সূরা গাফির: আয়াত ৮২-৮৫ (পর্ব-১৯)
পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র এ পর্বে সূরা গাফির বা মু'মিনের ৮২ থেকে ৮৫ নম্বর নম্বর পর্যন্ত আয়াতের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ৮২ নম্বর নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
أَفَلَمْ يَسِيرُوا فِي الْأَرْضِ فَيَنْظُرُوا كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ كَانُوا أَكْثَرَ مِنْهُمْ وَأَشَدَّ قُوَّةً وَآَثَارًا فِي الْأَرْضِ فَمَا أَغْنَى عَنْهُمْ مَا كَانُوا يَكْسِبُونَ (82)
“তারা কি জমিনে বিচরণ করে দেখেনি তাদের পূর্বে যারা গত হয়েছে তাদের পরিণাম কেমন হয়েছিল? তারা জমিনে ছিল এদের চেয়ে সংখ্যায় বেশী এবং শক্তিতে ও কীর্তিতে বেশী প্রবল, কিন্তু তারা (অধিক সংখ্যা ও শক্তি দিয়ে) যা অর্জন করত তা তাদের কোন কাজে আসেনি।” (৪০:৮২)
মানব জাতির ইতিহাস দুইভাবে জানা সম্ভব। এর একটি হচ্ছে যে যুগের ঘটনা সেই যুগের মানুষের লিখে যাওয়া বই এবং অন্যটি হচ্ছে পৃথিবীর বুকে থেকে যাওয়া সেই যুগের পুরাকীর্তি বা ঐতিহাসিক নিদর্শন। মহান আল্লাহ এই আয়াতে অত্যাচারী ও দাম্ভিক ব্যক্তিদের উদ্দেশ করে বলছেন: যদি তোমরা নিজেদের পরিণতি আগাম জানতে চাও তাহলে পৃথিবীর বুকে ঘুরে দেখ অতীতে তোমাদের মতো অত্যাচারী ও দাম্ভিকদের পরিণতি কি হয়েছিল। তাদের ক্ষমতার দম্ভ চূর্ণ হয়েছে, সেই প্রাসাদগুলা ধ্বংস হয়েছে এবং তাদের বিশাল সামরিক বাহিনী ঝরা পাতার মতো নিঃশেষ হয়ে গেছে। ফেরাউনের বিশাল সেনাবাহিনী কি তাকে নীল নদে ডুবে মরে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে পেরেছে? পাহাড়ের বুকে বিশাল প্রাসাদ নির্মাণ করে বসবাসকারীরা কি আল্লাহর ইচ্ছার বিপরীতে নিজেদের রক্ষা করতে পেরেছে?
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- ইসলাম অতীত জাতিগুলোর ইতিহাস জানার ওপর অত্যন্ত গুরুত্ব আরোপ করেছে।
২- আল্লাহর ইচ্ছার বিপরীতে শক্তি ও ক্ষমতার দম্ভ দেখানো উচিত নয়।
৩- অতীত সভ্যতাগুলো ধ্বংস হয়ে যাওয়ার একটি বড় কারণ ছিল নবী-রাসূলদের শিক্ষাকে প্রত্যাখ্যান করা।
সূরা গাফিরের ৮৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
فَلَمَّا جَاءَتْهُمْ رُسُلُهُمْ بِالْبَيِّنَاتِ فَرِحُوا بِمَا عِنْدَهُمْ مِنَ الْعِلْمِ وَحَاقَ بِهِمْ مَا كَانُوا بِهِ يَسْتَهْزِئُونَ (83)
“যখন তাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শনসহ তাদের রাসূল আসলেন তখন তারা নিজেদের (কাছে থাকা সামান্য) জ্ঞানের দম্ভ করল। কিন্তু তারা যা নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করত (সেই আযাব) তাদেরকে বেষ্টন করল।” (৪০:৮৩)
আগের আয়াতের ধারাবাহিকতায় এই আয়াতে বলা হচ্ছে: অতীতের দাম্ভিক শক্তিগুলো মনে করত জ্ঞানবিজ্ঞানে তারা এতটা অগ্রগতি অর্জন করেছে যে, তারা তা দিয়ে ঐশী আজাব ঠেকিয়ে দিতে পারবে। এ কারণে তারা নবী-রাসূলদের বিরুদ্ধাচরণ করত এবং নবীদের পরকাল সম্পর্কিত দাওয়াতের বাণীকে উপহাস করত। তারা নিজেদেরকে অনেক জ্ঞানী মনে করত এবং ধর্মীয় বিশ্বাসকে তাদের সেই স্বল্প জ্ঞান দিয়ে প্রমাণ করা সম্ভব নয় বলে তা প্রত্যাখ্যান করত। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা যখনই তাদেরকে শাস্তি দেয়ার ইচ্ছা করেন তখন শত জ্ঞানবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দিয়েও তারা সেই ইচ্ছার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি বরং ধ্বংস হয়ে গেছে। অন্য কথায় যে বিষয়কে তারা তুচ্ছজ্ঞান করে প্রত্যাখ্যান করেছে সেটিই তাদেরকে গ্রাস করেছে।
পবিত্র কুরআনের দৃষ্টিতে মানুষের পথভ্রষ্টতা ও ধ্বংসের প্রধান কারণ ঔদ্ধত্ব ও অহংকার। এই দম্ভের উৎস হতে পারে, অর্থ, ক্ষমতা, সংখ্যার আধিক্য, বিশাল সামরিক বাহিনী কিংবা জ্ঞান-বিজ্ঞান।
বর্তমান যুগে এই দম্ভ ও অহংকারের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আমরা উন্নত বিশ্বে দেখতে পাই। গত কয়েক শতাব্দি ধরে উন্নত বিশ্বে ধর্ম প্রত্যাখ্যান করে নাস্তিক্যবাদের প্রতি মানুষের আগ্রহ তৈরি হয়েছে সেই জ্ঞানবিজ্ঞানের উন্নতিকে কেন্দ্র করেই। বৈজ্ঞানিক উন্নতি নিয়ে তাদের অহংকার এতটা ধ্বংসাত্মক হয়ে পড়েছে যে, তারা সকল জ্ঞানের মূল উৎস ঐশী বাণীকে প্রত্যাখ্যান ও তা নিয়ে বিদ্রূপ করছে। তারা দাবি করছে, বিজ্ঞানের এই উন্নতির যুগে নবী-রাসূলদের শিক্ষা গ্রহণ করার প্রয়োজন নেই; কাজেই তারা তা মানবজীবন থেকে চিরতরে বিদায় করে দিয়েছে।
