কুরআনের আলো
সূরা গাফির: আয়াত ৫৩-৫৬ (পর্ব-১৩)
পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র এ পর্বে সূরা গাফির বা মু'মিনের ৫৩ নম্বর থেকে ৫৬ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ৫৩ ও ৫৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র এ পর্বে সূরা গাফির বা মু'মিনের ৫৩ নম্বর থেকে ৫৬ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ৫৩ ও ৫৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
وَلَقَدْ آَتَيْنَا مُوسَى الْهُدَى وَأَوْرَثْنَا بَنِي إِسْرَائِيلَ الْكِتَابَ (53) هُدًى وَذِكْرَى لِأُولِي الْأَلْبَابِ (54)
“আর অবশ্যই আমি মূসাকে দান করেছিলাম হেদায়াত এবং বনী ইসরাঈলকে উত্তরাধিকারী করেছিলাম কিতাবের (অর্থাৎ তাওরাতের)।”(৪০:৫৩)
“(সে কিতাব) জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন লোকদের জন্য সঠিক পথের দিশারী ও উপদেশ।”(৪০:৫৪)
গত আসরে বলেছিলাম, আল্লাহ তায়ালা নবী-রাসূল ও তাঁর অনুসারীদের সাহায্য করেন। আজকের এই দুই আয়াতে সেই সাহায্যের উদাহরণ তুলে ধরতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলছেন: আমি মূসাকে নবুওয়াত দান করার পর ফেরাউন ও বনি ইসরাইলের কাছে দাওয়াতের বাণী নিয়ে যাওয়ার জন্য তাকে হেদায়াত দান করেছি। সেইসঙ্গে মূসাকে তাওরাত দান করেছি যাতে তার অন্তর্ধানের পরও বনি ইসরাইল জাতি এই কিতাব অধ্যয়ন করে বিভ্রান্তির অন্ধকার থেকে মুক্তি পেয়ে নিজেদের ঐশী দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হতে পারে।
অবশ্য আসমানি কিতাব থেকে বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই উপকৃত হয়। এটি মূর্খ, অহংকারী ও গোঁড়া লোকের কোনো কাজে আসে না। প্রকৃতপক্ষে যারা বিচারবুদ্ধি কাজে লাগিয়ে জীবন পরিচালিত করে তারা কিতাব থেকে উপকৃত হয়। যারা মনের খেয়াল-খুশি ও রিপুর তাড়নায় পরিচালিত হয় তারা এ কিতাবের শিক্ষা থেকে হয় বঞ্চিত। পবিত্র কুরআনের ভাষায়, বেশিরভাগ মানুষ তাদের খেয়াল-খুশিকে আল্লাহ বানিয়ে নিয়েছে। এ ধরনের মানুষ জাগতিক লিপ্সা চরিতার্থ এবং ইন্দ্রিয় সুখ ভোগের জন্য যেকোনো কাজ করে বসতে পারে।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- সকল মানুষ এমনকি নবী-রাসূলদেরও আল্লাহর পক্ষ থেকে হেদায়াত প্রাপ্ত হতে হয়। নবীরা সরাসরি আল্লাহর কাছ থেকে হেদায়াত প্রাপ্ত হন আর অন্য মানুষ নবীদের মাধ্যমে সুপথপ্রাপ্ত হয়।
২- মানুষের সর্বাবস্থায় উপদেশ প্রয়োজন। হিদায়াতের সঙ্গে উপদেশ চলতে না থাকলে এক সময় মানুষ বিপথে চলে যায়।
৩- বুদ্ধিবৃত্তি মানুষকে ঐশী বাণী গ্রহণের দিকে ধাবিত করে এবং এই দু’টি একসঙ্গে মিলে মানুষকে জান্নাতের পথ দেখায়।
সূরা গাফিরের ৫৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
فَاصْبِرْ إِنَّ وَعْدَ اللَّهِ حَقٌّ وَاسْتَغْفِرْ لِذَنْبِكَ وَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ بِالْعَشِيِّ وَالْإِبْكَارِ (55)
