এপ্রিল ২৬, ২০২১ ১৯:৫৪ Asia/Dhaka

মহান আল্লাহর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নাম ক্বাবিয বা ক্বাবিদ। মহান আল্লাহর জালালি তথা শক্তিমত্তা ও পরাক্রমের ঔজ্জ্বল্যে ভরপুর নামগুলোর অন্যতম এই নাম।

ক্বাবিয বা ক্বাবিদ-এর অর্থ কোনো কিছুকে হাতের মুঠিতে নেয়া, সাধারণত কোনো বিষয়ের ওপর পরিপূর্ণ ও নিরঙ্কুশ ক্ষমতা আর কর্তৃত্ব বোঝাতে এ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। যেমন বলা হয় যে অমুক শহরটির নিয়ন্ত্রণ এখন আমার হাতে বা কবযায় রয়েছে। মানুষ ও সৃষ্টিকুলের নিয়ন্ত্রক মহান আল্লাহ। সুরা জুমারের ৬৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,

তারা আল্লাহকে যথার্থরূপে বোঝেনি। কেয়ামতের দিন গোটা পৃথিবী থাকবে তাঁর হাতের মুঠোতে তথা তারই নিয়ন্ত্রণে বা কর্তৃত্বাধীনে এবং আসমানগুলো ভাঁজ করা অবস্থায় থাকবে তাঁর ডান হাতে। তিনি পবিত্র। আর এরা যাকে শরীক করে, তা থেকে তিনি পবিত্র ও অনেক ঊর্ধ্বে।-সুরা ফুরক্বানের ৪৫ ও ৪৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,

তুমি কি তোমার পালনকর্তাকে তথা তার  শক্তিকে দেখ না, তিনি কিভাবে ছায়ার বিস্তার ঘটান? তিনি ইচ্ছা করলে একে স্থির রাখতে পারতেন। এ ছাড়াও আমি সূর্যকে করেছি এর নির্দেশক। অতঃপর আমি একে নিজের দিকে ধীরে ধীরে গুটিয়ে আনি।

-এখানে ছায়া গুটিয়ে আনাকে কাব্‌য বলা হয়েছে যা মহান আল্লাহর ক্ষমতার পরিপূর্ণতার সাক্ষ্য। এটাও এখানে বোঝানো হচ্ছে যে কোনো কাজই মহান আল্লাহর জন্য কঠিন নয়।

শরীর থেকে প্রাণ বা আত্মা বিচ্ছিন্ন করার ক্ষেত্রেও কাব্‌য্‌ শব্দের ব্যবহার লক্ষণীয়। বলা হয় অমুক ব্যক্তির রুহ কাব্‌য্‌ করেছেন মৃত্যুর ফেরেশতা বা হযরত আজরাইল (আ)। সুরা জুমার-এর ৪২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন, মৃত্যুর সময় আল্লাহই মানুষের রূহগুলো কবজ করেন আর যে এখনো মরেনি নিদ্রাবস্থায় তার রূহ কবজ করেন৷ অতঃপর যার মৃত্যুর ফায়সালা কার্যকরী হয় তার রুহকে রেখে দেন ও তা দেহে ফেরত পাঠান না এবং অন্যদের রূহ একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ফেরত পাঠান৷ যারা চিন্তা-ভাবনা করে তাদের জন্য এর মধ্যে মহান আল্লাহর ক্ষমতার বড় নিদর্শন রয়েছে৷

কুরআনের কোনো কোনো আয়াত থেকে স্পষ্ট যে ফেরেশতারাও মানুষের রুহ কব্‌য্‌কারী এবং সেই অর্থে তারাও ক্বাবেয্‌। মহান আল্লাহর কাবেয্‌ গুণের প্রকাশ ঘটেছে এই ফেরেশতাদের ওপর। তাই তারা আসলে আল্লাহর কবজ কার্যক্রমের মাধ্যম বা ওয়াসিলা। তারা মহান আল্লাহ'র এই গুণ বা বৈশিষ্ট্যকে মানুষসহ সব জীবকুলের ওপর প্রয়োগ করেন। 

