জুন ২৩, ২০২১ ১৫:০৩ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র এ পর্বে সূরা গাফির বা মু'মিনের ৬১ থেকে ৬৫ নম্বর নম্বর পর্যন্ত আয়াতের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ৬১ থেকে ৬৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

 اللَّهُ الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ اللَّيْلَ لِتَسْكُنُوا فِيهِ وَالنَّهَارَ مُبْصِرًا إِنَّ اللَّهَ لَذُو فَضْلٍ عَلَى النَّاسِ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَشْكُرُونَ (61) ذَلِكُمُ اللَّهُ رَبُّكُمْ خَالِقُ كُلِّ شَيْءٍ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ فَأَنَّى تُؤْفَكُونَ (62) كَذَلِكَ يُؤْفَكُ الَّذِينَ كَانُوا بِآَيَاتِ اللَّهِ يَجْحَدُونَ (63)

“আল্লাহ (তিনিই) যিনি তোমাদের জন্য তৈরি করেছেন রাতকে; যাতে তোমরা তাতে বিশ্রাম করতে পার এবং আলোকোজ্জ্বল করেছেন দিনকে। নিশ্চয় আল্লাহ মানুষের প্রতি অনুগ্রহশীল, কিন্তু অধিকাংশ মানুষই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না।”(৪০:৬১)

“তিনিই আল্লাহ, তোমাদের রব যিনি সব কিছুর স্রষ্টা; তিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই; কাজেই তোমাদেরকে কীভাবে (সত্য থেকে) ফিরিয়ে নেয়া হচ্ছে?”(৪০:৬২)

“যারা আল্লাহর নিদর্শনাবলী অস্বীকার করত, এভাবেই তারা (সিরাতুল মুস্তাকিম থেকে) পথভ্রষ্ট হয়ে যায়।” (৪০:৬৩)

এই তিন আয়াতে আল্লাহর একত্ববাদের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সেইসব নেয়ামতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে যেগুলোর প্রতি মানুষ খুব কমই ভ্রূক্ষেপ করে। বলা হচ্ছে: রাতের অন্ধকার এবং দিনের আলো মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীর জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দিনের আলো ও উষ্ণতা মানুষের কাজকর্ম করার এবং গাছপালা ও ফসল বেড়ে ওঠার জন্য নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করে। আর দিনের কঠোর পরিশ্রমের পর শারিরীক ও মানসিক প্রশান্তি ও বিশ্রামের জন্য রাতের অন্ধকার অপরিহার্য। যদি এই আলো ও অন্ধকার না থাকত তাহলে দিনের আলো ও তাপে পৃথিবীর সবকিছু ভষ্মিভূত হয়ে যেত।  কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ তো দূরের কথা এত বিশাল নেয়ামতের কথা চিন্তা করারই সময় পায় না।

উপরন্তু বহু মানুষ এই নেয়ামতের স্রষ্টার কৃতজ্ঞতা স্বীকার না করে উল্টো আল্লাহকেই অস্বীকার করে বসে। তারা এমন কাউকে নিজেদের মাবুদ বানিয়ে নেয় যাদের সৃষ্টি করা বা সৃষ্টিজগত পরিচালনা করার কোনো ক্ষমতা নেই। এরপর বলা হচ্ছে: যিনি এতসব নেয়ামত তোমাদেরকে দান করেছেন তিনি হচ্ছেন তোমাদের প্রভু ও পালনকর্তা আল্লাহ তায়ালা। তিনিই সবকিছুর স্রষ্টা এবং তিনি ছাড়া আর কোনো মাবুদ নেই।

