আসমাউল হুসনা (পর্ব-৩২)
মহান আল্লাহর আসমাউল হুসনার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নাম হালিম। এ নাম পাপ বা গোনাহ'র মোকাবেলায় পাপীকে বা অবিশ্বাসী তথা কাফির-মুশরিককে অবকাশ দেয়া ও তাকে শাস্তি দেয়ার ব্যাপারে তাড়াহুড়া না করা সংক্রান্ত মহান আল্লাহ'র বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরে।
হালিম শব্দটির উৎস হিল্ম্। এর অর্থ প্রবল আবেগ ও উদ্দীপনার চাপের মুখে নিজেকে সংযত রাখা। বুদ্ধিমত্তা ও প্রজ্ঞা এই অবস্থার উৎস বলে কখনও কখনও হিল্ম্ অর্থ হয় বুদ্ধিমত্তা ও প্রজ্ঞা। মহান আল্লাহ পাপীকে বা অবিশ্বাসী তথা কাফির-মুশরিককে সংশোধনের জন্য যথেষ্ট সময় দেন এবং ধৈর্যশীল ও সহিষ্ণু থাকেন। অন্য কথায় তিনি অবিশ্বাসী ও পাপীদেরকে যা খুশি তা করার সুযোগ দেন। হিল্ম্ শব্দটি সাব্র্ শব্দের খুব কাছাকাছি। তবে পার্থক্য হল সাব্র্ বা ধৈর্য হল বাহির থেকে আরোপিত দুঃখ-কষ্ট, বিপদ-আপদ ও প্রতিকূলতার মোকাবেলায় নিজেকে সামলে রাখা এবং সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা। আর হিল্ম্ হল নিজের মনে সৃষ্টি হওয়া ক্রোধ, ক্ষোভ ও অসন্তোষকে চেপে রেখে সেগুলোর বহিঃপ্রকাশ হতে না দেয়া।
হিল্ম্কে বুদ্ধিমত্তা বা আক্বল্ও বলা হয়। হযরত ইমাম সাদিক্ব (আ) হিল্ম্কে মহান আল্লাহর প্রদীপ বা বাতি বলে উল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে আক্বল্-কেও বলা হয় আলো। অন্ধকার যুগের আরবরাও এমন ব্যক্তিকে হালিম বলত যে ব্যক্তি কাজে কর্মে ও আচার-আচরণে বিবেক-বুদ্ধি মেনে চলত। আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ) বলেছেন, হিল্ম্ হচ্ছে এমন এক আলো যার জ্বালানী হচ্ছে আক্বল্ বা বুদ্ধিমত্তা। -অন্য কথায় এটি হচ্ছে মানুষের মধ্যে এক ধরনের খোদায়ি আলো।
মহান আল্লাহর নাম হালিম শব্দটি পবিত্র কুরআনে ১৫ বার এসেছে। এর মধ্যে এই নাম ছয়বার এসেছে মহান আল্লাহর গাফুর নামের সঙ্গে। গাফুর নামের অর্থ ক্ষমাশীল। মহান আল্লাহ পাপীদের পাপ-তৎপরতা দেখেন। কিন্তু তিনি পাপীদের সঙ্গে ক্ষমাশীল আচরণ করেন। তিনি শাস্তি দেয়ার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও পাপীদের তাড়াহুড়া করে শাস্তি দেন না। এ প্রসঙ্গে সুরা ফাতিরের ৪৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,
যদি আল্লাহ মানুষকে তাদের কৃতকর্মের কারণে তাদেরকে সংশোধনের সংক্ষিপ্ততম সুযোগও না দিয়ে দ্রুত পাকড়াও করতেন তথা শাস্তি দিতেন, তবে ভুপৃষ্ঠে চলমান কাউকে তথা কোনো মানুষকে তিনি ছেড়ে দিতেন না। কিন্তু তিনি এক নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত তথা ক্বিয়ামত পর্যন্ত তাদেরকে অবকাশ দেন। অতঃপর যখন সে নির্দিষ্ট মেয়াদ এসে যাবে তখন আল্লাহর সব বান্দা তাঁর দৃষ্টিতে থাকবে তথা তখন সেই বিচার দিবসে তারা তাদের কথা, কাজ, মনোভাব ও চিন্তা বা বিশ্বাসের প্রতিদান পাবে। -
মহান আল্লাহ তার বান্দাহদের তওবার সুযোগ দেন। তারা যদি গোনাহ ছেড়ে আল্লাহর দিকে ফিরে আসে আল্লাহ তাদের ক্ষমা করেন। মহান আল্লাহ পাপীকেও পাপের কারণে নেয়ামত দেয়া, অনুগ্রহ করা ও ক্ষমা করা থেকে বঞ্চিত করেন না। তিনি পাপী ও পূন্যবান উভয়কেই রিজিক দান করেন। মহান আল্লাহ সহনশীল। তিনি পাপীদেরকে সঙ্গে সঙ্গে পাকড়াও করেন না। সংশোধনের ও তওবার জন্য যথেষ্ট সময় দেন। সুরা বাকারার ২৩৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন: জেনে রাখ, আল্লাহ তোমাদের গোপন ইচ্ছা সম্পর্কে জানেন। তাই আল্লাহর বিরোধিতা করো না। তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও সহিষ্ণু।–