সুরা সিজদার ১১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ মৃত্যুর প্রধান ফেরেশতা আজরাইলের ভূমিকা তুলে ধরে বলেছেন,

এদেরকে বলে দাও, “মৃত্যুর যে ফেরেশতাকে তোমাদের ওপর নিযুক্ত করা হয়েছে সে তোমাদের রুহকে পুরোপুরি তার কবজায় নিয়ে নেবে এবং তারপর তোমাদেরকে তোমাদের রবের কাছে ফিরিয়ে আনা হবে৷-

অবশ্য আজরাইলের আওতাধীন অন্য একদল ফেরেশতাও রুহ কবজের কাজ করে থাকেন। সুরা নাহলের ৩২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,

এমন মুত্তাকীদেরকে, যাদের পবিত্র থাকা অবস্থায় ফেরেশতারা যখন মৃত্যু ঘটান তখন বলেন, “তোমাদের প্রতি শান্তি, যাও নিজেদের কর্মকাণ্ডের পুরস্কার হিসেবে জান্নাতে প্রবেশ করো৷ -

আল্লাহ ছাড়া অন্য কবযকারীরা প্রকৃত কবযকারী নয়, বরং তারা আল্লাহর অনুমতিক্রমেই রুহ কবজ করে থাকেন।

 বলা হয় অত্যন্ত মর্যাদাসম্পন্ন মুমিন ব্যক্তিদের রুহ কবজ করেন স্বয়ং হযরত আজরাইল। আর সাধারণ মানুষের কাছে আসেন সাধারণ ফেরেশতা মৃত্যুর দূত হয়ে। সৎ-ব্যক্তিরা মৃত্যুর দূতকে অত্যন্ত সুন্দর ও জ্যোতির্ময় ব্যক্তি হিসেবে দেখে থাকেন এবং এতে সে প্রাণ বা রুহ হরণের বেদনা ভুলে যায়। আর যারা পাপী ও কাফির-মুশরিক তারা মৃত্যুর ফেরেশতার ভয়ানক চেহারা দেখে এমন বিকট চিৎকার দেন যে অন্য মানুষরা যদি সেই চিৎকার শুনত তাহলে তারাও ভয়ে মূর্ছা যেত। অন্য কথায় পাপী, জালিম ও কাফির-মুশরিকদের প্রাণ হরণ করেন আযাবের ফেরেশতা। আর আর মুমিন ও সৎ ব্যক্তিদেব্র প্রাণ হরণ করেন রহমতের ফেরেশতারা।

হযরত ইব্রাহিম (আ) একবার মালিকুল মউত নামে খ্যাত মৃত্যুর প্রধান ফেরেশতা আজরাইল (আ)-কে বলেন, আপনার যেসব ফেরেশতা ক্রুদ্ধ ও কঠিন চেহারা নিয়ে রুহ কবজ করেন তার নমুনা আমাকে একটু দেখান। আজরাইল (আ) বললেন, আপনি তা সহ্য করতে পারবেন না। কিন্তু এই মহান নবী বললেন, সহ্য করতে পারব। তখন আজরাইল (আ) যারা কঠোর রূপ নিয়ে রুহ কবজ করেন এমন ফেরেশতাদের একজনকে রুহ কবয্‌কালীন সময়ের ভয়ানক চেহারা কিছুক্ষণের জন্য দেখাতে বললে ওই ফেরেশতা তা দেখালেন এক মুহূর্তের জন্য। আর তা দেখেই হযরত ইব্রাহিম (আ) বেহুঁশ হয়ে পড়েন।

সুরা আনআমের ৯৩ নম্বর আয়াতে কাফিরদের প্রাণ হরণকালীন সময়ের অবস্থা তুলে ধরে বলা হয়েছে:

