জুন ২৩, ২০২১ ১৫:০৩ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র এ পর্বে সূরা গাফির বা মু'মিনের ৭৭ থেকে ৮১ নম্বর নম্বর পর্যন্ত আয়াতের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ৭৭ নম্বর নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

فَاصْبِرْ إِنَّ وَعْدَ اللَّهِ حَقٌّ فَإِمَّا نُرِيَنَّكَ بَعْضَ الَّذِي نَعِدُهُمْ أَوْ نَتَوَفَّيَنَّكَ فَإِلَيْنَا يُرْجَعُونَ (77)

“সুতরাং (হে রাসূল‍! এদের অত্যাচারের মোকাবিলায়) আপনি ধৈর্য ধারণ করুন।  কেননা, আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য। অতঃপর আমি তাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি প্রদান করি তার কিছু যদি আপনাকে দেখিয়ে দেই অথবা (তার আগে) আপনাকে পৃথিবী থেকে উঠিয়ে নেই, তবে (এর যেকোনো একটি ক্ষেত্রে) তাদেরকে আমার কাছে ফিরিয়ে আনা হবেই (এবং তারা তাদের শাস্তি দেখতে পাবে)।" (৪০:৭৭)

এই আয়াতে বিশ্বনবী (সা.) ও তাঁর অনুসারীদেরকে শত্রুপক্ষের অত্যাচারের মোকাবিলায় ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়ে বলা হচ্ছে: তাদের বিরোধিতা ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির চেষ্টার বিপরীতে তোমরা হীনবল হয়ে যেও না। বরং উল্টো তারা যত বেশি বিরোধিতা করবে তোমাদেরকে তত বেশি ধৈর্যধারণ ও শক্তি অর্জন করতে হবে যাতে একদিন তোমরা বিজয় লাভ করতে পারো। আল্লাহর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সত্য প্রত্যাখ্যানকারীরা পার্থিব জীবনেই কিছু শাস্তি ভোগ করে; কিন্তু আমরা যেন শতভাগ এ ধারনা করে বসে না থাকি যে, তারা আমাদের জীবদ্দশায় অবশ্যই সাজা ভোগ করবে। আমরা থাকি বা না থাকি আল্লাহর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হবেই। আর পরিপূর্ণ শাস্তি দেয়া হবে কিয়ামতের দিন এবং সেদিন সব মানুষ পরস্পরের পুরস্কার ও শাস্তি প্রত্যক্ষ করতে পারবে।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- ধর্ম মেনে চলার কারণে মানুষের সামনে যেসব সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা আসে তা ধৈর্য ধরে সহ্য করতে হবে। অধৈর্য হয়ে ধর্মীয় শিক্ষা থেকে দূরে সরে যাওয়া যাবে না।

২- আল্লাহ তায়ালার প্রজ্ঞা অনুযায়ী অপরাধী ব্যক্তিদের শাস্তি দ্রুত বা দেরিতে আসে। কিন্তু শাস্তি যে আসবেই তাতে সংশয় প্রকাশ করার সুযোগ নেই।

সূরা গাফিরের ৭৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا رُسُلًا مِنْ قَبْلِكَ مِنْهُمْ مَنْ قَصَصْنَا عَلَيْكَ وَمِنْهُمْ مَنْ لَمْ نَقْصُصْ عَلَيْكَ وَمَا كَانَ لِرَسُولٍ أَنْ يَأْتِيَ بِآَيَةٍ إِلَّا بِإِذْنِ اللَّهِ فَإِذَا جَاءَ أَمْرُ اللَّهِ قُضِيَ بِالْحَقِّ وَخَسِرَ هُنَالِكَ الْمُبْطِلُونَ (78)

