জুন ২৩, ২০২১ ১৫:০৩ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র এ পর্বে সূরা গাফির বা মু'মিনের ৫৭ থেকে ৬০ নম্বর নম্বর পর্যন্ত আয়াতের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ৫৭ থেকে ৫৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

لَخَلْقُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ أَكْبَرُ مِنْ خَلْقِ النَّاسِ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ (57) ) وَمَا يَسْتَوِي الْأَعْمَى وَالْبَصِيرُ وَالَّذِينَ آَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَلَا الْمُسِيءُ قَلِيلًا مَا تَتَذَكَّرُونَ (58) إِنَّ السَّاعَةَ لَآَتِيَةٌ لَا رَيْبَ فِيهَا وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يُؤْمِنُونَ (59)

“নিঃসন্দেহে মানুষ সৃষ্টি অপেক্ষা আসমানসমূহ ও যমীন সৃষ্টি অবশ্যই বড় (এবং গুরুত্বপূর্ণ) বিষয়, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না।”(৪০:৫৭)

“আর সমান হয় না অন্ধ ও চক্ষুষ্মান, (অনুরূপ) যারা ঈমান আনে এবং সৎকাজ করে তারা আর মন্দকর্মকারী (মানুষেরা) সমান নয়। তোমরা অল্পই উপদেশ গ্রহণ করে থাক।”(৪০:৫৮)

“নিশ্চয় কিয়ামত আসবেই, এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু অধিকাংশ লোক ঈমান আনে না।”(৪০:৫৯)

গত আসরে আমরা বলেছি, কাফেররা বিশ্বনবী (সা.) ও মুমিনদের সঙ্গে তর্ক জুড়ে দিত এবং সত্য বাণী গ্রহণে প্রস্তুত ছিল না। এরপর এই তিন আয়াতে বলা হচ্ছে: দ্বীন অস্বীকারকারীদের জিজ্ঞাসা করুন: আসমানসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টি বেশি গুরুত্বপূর্ণ নাকি মানুষকে দ্বিতীয়বার সৃষ্টি করা বেশি গুরুত্বের দাবি রাখে? যিনি বিশাল মহাকাশ এবং তারকারাজি ও গ্রহাণুপুঞ্জ সৃষ্টি করেছেন এবং এগুলোকে নিজ নিজ কক্ষপথে প্রতিনিয়ত পরিচালিত করছেন তার পক্ষে কি মৃতকে আবার জীবিত করা কঠিন কোনো কাজ?

নির্বোধেরাই কেবল নিজের সক্ষমতার সঙ্গে আল্লাহর অসীম ক্ষমতার তুলনা করতে পারে এবং আল্লাহ তায়ালাকে নিজের মতোই সীমাবদ্ধ মনে করে। এরপর বলা হচ্ছে: অন্ধ ও দৃষ্টিক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ এক নয়। অহংকারী নির্বোধেরা অন্ধ মানুষের মতো অনেক কিছু দেখা ও উপলব্ধি করা থেকে বঞ্চিত। তাদের চোখের সামনে দম্ভ ও অহংকারের পর্দা রয়েছে; কাজেই তারা সঠিকভাবে বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারে না।

তবে ঈমানদার ও ঐশী জ্ঞানে আলোকিত মানুষ সত্য দেখতে ও উপলব্ধি করতে পারে। ফলে এই দুই দল মানুষ কি পরস্পরের সমান হতে পারে? দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ যেমন নিজের অক্ষমতা সম্পর্কে সম্যক অবহিত তেমনি আল্লাহর এই সৃষ্টিজগতের বিশালতা সঠিকভাবে উপলব্ধি করে। কিন্তু এর কোনোটিই উপলব্ধ করার ক্ষমতা দাম্ভিক ও অন্ধ ব্যক্তির নেই। কাজেই সে নিজের সম্পর্কে ভুল ধারনা পোষণ করে যা তাকে খারাপ ও মন্দ কাজ করতে উসকানি দেয়। সমাজে এদের সংখ্যাই বেশি এবং চক্ষুষ্মান মানুষের সংখ্যা অতি নগণ্য।

পরের আয়াতে কাফিরদের অহেতুক তর্কের সুস্পষ্ট জবাব দিয়েছেন আল্লাহ তায়ালা। তিনি বলেন: কিয়ামত অবশ্যম্ভাবী বিষয় এবং এতে কোনো সন্দেহ নেই। যদি বিশ্বের সব মানুষ মিলেও কিয়ামতকে অস্বীকার করে তবুও কিয়ামত সংঘটিত হবেই। কেউ কিয়ামত দিবসকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।

এই তিন আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে:

১- আল্লাহর অসীম ক্ষমতা সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে মানুষ কিয়ামত দিবসকে অস্বীকার করে।

২- কুফর ও ফিস্‌ক মানুষকে অদৃশ্য বাস্তবতা দেখা থেকে বঞ্চিত রাখে।  কাফির ও ফাসিক ব্যক্তি শুধুমাত্র ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জিনিস ছাড়া অন্য কোনো কিছুতে বিশ্বাসী নয়।

৩- আল্লাহ তায়ালার ক্ষমতা, প্রজ্ঞা ও ন্যায়বিচার আমাদেরকে এ নির্দেশনা দেয় যে, কিয়ামত সম্পর্কে তাঁর প্রতিশ্রুতি সত্য। কাজেই এ সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করা অনুচিত।