কিন্তু এই বিশ্বাসের যে কোনো ভিত্তি নেই তা অচিরেই কথিত উন্নত বিশ্বের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রমাণ করেছে, বিজ্ঞান ও শিল্পের উন্নতি মানুষকে শান্তি তো দিতে পারেনি উল্টো অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি ধ্বংসের কাছাকাছি নিয়ে গেছে।
এই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:
১- নবী রাসূলগণ সুস্পষ্ট দলিল-প্রমাণ ও মুজিযা নিয়ে পৃথিবীতে এসেছিলেন। ফলে সত্যসন্ধানী যেকোনো মানুষ তাদের দাওয়াতের বাণী গ্রহণ করে।
২- মানুষকে আল্লাহ সামান্য যে জ্ঞান দিয়েছেন তাতে যদি সে অহংকারী হয়ে পড়ে তাহলে তার পক্ষে আর সত্যবাণী গ্রহণ করা সম্ভব হয় না।
৩- আমাদের মনে রাখতে হবে, ঐশী শিক্ষার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণকারী সভ্যতাগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে।
সূরা গাফিরের ৮৪ থেকে ৮৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
فَلَمَّا رَأَوْا بَأْسَنَا قَالُوا آَمَنَّا بِاللَّهِ وَحْدَهُ وَكَفَرْنَا بِمَا كُنَّا بِهِ مُشْرِكِينَ (84) فَلَمْ يَكُ يَنْفَعُهُمْ إِيمَانُهُمْ لَمَّا رَأَوْا بَأْسَنَا سُنَّةَ اللَّهِ الَّتِي قَدْ خَلَتْ فِي عِبَادِهِ وَخَسِرَ هُنَالِكَ الْكَافِرُونَ (85)
“অতঃপর যখন তারা আমার (কঠিন) শাস্তি প্রত্যক্ষ করল তখন বলল: আমরা এক আল্লাহতেই ঈমান আনলাম এবং আমরা তাঁর সাথে যাদেরকে শরীক করতাম তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করলাম।” (৪০:৮৪)
“কিন্তু তারা যখন আমার (কঠোর) শাস্তি প্রত্যক্ষ করল তখন তাদের ঈমান তাদের কোন উপকারে এলোনা। আল্লাহর (এই) বিধান (পূর্ব হতেই) তার বান্দাদের মধ্যে চলে এসেছে (যে, শাস্তি প্রত্যক্ষ করার পর ঈমান গ্রহণ করা হয় না) এবং সেই ক্ষেত্রে কাফিরেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।” (৪০:৮৫)
যেসব উদ্ধত ও স্বেচ্ছাচারী মানুষ নবীদের শিক্ষার বিপরীতে অবস্থান নেয় এই দুই আয়াতে তাদের পরিণতি বর্ণনা করা হয়েছে। বলা হচ্ছে: এই মানুষগুলোই যখন পার্থিব জীবনে আল্লাহর শাস্তি প্রত্যক্ষ করে এবং নিজেদেরকে দুর্বল ও অসহায় দেখতে পায় তখন তাদের মধ্যে অনুশোচনা আসে। তখন তারা কুফরি ও শিরক বাদ দিয়ে এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার কথা ঘোষণা করে। এতদিন তারা মূর্তিসহ যেসব উপাস্যের পূজা করত তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে। খুব সহজেই অনুমেয় যে, ঐশী শাস্তির ভয়ে তারা এই ঈমান এনেছে এবং এর কোনো মূল্য আল্লাহর কাছে নেই।
উদাহরণস্বরূপ, পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ফেরাউন যখন নীল নদে ডুবে যায় তখন সে আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছিল কিন্তু তা কবুল করা হয়নি। কারণ, ওই মুহূর্তে তার জন্য রক্ষা পাওয়ার সব পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এবং ঈমান আনা ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল না। অথচ, সেই ঈমান আল্লাহ তায়ালার কাছে মর্যাদাপূর্ণ যখন হাজারো উপায় ও অবলম্বন থাকা অবস্থায় মানুষ আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে ও তাঁর সাহায্য চায়।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- দাম্ভিক, উদ্ধত ও গোয়ার প্রকৃতির লোকজন ঐশী শাস্তি না দেখা পর্যন্ত ঈমান আনে না। কিন্তু এই ঈমানের কোনো মূল্য আল্লাহর কাছে নেই।
২- সেই ঈমান আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য যা ঐশী শাস্তি প্রত্যক্ষ করার আগে এবং অন্যান্য অবলম্বন থাকা অবস্থায় আনা হয়।
৩- শিরকি হালতে মৃত্যু মানব জীবনের সবচেয়ে বড় ক্ষতি। আমাদেরকে আল্লাহ তায়ালার কাছে ঈমানি মৃত্যু কামনা করতে হবে।#
পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/২৩
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।