“অতএব আপনি ধৈর্য ধারণ করুন; নিশ্চয় আল্লাহ্র প্রতিশ্রুতি সত্য। আর আপনি আপনার ক্রটির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন এবং প্রতি সন্ধ্যা ও সকালে আপনার রবের (প্রশংসা) পবিত্রতা-মহিমা ঘোষণা করুন।”(৪০:৫৫)
এই আয়াত মহানবী (সা.)কে উদ্দেশ করে নাজিল হলেও এর মূল লক্ষ্য সকল উম্মত। এ আয়াতে মানুষকে উদ্দেশ করে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে:
প্রথমত, যখন তোমরা দেখলে অতীতের নবীদের হেদায়াত ও সাহায্য করা সংক্রান্ত ঐশী প্রতিশ্রুতি সত্য হয়েছে তখন তোমরাও মানুষকে দাওয়াত দেয়ার ক্ষেত্রে ধৈর্যধারণ করবে এবং শত্রুর ষড়যন্ত্র ও বিদ্বেষী আচরণে হতাশ ও হীনবল হবে না। কারণ, যেকোনো পরিস্থিতি ও প্রতিবন্ধকতায় ধৈর্য হচ্ছে সফলতার চাবিকাঠি এবং ধৈর্যধারণ করতে পারলে আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে বিজয় দান করার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবেন।
দ্বিতীয়ত, যদি এই নির্দেশ পালনের ক্ষেত্রে ভুল-ত্রুটি হয়ে যায় তাহলে আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা ও ইস্তেগফার করবে যাতে সেগুলো আল্লাহ ক্ষমা করে দেন।
নিঃসন্দেহে নবী-রাসূলগণ নিস্পাপ চরিত্রের অধিকারী ছিলেন এবং তারা কখনো গোনাহ করেননি। নবীদের অবশ্যম্ভাবী গুণ ছিল নিষ্কলুশ চরিত্র। কুরআনের আয়াতে শেষ নবী বা অন্য কোনো নবীর ক্ষেত্রে যদি ‘গোনাহ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে তাহলে সেটি আসলে সেই গোনাহ নয় যা আমরা সাধারণ মুসলমানরা করে থাকি। আমাদের ক্ষেত্রে গোনাহ হচ্ছে আল্লাহর নির্দেশ লঙ্ঘন করা। কিন্তু নবীরাসূলরা কখনো একথা চিন্তাও করতে পারতেন না। তবে সামান্যতম সময়ের জন্যও দায়িত্বের প্রতি অবহেলা তাদের মর্যাদার পরিপন্থি। তাঁদের মধ্যে যখন এই অনুভূতি জাগ্রত হয় যে, তাঁরা হয়তো তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারেননি তখনই সেটাকে গোনাহ বলা হয়েছে।
অনেক দামী মানুষকে আমন্ত্রণ জানিয়ে তাকে সর্বোচ্চ আপ্যায়ন করার পরও গৃহকর্তা যেমন ওই দামী মানুষের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে বলে যে, ঠিকমতো আপ্যায়ন হয়নি; নবী-রাসূলদের গোনাহ’র অনুভূতিও ঠিক তেমনি। তাঁরা রিসালাতের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করার পরও তাদের মনে হতো, হয়তো আল্লাহ তায়ালার পছন্দমতো করতে পারলাম না। মহানবী (সা.)কে এরকম অনুভূতি আসলেই আল্লাহ তওবা-ইস্তেগফার করতে বলেছেন।
এই আয়াতে তৃতীয় যে বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে তা হচ্ছে, প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায় যেন আমরা আল্লাহ তায়ালার পবিত্রতা ও প্রশংসা ঘোষণা করে নিজেদের ঈমানকে শক্তিশালী করি। আল্লাহকে একাগ্র চিত্তে স্মরণ করলে এবং তাঁর গুণবাচক নামগুলোর জিকির করলে মানুষের অন্তর প্রশান্ত হয় এবং ওই খোদায়ী গুণগুলো অর্জন করার পথ খুলে যায়।