সূরা গাফিরের ৬০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

وَقَالَ رَبُّكُمُ ادْعُونِي أَسْتَجِبْ لَكُمْ إِنَّ الَّذِينَ يَسْتَكْبِرُونَ عَنْ عِبَادَتِي سَيَدْخُلُونَ جَهَنَّمَ دَاخِرِينَ (60)

“আর তোমাদের রব বলেছেন, ‘তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব (এবং তোমাদের চাওয়া পূরণ করব)। নিশ্চয় যারা অহঙ্কার বশতঃ আমার ইবাদাত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তারা অচিরেই লাঞ্ছিত অবস্থায় জাহান্নামে প্রবেশ করবে।’” (৪০:৬০)

এই আয়াতে বলা হচ্ছে: শুধুমাত্র গোনাহগার ও অপরাধী ব্যক্তিরাই জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে না বরং যারা আল্লাহকে চেনার পরও তাঁর ইবাদত করা থেকে বিরত থাকে তাদেরকেও জাহান্নামে পাঠানো হবে। কারণ, এই কাজের অর্থ হচ্ছে আল্লাহ সামনে অহংকার করা। যারা আল্লাহর সামনে অহংকার করবে কিয়ামতের দিন তাদেরকে চরম অপমানজনক অবস্থায় জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।

আল্লাহ তায়ালা বান্দার ইবাদত-বন্দেগীর মুখাপেক্ষী বলে তাদের সঙ্গে এই আচরণ করা হবে না; বরং অহংকার ও স্বেচ্ছাচারী আচরণের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হচ্ছে জাহান্নাম। এ ধরনের মানুষ আল্লাহ তায়ালার আদেশ-নিষেধ নিঃশঙ্ক চিত্তে পালন করার পরিবর্তে ‘মন চাহি’ জীবনযাপন করে। তারা মনের ইচ্ছে পূরণ ও রিপুর তাড়নায় সাড়া দেয়ার কাজে লিপ্ত ছিল বলে বিভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট হয়েছে। অথচ অহমিকা ঝেড়ে ফেলে আল্লাহর ডাকে সাড়া দিলে তারা সঠিকপথ প্রাপ্ত হতো।

এই আয়াতের শুরুতেই আল্লাহ তায়ালার ইবাদতের একটি পদ্ধতি জানিয়ে দেয়া হয়েছে যা হচ্ছে দোয়া বা আল্লাহর কাছে চাওয়া। নামাজসহ অন্যান্য যেসব ইবাদতের কথা ইসলামে বলা হয়েছে তার বাইরেও ঈমানদার ব্যক্তিকে সারাক্ষণ আল্লাহকে স্মরণ করতে এবং যেকোনো অবস্থায় তাঁকে ডাকতে হবে। বিপদে-আপদে একমাত্র তাঁর কাছে সাহায্য চাইতে হবে এবং সুখের দিনে তাঁর শোকর আদায় করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি তাঁর বান্দার ডাক শুনতে পান এবং তাতে সর্বোত্তম প্রক্রিয়ায় সাড়া দেন।

অসীম ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহ যেকোনো সময় যেকোনো বান্দার সব চাওয়া পূর্ণ করতে পারেন। কিন্তু প্রজ্ঞাবান আল্লাহ বান্দার স্বার্থেই সে কাজ করেন না। তিনি এমন সময় বান্দার চাওয়া পূর্ণ করেন যখন বান্দা এ থেকে সর্বোচ্চ মাত্রায় উপকৃত হয়। তবে বান্দা সব সময় এ বিষয়টি উপলব্ধি করে না। তাৎক্ষণিকভাবে চাওয়া পূর্ণ না হলে সে মনোক্ষুণ্ন হয়।

তবে দোয়া করে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না।  সাধ্যমতো চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। দায়িত্বে অবহেলা করলে দোয়া কবুল হবে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দোয়া কবুল না হওয়ার মূল কারণ, মানুষের হাত গুটিয়ে বসে থাকা। যেটা চাইলাম তার জন্য পরিশ্রম না করা। দোয়া কবুল না হওয়ার আরো কারণ আছে। কখনো কখনো মানুষ নিজের জন্য কিছু চাইতে গিয়ে ভুল করে। আল্লাহ তায়ালা তাঁর অসীম ক্ষমতা ও দূরদর্শিতা দিয়ে দেখতে পান, বান্দা যা চেয়েছে তা কোনো অবস্থায় তার স্বার্থ রক্ষা করবে না। এ ধরনের ক্ষেত্রে আল্লাহ দোয়া কবুল করেন না।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- দোয়া একটি ইবাদত। এটি ত্যাগ করার অর্থ আল্লাহর বান্দেগি ত্যাগ করা যা মানুষকে অহংকারী করে তোলে।

২- দোয়ায় কোনো কিছু চাইতে হবে একমাত্র আল্লাহর কাছে। এখানে তাঁর সঙ্গে কাউকে শরীক করা যাবে না।

৩- আল্লাহ আমাদের চাহিদা পূরণ করার জন্য আমাদের দোয়ার দিকে তাকিয়ে থাকেন না। এমনিতেই তিনি দেন। কিন্তু দোয়া করে তাঁর কাছে চাইলে আমাদেরই লাভ। কারণ, সেক্ষেত্রে আমরা ধ্বংসের মূল উপাদান দম্ভ ও অহংকারের হাত থেকে রক্ষা পাব।  #

পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/২৩

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।