জুন ২৩, ২০২১ ১৫:০৩ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র এ পর্বে সূরা গাফির বা মু'মিনের ৬৬ থেকে ৬৮ নম্বর নম্বর পর্যন্ত আয়াতের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ৬৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

 قُلْ إِنِّي نُهِيتُ أَنْ أَعْبُدَ الَّذِينَ تَدْعُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ لَمَّا جَاءَنِيَ الْبَيِّنَاتُ مِنْ رَبِّي وَأُمِرْتُ أَنْ أُسْلِمَ لِرَبِّ الْعَالَمِينَ (66)

“ (হে রাসূল! আপনি) বলুন, তোমরা আল্লাহ্‌ ছাড়া যাদেরকে ডাক, তাদের ইবাদত করতে আমাকে নিষেধ করা হয়েছে, যখন আমার রবের কাছ থেকে আমার কাছে সুস্পষ্ট প্রমাণাদি এসেছে। আর আমি আদেশপ্রাপ্ত হয়েছি সৃষ্টিকুলের রবের কাছে আত্মসমর্পন করতে।”(৪০:৬৬)

আগের কয়েকটি আসরে বেশ কিছু ঐশী নেয়ামতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে যেগুলো বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহর একত্ববাদের প্রমাণ বহন করে। এরপর এই আয়াতে রাসূলুল্লাহ (সা.) মুশরিকদের উদ্দেশে জোর দিয়ে একথা উল্লেখ করেন যে, আমি এমন এক সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে নবুওয়াতপ্রাপ্ত হয়েছি যিনি আমাকে মূর্তিপূজা করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। কাজেই তোমরা একথা ভেবো না যে, আমি গোয়ার্তুমি করে তোমাদের মূর্তির পূজা করছি না। তা ভাবলে তোমরাও একই কারণে আমার ধর্ম গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকবে। আমি বরং বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তি ও দলিল-প্রমাণসাপেক্ষে আল্লাহর ইবাদত করি এবং মূর্তিপূজা থেকে বিরত থাকি। আমি শুধু বিশ্বজগতের স্রষ্টা ও প্রতিপালক আল্লাহর ইবাদত করি এবং তিনি যা আদেশ করেন তাতে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন না এনেই তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করি। আমি নিজেকে আল্লাহর দাস মনে করি যে কিনা পরিপূর্ণভাবে তার মনিবের অনুগত।

এই আয়াতের দু’টি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:

১- আল্লাহর সব নির্দেশ দলিল ও যুক্তিনির্ভর এবং ওহী ও বুদ্ধিবৃত্তির মধ্যে কোনো ধরনের পরস্পর বিরোধিতা নেই।

২- যিনি বিশ্বজগতের প্রতিপালক তিনিই আমাদের আনুগত্য পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন এবং তাঁর আনুগত্য করাই হচ্ছে ইবাদত।

সূরা গাফিরের ৬৭ ও ৬৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

هُوَ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ تُرَابٍ ثُمَّ مِنْ نُطْفَةٍ ثُمَّ مِنْ عَلَقَةٍ ثُمَّ يُخْرِجُكُمْ طِفْلًا ثُمَّ لِتَبْلُغُوا أَشُدَّكُمْ ثُمَّ لِتَكُونُوا شُيُوخًا وَمِنْكُمْ مَنْ يُتَوَفَّى مِنْ قَبْلُ وَلِتَبْلُغُوا أَجَلًا مُسَمًّى وَلَعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ (67) هُوَ الَّذِي يُحْيِي وَيُمِيتُ فَإِذَا قَضَى أَمْرًا فَإِنَّمَا يَقُولُ لَهُ كُنْ فَيَكُونُ (68)

"তিনি (সেই সত্ত্বা যিনি) তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে, পরে শুক্রবিন্দু থেকে, তারপর আলাকাহ (বা জমাটবাধা রক্ত) থেকে, তারপর তিনি তোমাদেরকে বের করেন শিশুরূপে।  তারপর (তিনি তোমাদের বড় করেন) যেন তোমরা উপনীত হও পূর্ণ শক্তির বয়সে (অর্থাৎ যৌবনে), তারপর যেন তোমরা হয়ে যাও বৃদ্ধ।  আর তোমাদের মধ্যে কারো মৃত্যু ঘটে বৃদ্ধ হওয়ার আগেই এবং যাতে তোমরা তোমাদের নির্ধারিতকাল প্রাপ্ত হও আর যেন তোমরা অনুধাবন করো। ”(৪০:৬৭)

“তিনি (সেই সত্ত্বা যিনি) জীবন দান করেন ও মৃত্যু ঘটান এবং যখন তিনি কিছু করতে নির্দেশ করেন (বা কিছু করতে চান) তখন তিনি তাকে বলেন ‘হও’, ফলে তখনই তা হয়ে যায়।” (৪০:৬৮)

