কোলে নেয়া -এসবই খুব কার্যকর পন্থা। শিশুদের বয়স অনুযায়ী তাদেরকে কখনও কথা দিয়ে বা কথা ছাড়াও অন্যভাবে স্নেহ দেখিয়ে উৎসাহ দেয়া উচিত। শিশুদের চরিত্র ও আচরণ বদলে দেয়ার ক্ষেত্রে এসবই খুব কার্যকর প্রভাব রাখে।
উৎসাহ দিয়ে যে কোনো বিষয়ে শিশুদের আগ্রহকে দমিয়ে ফেলাও সম্ভব। যেমন, কোনো এক স্কুলে ছুটির পর শিশুরা কোমল পানীয়ের পরিত্যক্ত পাত্রগুলোকে মানুষের ঘরবাড়ির দেয়ালের দিকে ও দরজার দিকে লাথি মেরে সেসবের সৃষ্ট শব্দ শুনে আনন্দ পেত। সেখানকার এক বৃদ্ধ ব্যক্তি এতে খুবই বিরক্ত হতেন। তিনি এই অশান্তি থেকে রক্ষা পেতে একদিন ওই শিশুদের ডেকে বললেন, তোমাদের এ কাজে আমার খুব ভালো লাগছে! এই কাজের কারণে তোমাদেরকে আগামীকাল থেকে দশ ডলার দেব। পরদিন ওই শিশুরা স্কুল ছুটির পর ওই কাজ অনেক বেশি মাত্রায় করলো। কয়েকদিন না যেতেই তাদের এ কাজের পারিশ্রমিক কমাতে লাগলেন ওই বৃদ্ধ ব্যক্তি। অবশেষে একদিন ওই কাজের জন্য কেবল এক ডলার করে পুরস্কার দিলেন। এক ডলার তাদের কাছে খুব তুচ্ছ মনে হল। ফলে তারা ওই কাজ করা পুরোপুরি ছেড়ে দিল। অথচ আগে তারা বিনা পুরস্কার বা পারিশ্রমিকেই ওই কাজ করতে আনন্দ পেত। এ কাহিনীর শিক্ষা হল মাঝে মাঝে শিশুদেরকে তাদের পছন্দের কাজ বেশি মাত্রায় করতে উৎসাহ দিতে হয়। আর এক সময় তারা সীমিত মাত্রার উৎসাহের কারণে বা উৎসাহের অভাবে ওই কাজ বর্জন করবে।
উৎসাহ শিশুর ব্যক্তিত্ব গড়ে তোলে। ভালো কাজের কারণে প্রশংসাসূচক সাধারণ এক বাক্য শিশুকে ওই কাজের প্রতি অনেক বেশি আগ্রহী করে তোলে। আর প্রশংসা না পেলে তার উল্টোটা ঘটে। যেমন, না বলা সত্ত্বেও বিছানা পরিপাটি করে রেখেছ! সাবাস! বা ব্যাপারটা খুবই ভালো কাজ হয়েছে! -এ ধরনের উৎসাহব্যঞ্জক কথা শিশুকে আরও সুন্দর আচরণ প্রদর্শনে আগ্রহী করবে।
তবে উৎসাহ প্রদানের অতি বেশি ব্যবহার বিপজ্জনক। এমনটি হলে দেখা যাবে শিশু পুরস্কার দেয়া ছাড়া বা উৎসাহ দেয়া ছাড়া কোনো ইতিবাচক বা ভালো কাজই করতে চাচ্ছে না। ইমাম হাসান মুজতাবা (আ) নিজ সন্তান ও ভাতিজাদের উৎসাহ দিতে গিয়ে বলতেন, তোমরা যারা আজকের শিশু তারা আগামী দিনে সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি হবে বলে আশা করছি। তাই জ্ঞান অর্জনের জন্য পরিশ্রমী হও।
উৎসাহ দেয়া ও অনুপ্রেরণা যোগানোর বিষয়টি বর্তমান যুগে শিক্ষণের অন্যতম প্রধান ও কার্যকর পন্থা হিসেবে গোটা বিশ্বেই স্বীকৃত। #
পার্সটুডে/এমএএইচ/আবুসাঈদ/২৪
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।