“অবশ্যই আমি আপনার পূর্বে অনেক রাসূল পাঠিয়েছি। আমরা তাদের কারো কারো কাহিনী আপনার কাছে বিবৃত করেছি এবং (অপর) কারো কারো কাহিনী আপনার কাছে বিবৃত করিনি। আল্লাহ্‌র অনুমতি ছাড়া কোন নিদর্শন উপস্থাপন করা রাসূলের কাজ নয়। অতঃপর যখন (কাফেরদের শাস্তির ব্যাপারে) আল্লাহর আদেশ আসবে তখন ন্যায়সংগতভাবে ফয়সালা হয়ে যাবে। আর তখন মিথ্যাশ্রয়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।” (৪০:৭৮)

এই আয়াতে রাসূলুল্লাহ (সা.)কে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে আল্লাহ বলছেন: আপনার আগেও পৃথিবীতে আরো বহু নবী-রাসূল এ ধরনের সমস্যার মোকাবিলা করেছেন কিন্তু তারা কখনো ধৈর্যচ্যুত হননি। তাদের কারো কারো কথা আপনাকে জানিয়েছি এবং বহু নবীর কথাই জানাইনি।

ইতিহাসের প্রতিটি যুগেই একদল দাম্ভিক ও অত্যাচারী মানুষ সত্যের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তারা সত্যপন্থিদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেছে এবং তাদেরকে হত্যা ও নির্যাতন করার মাধ্যমে সত্যের বাণী চিরতরে নিভিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে। এ ধরনের অহংকারী মানুষ প্রতিদিন নতুন নতুন অজুহাত উপস্থাপন করে। অতীতের নবী-রাসূলদের কাছে এসে তারা তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী মুজিযা বা অলৌকিক নিদর্শন তুলে ধরার আর্জি জানাত।

অথচ মুজিযা দেখানোর ক্ষমতা রয়েছে একমাত্র আল্লাহর এবং নবীরা নিজেদের পক্ষ থেকে তা দেখানোর ক্ষমতা রাখেন না। কেবলমাত্র আল্লাহ তায়ালা অনুমতি দিলেই তারা মুজিযা দেখাতে পারেন। অন্য কথায়, নবীর সত্যতা প্রমাণ এবং মানুষের সামনে সত্য তুলে ধরার স্বার্থে কখনো কখনো আল্লাহ নবীদেরকে মুজিযা দেখানোর অনুমতি দেন। বিষয়টা এমন নয় যে, যখন তখন কাফিররা এসে নবীকে মুজিযা দেখাতে বলবে আর অমনি তিনি দেখাতে শুরু করে দেবেন।

এ ধরনের মিথ্যাশ্রয়ী ব্যক্তিদেরকে কিয়ামতের দিন ন্যায়সঙ্গত বিচারের মাধ্যমে শাস্তি দেয়া হবে। সেদিন পার্থিব জীবনে ফিরে আসার আকুতি গ্রহণ করা হবে না। সেদিন তারা সবদিক দিয়ে নিজেদেরকে চরম ক্ষতির শিকার হতে দেখবে।

এই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:

১- আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে অতীত নবী-রাসূল ও জাতিগুলোর ঘটনা অধ্যয়ন করতে বলেছেন যাতে আমরা সত্য পথে বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতায় হতাশ হয়ে না পড়ি।

২- প্রকৃত পুরস্কার ও শাস্তি পাওয়ার সময় হচ্ছে কিয়ামতের দিন। সেদিন ক্ষমতা ও সম্পদ কোনো কাজে আসবে না। একমাত্র ঈমান ও নেক আমল সেদিন মানুষকে মুক্তি দিতে পারবে।   

সূরা গাফিরের ৭৯ থেকে ৮১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

اللَّهُ الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الْأَنْعَامَ لِتَرْكَبُوا مِنْهَا وَمِنْهَا تَأْكُلُونَ (79) وَلَكُمْ فِيهَا مَنَافِعُ وَلِتَبْلُغُوا عَلَيْهَا حَاجَةً فِي صُدُورِكُمْ وَعَلَيْهَا وَعَلَى الْفُلْكِ تُحْمَلُونَ (80) وَيُرِيكُمْ آَيَاتِهِ فَأَيَّ آَيَاتِ اللَّهِ تُنْكِرُونَ (81)