এর আগের কোনো কোনো আয়াতে আকাশ ও পৃথিবীসহ প্রাকৃতিক নিদর্শন সৃষ্টিতে আল্লাহর ক্ষমতা তুলে ধরা হয়েছে। আর এই আয়াতে মাটি থেকে মানুষ সৃষ্টি, এরপর মাতৃগর্ভ থেকে শিশুর ভূমিষ্ঠ হওয়া, বেড়ে ওঠা ও একদিন মারা যাওয়ার ঘটনার প্রতি আলোকপাত করা হয়েছে। আদি পিতা হযরত আদম (আ.)কে আল্লাহ সরাসরি মাটি থেকে সৃষ্টি করেন। এরপর বর্তমানে মানবজাতির খাদ্যের প্রধান উৎস গাছ বা প্রাণী যার মূল উৎস মাটি। ফলে হযরত আদম (আ.)’র পরবর্তী সব মানুষও পরোক্ষভাবে মাটির তৈরি।  দ্বিতীয় ধাপ হচ্ছে মাতৃগর্ভের জাইগোট গঠন যা তৈরি হয় পিতার শুক্রাণু ও মাতার ডিম্বাণু থেকে। শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর মিলনের ফলে প্রথমে তা জমাট বাধা রক্তে পরিণত হয় যাকে পবিত্র কুরআনে ‘আলাকাহ’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এরপর মাতৃগর্ভে নয় মাস অসংখ্য পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের পর শিশু মাতৃগর্ভ থেকে পৃথিবীতে আসে। শিশু ও কৈশোরকাল পেরিয়ে সে যৌবনে উপনীত হয়। এই বয়সে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি পূর্ণতা পায় এবং সে সর্বোচ্চ শারিরীক শক্তিপ্রাপ্ত হয়।

কিন্তু এই যৌবনও স্থায়ী হয় না বরং মানুষকে বৃদ্ধাবস্থার দিকে ধাবিত হতে হয়। মানুষের শারিরীক শক্তি ক্ষয় পেতে থাকে এবং সে প্রথমে প্রৌঢ় ও পরে বৃদ্ধ বয়সে উপনীত হয়।  এরপর মৃত্যু মানুষকে পরকালের দরজা অর্থাৎ কবরে পৌঁছে দেয়। অবশ্য কোনো কোনো মানুষ অসুখ-বিসুখ বা দুর্ঘটনার কারণে এই পর্যায়গুলো অতিক্রম করা বা বৃদ্ধ হওয়ার আগেই মারা যায়। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, এই আয়াতে মৃত্যু মানে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কথা বোঝানো হয়নি বরং বলা হচ্ছে, ফেরেশতারা মৃত্যুর সময় মানুষের আত্মাকে গ্রহণ করে মৃত্যু পরবর্তী জীবনে পৌঁছে দেয়। কুরআনে পাকের বিভিন্ন আয়াত থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, মুত্যু মানে ধ্বংস বা বিনাশ নয় বরং পরকালীন অনন্ত জীবনে প্রবেশের দরজা মাত্র।

পরের আয়াতে সৃষ্টির সার্বিক নিয়ম অর্থাৎ জীবন ও মৃত্যুর প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হচ্ছে: জীবন ও মৃত্যু একমাত্র আল্লাহর ইচ্ছায় সংঘটিত হয় এবং তিনি যখনই কিছু করতে ইচ্ছা করেন তখন কালবিলম্ব না করে তা হয়ে যায়।  জীবন ও মৃত্যু শুধু মানুষের জন্য নির্ধারিত নয় বরং সকল প্রাণী এবং উদ্ভিদ এই নিয়মের অন্তর্গত। এটি এমন একটি ব্যবস্থা যা স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা নির্ধারণ করেছেন যার মধ্যে মানুষের কোনো ভূমিকা নেই।  মৃত্যু ও জীবন এমন এক রহস্য, জ্ঞানবিজ্ঞানের এত উন্নতি সত্ত্বেও মানুষ আজ পর্যন্ত যার কোনো কুলকিনারা করতে পারেনি।

অবশ্য এখানে বলে রাখা ভালো যে, জীবন বিভিন্ন আকৃতিতে দৃশ্যমান হয়। বিশাল দেহের অধিকারী প্রাণী, আকাশে উড়তে থাকা পাখি কিংবা সুবিশাল বৃক্ষ- এগুলোর প্রত্যেকেরই আলাদা আলাদা জীবন আছে। জড় জগত থেকে এদের মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করা এবং এক সময় আবার মৃত্যু দিয়ে জড়ো জগতের অধিবাসী করে দেয়া আল্লাহ তায়ালার অপার মহিমা ও রহস্যের সাক্ষ্য বহন করে।  আমাদের কাছে এসব বিষয় অত্যন্ত জটিল এবং অসাধ্য মনে হলেও সর্বশক্তিমান আল্লাহর জন্য এসব করা মোটেই জটিল নয় বরং তিনি ইচ্ছা করার সঙ্গে সঙ্গে যেকোনো কিছু হয়ে যায়।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

‌১- প্রাণহীন মাটি থেকে বোধ ও বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন মানুষ তৈরি করা আল্লাহ তায়ালার শক্তিমত্তার নিদর্শন।

২- বিশ্ব ব্যবস্থা পরিপূর্ণতার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। মৃত্যুর মাধ্যমে মানুষের জীবন শেষ হয়ে যায় না বরং তার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন রুহ বা আত্মাটি কিয়ামত দিবসে উপস্থিত হওয়ার জন্য বিশেষ জগতে প্রবেশ করে।

৩- আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে মানুষ সৃষ্টির জটিল প্রক্রিয়া নিয়ে চিন্তাভাবনা করার নির্দেশ দিয়েছেন যাতে আমরা নিজেদের সৃষ্টি সম্পর্কে জানতে পারি এবং সস্তায় নিজেদেরকে বিক্রি না করি।  সস্তা বলতে, পারলৌকিক অনন্ত সুখ বিক্রি করে পার্থিব জীবনের ধন-দৌলত, সাময়িক ইন্দ্রিয়সুখকে বোঝানো হয়েছে।#

পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/২৩

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।