এটা স্পষ্ট যে, যিনি সবকিছু সৃষ্টি ও পরিচালনা করছেন ইবাদত পাওয়ার একমাত্র যোগ্য সত্ত্বা তিনিই। এরপর বলা হয়েছে: এতকিছুর পরও তোমরা কিভাবে আল্লাহর রাস্তা থেকে বিচ্যুত হয়ে অন্য কিছুর উপাসনা করছো? একইসঙ্গে এই প্রশ্নের জবাব দিয়ে বলা হচ্ছে: যারা আল্লাহর নিদর্শন অস্বীকার করে তারা শেষপর্যন্ত সত্য থেকে বিচ্যুত হয়ে বিভ্রান্তির অতল গহ্বরে হারিয়ে যায়।

এই তিন আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:

১- আল্লাহ তায়ালা রাতকে বিশ্রাম নেয়ার এবং দিনকে কাজ করার জন্য সৃষ্টি করেছেন। আমাদের উচিত নিজেদের জীবনে এই নিয়ম মেনে চলা।

২- পার্থিব জীবনে আল্লাহ তায়ালার নেয়ামতরাজি থেকে মুমিন-কাফের, নেককার-বদকার সবাই উপকৃত হয়।

৩- নেয়ামত দেয়ার জন্য আল্লাহ মানুষের কৃতজ্ঞতার জন্য বসে থাকেন না। বেশিরভাগ মানুষ অকৃতজ্ঞ জেনেও তিনি অনবরত তাদের জন্য নেয়ামত বর্ষণ করতে থাকেন। 

৪- তিনিই ইবাদত পাওয়ার যোগ্য যিনি সৃষ্টি করার পাশাপাশি সৃষ্টিজগত পরিচালনাও করছেন। আল্লাহ ছাড়া আর কোনো সত্ত্বার এই যোগ্যতা ও শক্তি নেই।

সূরা গাফিরের ৬৪ ও ৬৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

اللَّهُ الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ قَرَارًا وَالسَّمَاءَ بِنَاءً وَصَوَّرَكُمْ فَأَحْسَنَ صُوَرَكُمْ وَرَزَقَكُمْ مِنَ الطَّيِّبَاتِ ذَلِكُمُ اللَّهُ رَبُّكُمْ فَتَبَارَكَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ (64) هُوَ الْحَيُّ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ فَادْعُوهُ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ (65)

“(তিনিই) আল্লাহ, যিনি তোমাদের জন্য ভূপৃষ্ঠকে নিরাপদ ও স্থিতিশীল করেছেন এবং আকাশকে করেছেন ছাদ এবং তিনি তোমাদেরকে আকৃতি দিয়েছেন অতঃপর তোমাদের আকৃতিকে করেছেন সুন্দর এবং তোমাদেরকে রিযিক দান করেছেন পবিত্র বস্তু থেকে। তিনিই আল্লাহ, তোমাদের রব! সুতরাং সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহ্‌ কত বরকতময় (ও মহামহিম)!(৪০:৬৪)

“তিনি জীবিত (চিরঞ্জীব), তিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। কাজেই তোমরা তাঁকেই ডাক, তাঁর আনুগত্যে একনিষ্ঠ হয়ে। সকল প্রশংসা একমাত্র আল্লাহরই যিনি সৃষ্টিকুলের রব।”  (৪০:৬৫)

এই দুই আয়াতে মানুষের জীবনে আসমান ও জমিনের নিয়ামক ভূমিকার কথা উল্লেখ করে আল্লাহ বলছেন: এই পৃথিবী নিজ অক্ষের ওপর ঘুর্ণয়নের পাশাপাশি সূর্যের চারপাশের কক্ষপথে ঘুরতে থাকার কারণে দিন ও রাত সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু এই ঘুর্ণয়ন সত্ত্বেও ভূপৃষ্ঠকে মানুষের জন্য স্থির ও নিরাপদ করে দিয়েছেন আল্লাহ। পৃথিবী নিজ অক্ষের ওপর প্রচণ্ড বেগে ঘুর্ণয়মান থাকা সত্ত্বেও মানুষ তার কিছুই অনুভব করে না বরং তার কাছে মনে হয় সে সম্পূর্ণ স্থির জায়গায় অবস্থান করছে। এরপর বলা হচ্ছে: তোমাদের মাথার উপরের আকাশ ছাতার মতো তোমাদেরকে অসংখ্য বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করছে। এই আকাশের মাধ্যমে সূর্যের ক্ষতিকর প্রভাব ঠেকিয়ে রেখেছেন আল্লাহ। এ ছাড়া, প্রতিনিয়ত অসংখ্য উল্কাপিণ্ডের আঘাত থেকে ভূপৃষ্ঠ রক্ষা পাচ্ছে এই আসমানের কারণে। 

