সূরা গাফির: আয়াত ৪৮-৫২ (পর্ব-১২)
পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র এ পর্বে সূরা গাফির বা মু'মিনের ৪৮ নম্বর থেকে ৫২ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ৪৮ থেকে ৫০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
قَالَ الَّذِينَ اسْتَكْبَرُوا إِنَّا كُلٌّ فِيهَا إِنَّ اللَّهَ قَدْ حَكَمَ بَيْنَ الْعِبَادِ (48) وَقَالَ الَّذِينَ فِي النَّارِ لِخَزَنَةِ جَهَنَّمَ ادْعُوا رَبَّكُمْ يُخَفِّفْ عَنَّا يَوْمًا مِنَ الْعَذَابِ (49) قَالُوا أَوَ لَمْ تَكُ تَأْتِيكُمْ رُسُلُكُمْ بِالْبَيِّنَاتِ قَالُوا بَلَى قَالُوا فَادْعُوا وَمَا دُعَاءُ الْكَافِرِينَ إِلَّا فِي ضَلَالٍ (50)
“যারা (দুনিয়ায়) অহংকার করত তারা (জবাবে) বলবে, (এখন) আমরা সকলেই আগুনের মধ্যে রয়েছি, নিশ্চয় আল্লাহ (ইনসাফের ভিত্তিতে) তাঁর বান্দাদের বিচার করে ফেলেছেন।” (৪০:৪৮)
“আর যারা আগুনের অধিবাসী তারা জাহান্নামের প্রহরীদেরকে বলবে, তোমাদের রবকে বলো, তিনি যেন আমাদের থেকে একদিনের জন্য শাস্তি লাঘব করেন।” (৪০:৪৯)
“(জাহান্নামের প্রহরীরা জবাবে) বলবে: তোমাদের নবীরা কি তোমাদের জন্য সুস্পষ্ট দলিল নিয়ে আসেননি? (জাহান্নামীরা) বলবে, অবশ্যই এসেছিলেন। (প্রহরীরা) বলবে, তাহলে তোমরাই (আল্লাহকে) ডাক; কিন্তু কাফিরদের ডাক শুধু ব্যর্থই হয় (এবং তা আল্লাহর দরবারে কবুল হয় না)।” (৪০:৫০)
গত আসরে আমরা বলেছি, জাহান্নামের মধ্যে কাফির ও মুশরিক নেতারা তাদের অনুসারীদের সঙ্গে বাক-বিতন্ডায় লিপ্ত হবে। অনুসারী দুর্বল মানুষগুলো তাদের জাহান্নামে যাওয়ার জন্য তাদের নেতাদের দায়ী করবে এবং তাদেরকে বলবে তারা যেন এ শাস্তি হ্রাস করে দেয়। তাদের এ আহ্বানের সামনে এসব অহংকারী ব্যক্তির যুক্তিপূর্ণ কোনো জবাব থাকবে না; ফলে তারা শুধু বলবে: আমাদের সবার তো এখন একই পরিণতি হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদের মধ্যে সঠিক বিচার করেছেন এবং বিচারের রায়ের ভিত্তিতে আমরা সবাই জাহান্নামে পতিত হয়েছি। এখান থেকে মুক্তির উপায় যদি আমাদের জানা থাকত তাহলে তোমাদেরকে মুক্তি দেয়ার আগে আমরা নিজেদের মুক্তির ব্যবস্থা করতাম। কিন্তু জেনে রাখো, আজ আমাদের পক্ষে কিছুই করা সম্ভব নয়।
নেতাদের কাছ থেকে হতাশ হয়ে তাদের অনুসারীরা ছুটবে জাহান্নামের প্রহরীদের কাছে। তাদেরকে বলবে এই প্রচণ্ড আজাব থেকে অন্তত একদিনের জন্য হলেও যেন তারা আল্লাহকে বলে মুক্তির ব্যবস্থা করে দেয় যাতে কিছুটা হলেও স্বস্তি পাওয়া যায়। কিন্তু প্রহরী ফেরেশতারা তাদেরকে বলবে: তোমরা অহংকারী নেতাদের অনুসরণ না করে নবীদের কথা শোনোনি কেন? নবীরা কি তোমাদের কাছে উপযুক্ত দলিল-প্রমাণ নিয়ে আসেননি? তারা কি আজকের দিনের পরিণতির কথা তোমাদের জানাননি? তখন জাহান্নামীরা তাদের অপরাধ স্বীকার করে বলবে: নবীরা এসেছিলেন কিন্তু আমরা তাদের কথায় কান না দিয়ে তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। তখন ফেরেশতারা বলবে: তাহলে তো তোমরাই অপরাধী। আজ তোমাদের এই স্বীকারোক্তি তোমাদের কোনো কাজে আসবে না। আজ আল্লাহ তায়ালাকে যতই ডাক না কেন তাতে তোমাদের শাস্তি বিন্দুমাত্র কমবে না।
এই তিন আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে:
১- পার্থিব জীবনে যারা দম্ভ ও অহংকারে লিপ্ত এবং আল্লাহর বিধিবিধান প্রত্যাখ্যান করে কিয়ামতের দিন তারা চরম অপমানিত ও লাঞ্ছিত অবস্থায় জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।
২- মানুষের মধ্যে ন্যায়ের ভিত্তিতে ফয়সালা করা মহান আল্লাহর কাজ। কাজেই আল্লাহর দয়া ও রহমত লাভের আশা থাকলে আমরা যেন অন্যদের সঙ্গে অন্যায় আচরণ না করি।
৩- জাহান্নামের আজাবে কোনো বিরতি বা কমতি নেই। কাজেই দুনিয়ার জীবনে যতক্ষণ হায়াত আছে ততক্ষণ আমরা তওবা-ইস্তেগফার করে আল্লাহর ক্ষমা চেয়ে নেই যাতে জাহান্নামের ভয়াবহ আজাবে পড়তে না হয়।