মহান আল্লাহর নবী-রাসুলরা ছিলেন অত্যন্ত ধৈর্যশীল। হযরত ইব্রাহিম নবীর ধৈর্য্যের প্রশংসা করে মহান আল্লাহ সুরা তওবার ১১৪নম্বর আয়াতে বলেছেন:
আর ইব্রাহীম কর্তৃক স্বীয় পালক পিতার তথা চাচার মাগফেরাত কামনা ছিল কেবল সেই প্রতিশ্রুতির কারণে, যা তিনি তার সাথে করেছিলেন। অতঃপর যখন তাঁর কাছে একথা প্রকাশ পেল যে, সে আল্লাহর শত্রু তখন তিনি তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে নিলেন। নিঃসন্দেহে ইব্রাহীম ছিলেন বড় কোমল হৃদয়, সহনশীল।
সুরা হুদের ৭৪ ও ৭৫ নম্বর আয়াতে লুত জাতিকে শাস্তি দিতে আসা ফেরেশতাদের সঙ্গে হযরত ইব্রাহিমের বিতর্ক প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেছেন:
অতঃপর যখন ইব্রাহীম (আঃ) এর আতঙ্ক দূর হল এবং তিনি তার সন্তানের জন্ম সংক্রান্ত সুসংবাদ প্রাপ্ত হলেন, তখন তিনি আমাদের সাথে তর্ক শুরু করলেন কওমে লূত সম্পর্কে। ইব্রাহিম (আঃ) বড়ই ধৈর্য্যশীল, কোমল অন্তর, আল্লাহমুখী সন্দেহ নেই। -
হযরত ইব্রাহিম লুত জাতির ওপর খোদায়ি শাস্তি নাজিলের বিষয়টি বিলম্বিত করতে ফেরেশতাদের সঙ্গে বিতর্ক করেছিলেন এবং হুদ জাতির জন্যও খোদায়ি অনুগ্রহ চেয়েছিলেন যাতে তারা তওবা করতে পারে।
হযরত ইব্রাহিমের পুত্র হযরত ঈসমাইল (আ)কেও পবিত্র কুরআনে হালিম বলা হয়েছে। সুরা সাফফাতের ১০১ নম্বর আয়াতে হযরত ইব্রাহিম নবীকে সহনশীল এক পুত্রের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। তিনি মহান আল্লাহর কাছে এক সৎ পুত্র কামনার পর এই সুসংবাদ পান। এর পরের আয়াতেই বলা হয়েছে:
অতঃপর সে যখন পিতার সাথে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হল, তখন ইব্রাহীম তাকে বললঃ বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে যবেহ করছি; এখন তোমার অভিমত কি দেখ। সে বললঃ পিতাঃ! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, তাই করুন। আল্লাহ চাহে তো আপনি আমাকে সবরকারী পাবেন।–
মহান আল্লাহর হালিম নামের প্রতিফলন ঘটেছে হযরত ইসমাইলকে কুরবানি করার খোদায়ি নির্দেশের প্রতি তাঁর আত্মসমর্পণের ঘটনায়। আমরাও যদি মহান আল্লাহর হালিম নামের রঙে রঙ্গিন হতে চাই তাহলে ইমাম জাফর সাদিক (আ)'র উপদেশ অনুযায়ী মহান আল্লাহর এই চেরাগ বা আলো তথা সহনশীলতা অর্জনের জন্য ৫টি ক্ষেত্রে ধৈর্য ধরা জরুরি: এই ক্ষেত্রগুলো হল, সম্মানিত ব্যক্তিকে অসম্মান করা হলে, সত্যবাদী ব্যক্তিকে অশোভনীয় সম্বোধন করা বা অপবাদ দেয়া হলে, সত্যের আহ্বান জানাতে গিয়ে মানুষের কাছে তুচ্ছ বা নির্বোধ বলে বিবেচিত হওয়ার ক্ষেত্রে, নিরপরাধ হওয়া সত্ত্বেও হয়রানি ও অপমানের শিকার হওয়ার সময় এবং ন্যায্য অধিকার দাবি করা সত্ত্বেও তার বিরোধিতা করা হলে।
মোট কথা সর্বাবস্থায় সহিষ্ণু ও ধৈর্যশীল হওয়া উচিত। বিশেষ করে ক্ষমতা থাকা সত্ত্বে প্রতিশোধ না নিয়ে ক্ষমা করে দেয়া হচ্ছে মহান আল্লাহর হালিম নামের রঙ্গে রঙ্গিন হওয়ার অন্যতম পন্থা। হযরত আলী (আ) বলেছেন, যে কেউ অশালীনতা ও অপছন্দনীয় আচরণ করে তোমাকে ক্ষুব্ধ করে তার ব্যাপারে সহনশীলতার সৌন্দর্য অবলম্বন করে তুমি তাকে লজ্জিত বা অপ্রস্তুত করে দাও।
মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে ধৈর্য ও সহিষ্ণতার গুণ দান করুন।#
পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/১৫
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।