এরপর আল্লাহ তায়ালা মানুষের প্রতি তাঁর আরেকটি নেয়ামতের কথা উল্লেখ করে বলছেন: সকল প্রাণীকূলের মধ্যে মানুষকে সর্বোত্তম আকৃতিতে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং তাকে দান করা হয়েছে সর্বোত্তম অবয়ব। মানুষের প্রতি এটি আল্লাহর একটি বিশেষ অনুগ্রহ। মানুষ তার এই শরীর দিয়ে এমন অসংখ্য সৃষ্টিশীল কাজ করতে পারে যা অন্য কোনো প্রাণীর পক্ষে করা সম্ভব নয়। এ ছাড়া, তাকে আল্লাহ যে বোধশক্তি দিয়েছেন তাও অন্য কোনো সৃষ্টিকে দেয়া হয়নি। এই আয়াতে মানুষের জন্য যেসব খাদ্য ও পানীয়ের ব্যবস্থা আল্লাহ করেছেন তার প্রতিও ইঙ্গিত করা হয়েছে। বলা হচ্ছে: যেসব খাবার তোমাদের খেতে ভালো লাগে সেসব খাবারই তোমাদেরকে দান করা হয়েছে।

এতসব নেয়ামতের বর্ণনা দেয়ার পর বলা হচ্ছে: ইনিই হচ্ছেন তোমাদের সৃষ্টিকর্তা যিনি তোমাদেরকে এতসব নেয়ামতরাজি দিয়ে ভরিয়ে রেখেছেন। তিনি চিরঞ্জিব ও বরকতময় এবং যা কিছু উত্তম তার সবই তোমরা তার কাছ থেকে পেয়ে থাকো। বিশ্বজগতের সবকিছুই ধ্বংসশীল। কিন্তু তিনি ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। কাজেই ইবাদত পাওয়ার যোগ্য একমাত্র তিনিই যিনি চিরঞ্জিব এবং তিনি ছাড়া আর কোনো স্রষ্টা বা পালনকর্তা নেই। তাঁর ইবাদত করতে হবে একনিষ্ঠ চিত্তে এবং সব রকম শিরক ও কুসংস্কার পরিহার করে। প্রশংসা পাওয়ার যোগ্যতাও একমাত্র তাঁরই।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- ভূপৃষ্ঠ নানা কায়দায় ঘুর্ণায়মান থাকা সত্ত্বেও আল্লাহ তায়ালা সেই ভূপৃষ্ঠকে স্থির অবস্থায় মানুষের জন্য বসবাসযোগ্য করে দিয়েছেন।

২- পৃথিবীর সকল সৃষ্টির মধ্যে মানুষকে আল্লাহ তায়াালা সর্বোত্তম অবয়ব দান করেছেন যা মানুষের প্রতি তার বিশেষ অনুগ্রহ হিসেবে বিবেচিত। এ ছাড়া মানুষকে আল্লাহ যত নেয়ামত দান করেছেন তা আর কোনো সৃষ্টি পায়নি।

৩- আল্লাহ তায়ালার নেয়ামত বা অনুগ্রহ থেকে মানুষসহ অন্য কোনো সৃষ্টি বঞ্চিত হয়নি। এতসব অনুগ্রহ যে রবের পক্ষ থেকে এসেছে আমাদের উচিত একমাত্র তাঁর প্রশংসা করা এবং একনিষ্ঠ চিত্তে তাঁর ইবাদতের মশগুল থাকা।#

পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/২৩

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।