“আল্লাহই তোমাদের জন্য চতুষ্পদ জন্তু সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা এদের কতকের উপর আরোহণ করতে পার আর কতকের (গোশত) খেতে পার। ” (৪০:79)

“এবং এগুলোতে তোমাদের জন্য রয়েছে প্রচুর উপকার; তোমরা যা প্রয়োজন বোধ কর এগুলো দ্বারা তা পূর্ণ করে থাক এবং এদের উপর ও জাহাজের উপর তোমাদেরকে বহন করা হয়।” (৪০:৮0)

“আর তিনি (নিয়মিত) তোমাদেরকে তাঁর নিদর্শনাবলী দেখান। অতএব তোমরা আল্লাহর কোন্ কোন্ নিদর্শনকে অস্বীকার করবে?”  (৪০:৮১)

এই তিন আয়াতে চতুষ্পদ জন্তু বা গৃহপালিত পশু মানুষের কি কি কাজে লাগে সেসবের প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হচ্ছে: কোনো কোনো পশু তোমাদের খাওয়ার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। এই আয়াতের মাধ্যমে গরু, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি গবাদি পশু জবাই করে খাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে। এই অনুমতি না থাকলে নিরপরাধ পশু হত্যা করা মানুষের জন্য জায়েয হতো না। এ ছাড়া, উটের মতো চতুষ্পদ জন্তুর পিঠে চড়ে মানুষ তপ্ত মরুভূমিতে যাতায়াত করতে পারে। আধুনিক যুগের এত এত যানবাহন সত্ত্বেও এখনো সংকীর্ণ পথ, বিশেষ করে পাহাড়ি আঁকাবাঁকা সরু পথে বোঝা বহন করার জন্য গাধার কোনো বিকল্প নেই। এ ধরনের গৃহপালিত পশুকে মানুষের নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দেয়া আমাদের প্রতি আল্লাহ তায়ালার অন্যতম অনুগ্রহ এবং তাঁর অন্যতম নিদর্শন।

এই চতুষ্পদ জন্তুগুলো দিয়ে মানুষ আরো নানাভাবে উপকৃত হয়।  এসব পশুর পশম ও চামড়া থেকে অনেক জিনিস তৈরি হয়। এগুলোর দুধ থেকে ঘি, মাখন এবং পনির ইত্যাদিও তৈরি হয়। এই আয়াতে জাহাজে আরোহণের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। অর্থাৎ ভূভাগে চলাচলের জন্য যেমন আল্লাহ তায়ালা বাহনের ব্যবস্থা করেছেন তেমনি সাগরে চলাচলের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও তিনি করে রেখেছেন যাতে মানুষ সহজে ভ্রমণ ও মালামাল বহন করতে পারে।

শেষ আয়াতে বলা হচ্ছে: আল্লাহ তায়ালা সারাক্ষণ মানুষকে তার নিদর্শন দেখাতে থাকেন এবং মানুষ যেদিকেই তাকাবে সেদিকেই তাঁর নিদর্শন দেখতে পাবে। সবার জন্য এসব নিদর্শন স্পষ্ট হলেও কিছু মানুষ নানা অজুহাত দেখিয়ে আল্লাহকে অস্বীকার করে।

এই তিন আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে:

১- আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীতে তার সকল সৃষ্টিকে মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন।

২- চতুষ্পদ জন্তুর শারিরীক শক্তি মানুষের চেয়ে অনেক বেশি হলেও সেগুলোকে মানুষের নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দেয়া আল্লাহ তায়ালার অন্যতম বড় অনুগ্রহ।

৩- অকৃতজ্ঞতা মানুষের একটি স্বাধারণ বৈশিষ্ট্য। তারা আল্লাহর দেয়া অনুগ্রহ উপভোগ করা সত্ত্বেও আল্লাহর অস্তিত্বকেই অস্বীকার করে বসে। মানুষ আল্লাহর বিধি-নিষেধ মেনে চলতে চায় না।#

পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/২৩

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।