এই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:
১- আল্লাহর নির্ধারিত দায়িত্ব পালনে আমাদেরকে ধৈর্যশীল হতে হবে; কোনো প্রতিবন্ধকতা যেন আমাদেরকে সিরাতুল মুস্তাকিম থেকে দূরে সরাতে না পারে।
২- সকল মানুষ এমনকি নবী-রাসূলকেও ইস্তেগফার করতে এবং আল্লাহর কাছে ভুল-ত্রুটির জন্য ক্ষমা চাইতে হয়।
৩- আল্লাহর জিকির ও তসবিহ পাঠ আমাদের দিনরাতের কার্যক্রমের অংশ করে নিতে হবে। তাহলেই আমরা প্রকৃত ঈমানদারির স্বাদ উপভোগ করতে পারব।
সূরা গাফিরের ৫৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
إِنَّ الَّذِينَ يُجَادِلُونَ فِي آَيَاتِ اللَّهِ بِغَيْرِ سُلْطَانٍ أَتَاهُمْ إِنْ فِي صُدُورِهِمْ إِلَّا كِبْرٌ مَا هُمْ بِبَالِغِيهِ فَاسْتَعِذْ بِاللَّهِ إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ (56)
নিশ্চয় যারা নিজেদের কাছে কোন দলিল না থাকলেও আল্লাহ্র আয়াত সম্পর্কে বিতর্কে লিপ্ত হয়, তাদের অন্তরে আছে শুধু অহংকার, তারা (যে সম্মান ও মর্যাদা অর্জন করতে চায়) তা অর্জন করতে পারবে না। অতএব আপনি আল্লাহর নিকট আশ্রয় চান; নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।” (৪০:৫৬)
এই আয়াতে মানুষের খোদাদ্রোহিতার কারণ উল্লেখ করে বলা হচ্ছে: যাদের কাছে দলিল-প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও কুরআনের আয়াত ও নবীদের অলৌকিক নিদর্শন প্রত্যাখ্যান করে এবং অহেতুক তর্ক জুড়ে দিয়ে অন্যদেরকে সত্য প্রত্যাখ্যানে উসকানি দিতে চায় তারা দাম্ভিক ও অহংকারী সম্প্রদায়। তারা নিজেদেরকে অনেক বড় ভাবে এবং ঈমানদার ব্যক্তিদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে। ধর্মীয় আলোচনায় অহেতুক তর্ক জুড়ে দিয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করা এদের কাজ। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা এ ধরনের প্রতিবন্ধকতা দূর করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছেন, তিনি ইসলামের শত্রুদেরকে তাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে দেবেন না।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- আল্লাহর সামনে আত্মম্ভরিতা ও অহংকারের কারণে অধিকাংশ মানুষ হেদায়াতের বাণী প্রত্যাখ্যান করে। আল্লাহর বাণী উপলব্ধি করতে না পারা তাদের পথভ্রষ্টতার কারণ নয়।
২- অহংকারী ব্যক্তিরা সমাজের নেতা হতে চায় কিন্তু তারা তাদের লক্ষ্য অর্জন করতে পারে না। ক্ষণিকের জন্য সে লক্ষ্য অর্জন করলেও পরে তারা সমাজের কাছে লজ্জিত ও অপমানিত হয়।
৩- ইসলামের শত্রুর ষড়যন্ত্র ও বিদ্বেষী আচরণ থেকে রক্ষা পেতে প্রতিনিয়ত আল্লাহর সাহায্য চাইতে হবে।#
পার্সটুডে/এমএমআই/এআর/১৫
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।