'হায় ! তুমি যদি জালেমদেরকে সে অবস্থায় দেখতে পেতে যখন তারা মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকবে এবং ফেরেশতারা হাত বাড়িয়ে বলতে থাকবে ৷ নাও, তোমাদের প্রাণ বের করে দাও৷ তোমরা আল্লাহর প্রতি অপবাদ আরোপ করে যেসব অন্যায় ও অসত্য কথা বলতে এবং তাঁর আয়াতের বিরুদ্ধে যে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করতে তারি শাস্তি স্বরূপ আজ তোমাদের অবমাননাকর শাস্তি দেয়া হবে৷ '

অন্যদিকে সুরা নাহ্‌ল্‌-এর বর্ণনা অনুযায়ী সৎকর্মশীল ও মুমিনদের রুহ কবজ করতে আসা রহমতের ফেরেশতাদের দেখে তারা ভয় তো পাবেনই না বরং পূর্ণ সন্তুষ্ট চিত্তে তাঁদের হাত ধরে দুনিয়া ত্যাগ করতে ও দুনিয়ার মায়া ছাড়তে প্রস্তুত হবেন।

ক্বাব্‌য্‌ বা ক্বা্‌বদ্‌ শব্দের আরো ক'টি অর্থ হল নেয়া বা গ্রহণ করা এবং কোনো কাজ ঠেকানো বা প্রতিরোধ করা। এ ধরনের ক্বাব্‌য্‌ বা ক্বা্‌বদ্‌ রুটি-রুজির ক্ষেত্রেও রয়েছে। মহান আল্লাহ সুরা রা'দ-এর ২৬ নম্বর আয়াতে বলেছেন,  আল্লাহ যাকে ইচ্ছা রিজিক সম্প্রসারিত করেন এবং যাকে চান সংকুচিত বা সীমিত রিজিক দান করেন৷  

- ক্বাব্‌য্‌ বা ক্বা্‌বদ্‌ মানে কার্পণ্য নয়। এর পূর্ণ রহস্য কেবল আল্লাহই ভালো জানেন। এই খোদায়ি নিয়ন্ত্রণের কারণে মানুষ ব্যাপক চেষ্টার পর অবশেষে কাবিয্‌ আল্লাহর ইচ্ছা ও তাঁর নির্ধারিত তাকদির বা ভাগ্যের কাছেই আত্মসমর্পণ করে। ফলে রুজি-রিযিকে প্রশস্ততা দেখলে মানুষ আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানায় এবং যখন অভাব বা স্বল্পতা দেখে তখনও সমগ্র চেতনা ও মনোযোগ নিয়ে আল্লাহর রহমত ও করুণার আশ্রয় নেয়।

নানা বিষয়ে মানুষের রিযক্-এর প্রসারণ বা সংকোচনের মালিক হলেন একমাত্র আল্লাহ। আল্লাহ যাকে বুদ্ধি কম দেন সে বাস্তবতা বুঝতে পারে না। মহান আল্লাহর নির্ধারিত ভাগ্য কেউ এড়াতে পারে না। আল্লাহ মানুষের প্রচেষ্টা ও তার ভাগ্যে বরাদ্দকৃত বিষয় সম্পর্কে অন্য সবার চেয়ে বেশি জানেন।

আমরা অনেক সময় যাকে দুর্ভাগ্য বা বালা-মুসিবত মনে করি তা আসলে দান বা নেয়ামত। আমরা যেন আমাদের কুপ্রবৃত্তির ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায়কারী বা কাবিয্‌ হতে পারি যাতে সরল-পথ থেকে বিচ্যুত না হই এবং আত্মপূজা প্রতিরোধ করে মহান আল্লাহর প্রকৃত দাস হতে পারি- মহান আল্লাহর দরবারে সেই প্রার্থনা করছি।

لّهُمَّ اجْعَلْ لی فی قَلْبی نُوراً وَ بَصَراً وَ فَهْماً وَ عِلْماً اِنَّکَ عَلی کُلِ شَیءٍ قدی

সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে আজকের এই আলোচনা শেষ করছি।

পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ২৬

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।