৪- আল্লাহর বিধান হচ্ছে তিনি কাউকে ঈমান আনার সুযোগ না দিয়ে শাস্তি দেন না।
সূরা গাফিরের ৫১ ও ৫২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
إِنَّا لَنَنْصُرُ رُسُلَنَا وَالَّذِينَ آَمَنُوا فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَيَوْمَ يَقُومُ الْأَشْهَادُ (51) يَوْمَ لَا يَنْفَعُ الظَّالِمِينَ مَعْذِرَتُهُمْ وَلَهُمُ اللَّعْنَةُ وَلَهُمْ سُوءُ الدَّارِ (52)
“নিঃসন্দেহে আমি আমার রাসূলদের এবং যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে দুনিয়ার জীবনে এবং (কিয়ামতের দিন) সাহায্য করব; যেদিন সাক্ষীগণ দণ্ডায়মান হবে।” (৪০:৫১)
“যেদিন যালিমদের ক্ষমাপ্রার্থনা তাদের কোন কাজে আসবে না। আর তাদের জন্য রয়েছে অভশাপ এবং তাদের জন্য রয়েছে নিকৃষ্ট আবাসস্থল।” (৪০:৫২)
দাম্ভিক ব্যক্তিদের দরিদ্র অনুসারীরা দুনিয়ায় থাকতে ভাবত, ক্ষমতা ও সম্পদের অধিকারী কাফির নেতারা যেকোনো সময় বিপদে পড়লেই তাদেরকে সাহায্য করতে পারবে। কিন্তু কিয়ামতের দিন তারা দেখতে পাবে তাদের সেই অহংকারী নেতাদের পক্ষে তাদেরকে কোনো সাহায্য করা সম্ভব নয়। বরং উল্টো নবী-রাসূলগণ ও আল্লাহর সালেহ বান্দাগণ সেদিন আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশাল অনগ্রহপ্রাপ্ত হবেন। এই দুই আয়াতে যেমনটি বলা হচ্ছে: মহান আল্লাহ নবী-রাসূল ও মুমিনদের অভিভাবক এবং তিনি তাদেরকে দুনিয়া ও আখেরাতে সাহায্য করবেন।
এখানে আল্লাহ তায়ালা তাঁর একটি অলঙ্ঘনীয় বিধান উল্লেখ করেছেন। আর তাহলো, দুনিয়া ও আখেরাতে নবী-রাসূল ও খাঁটি মুমিন বান্দাদের জন্য তাঁর সাহায্য অবারিত থাকবে।
পার্থিব জীবনে তিনি অদৃশ্য মদদের মাধ্যমে মুমিনদের মানসিক শক্তি যোগাবেন এবং তাদের শত্রুদের অন্তরে ভীতির সঞ্চার করে দেবেন। সেইসঙ্গে জালিমদের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে সত্যিকার মুমিন বান্দাদেরকে তাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে বিজয়ী করবেন। আর কিয়ামতের দিন তাদের জন্য রয়েছে মহাপুরস্কার ও অবিরাম শান্তি।
অন্যদিকে কাফির ও জালিমদের জন্য কিয়ামত হবে অপমানিত ও লাঞ্ছিত হওয়ার দিন। যেদিন সকল সৃষ্টি সম্মিলিতভাবে জালিম ও কাফিরদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে এবং তখন ওই বিশাল প্রান্তরে তারা চরম অবমাননাকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে। সেদিন সাক্ষীরা মুমিনদের পক্ষে কথা বলবে যাতে দাম্ভিকদের মোকাবিলায় তাদের মর্যাদা বেড়ে যাবে। তখন অহংকারী জালেমরা কাকুতি-মিনতি করে ক্ষমা চাইলেও তা আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না বরং তাদের অনুসারীরা পর্যন্ত তাদেরকে অভিশাপ দিতে থাকবে। ফলে তারা একদিকে আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হবে এবং অন্যদিকে অনুসারীদের কটুকথার মুখোমুখি হবে। তারা শুধু জাহান্নামের আগুনে পুড়ে শারিরীক কষ্টই ভোগ করবে না সেইসঙ্গে চরম অপমানের মানসিক যন্ত্রণাও তাদেরকে কুরে কুরে খাবে।
পবিত্র কুরআনে অতীত জাতিগুলোর ঘটনা এজন্য বর্ণনা করা হয়েছে যে, সেসব জাতির মুমিন ও জালিমদের পরিণতি থেকে যেন মানুষ শিক্ষা নেয়।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- নবী-রাসূল ও মুমিনদের বিজয়ী করা হচ্ছে মহান আল্লাহর ঐশী রীতি। তবে শুধু মুখে ঈমানের বাণী যথেষ্ট নয় বরং জীবনের প্রতিটি স্তরে ঈমানদারির পরিচয় দিতে হবে এবং নবী-রাসূলদের প্রকৃত অনুসারী হতে হবে।
২- ঈমানদার ব্যক্তি শুধু কিয়ামতের দিন পুরস্কৃত হবে না বরং পার্থিব জীবনেও সে আল্লাহ তায়ালার সাহায্যপ্রাপ্ত হবে।
৩- আল্লাহর এই সাহায্যের প্রতিশ্রুতি মুমিনদের জন্য মানসিক প্রশান্তি কারণ হয়। যেকোনো বিপদ-আপদ এবং জালিমদের অত্যাচার ও অপমানে তারা ধৈর্য ধারণ করার মানসিক শক্তি অর্জন করে। #
পার্সটুডে/এমএমআই/এআর/১৫
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।