সূরা ফুসসিলাত: আয়াত ৮-১২ (পর্ব-২)
পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র এ পর্বে সূরা ফুসসিলাতের ৮ থেকে ১২ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
إِنَّ الَّذِينَ آَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَهُمْ أَجْرٌ غَيْرُ مَمْنُونٍ (8)
“নিঃসন্দেহে যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে তাদের জন্য রয়েছে চিরকালীন পুরস্কার।” (৪১:৮)
গত আসরের শেষ আয়াতটি ছিল মুশরিকদের সম্পর্কে যারা যাকাত দেয় না, সৎকাজ করে না এবং পরকালে যাদের বিশ্বাস নেই। পরকালে বিশ্বাস নেই বলে তারা যদি সৎকাজ করেও থাকে তবুও তারা পরকালীন জীবনে কোনো পুরস্কার পাবে না। এরপর এই আয়াতে বলা হচ্ছে: আল্লাহ ও পরকালে যাদের বিশ্বাস রয়েছে এবং ব্যক্তিগত সামর্থ্য ও যোগ্যতা এবং সামাজিক অবস্থান সাপেক্ষে সৎকাজ করে, অভাবী মানুষকে দান-খয়রাত করে তাদের জন্য পরকালীন জীবনে এমন পুরস্কার রয়েছে যা কোনোদিন শেষ হবে না।
এই আয়াতের দু’টি শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে:
১- ঈমান ও সৎকাজ পরস্পরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত এবং কিয়ামতের দিন এর একটি ছাড়া অপরটি কোনো কাজে আসবে না।
২- পারলৌকিক পুরস্কার কোনোদিনও শেষ হবে না। অথচ পার্থিব জীবনের সবচেয়ে দামী পুরস্কারটিও সীমাবদ্ধ এবং ধ্বংসশীল।
সূরা ফুসসিলাতের ৯ ও ১০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
قُلْ أَئِنَّكُمْ لَتَكْفُرُونَ بِالَّذِي خَلَقَ الْأَرْضَ فِي يَوْمَيْنِ وَتَجْعَلُونَ لَهُ أَنْدَادًا ذَلِكَ رَبُّ الْعَالَمِينَ (9) وَجَعَلَ فِيهَا رَوَاسِيَ مِنْ فَوْقِهَا وَبَارَكَ فِيهَا وَقَدَّرَ فِيهَا أَقْوَاتَهَا فِي أَرْبَعَةِ أَيَّامٍ سَوَاءً لِلسَّائِلِينَ (10)
“ (হে রাসূল আপনি) বলুন, ‘তোমরা কি তাঁকে অস্বীকার করবে যিনি দু’দিনে যমীন সৃষ্টি করেছেন? আর তোমরা কি তাঁর সমকক্ষ তৈরি করছ? তিনিই তো বিশ্বজগতের প্রতিপালক। ” (৪১:৯)
“আর তিনি ভূপৃষ্ঠে স্থাপন করেছেন (অটল) পর্বতমালা এবং তাতে দিয়েছেন (অফুরন্ত কল্যাণ ও) বরকত এবং চার দিনের মধ্যে এতে যাঞ্চাকারীদের জন্য সমভাবে (ও তাদের প্রয়োজন অনুসারে) রিজিকের ব্যবস্থা করেছেন।”(৪১:১০)
আল্লাহ তায়ালা এই দুই আয়াতে বলছেন: আমরা যে ভূপৃষ্ঠের উপর বসবাস করি তা এক আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন এবং এই কাজে তাঁর কোনো শরিক ছিল না। তিনি যে শুধু যমিন সৃষ্টি করেছেন তা নয় বরং গোটা বিশ্বজগত প্রতিপালনের দায়িত্বও তিনি নিয়েছেন। কাজেই একমাত্র তিনিই ইবাদত পাওয়ার যোগ্য যিনি একাধারে সৃষ্টি করেছেন, প্রতিপালন করছেন এবং মালিকানা ও কর্তৃত্ব যার।
ভূপৃষ্ঠ সৃষ্টি করার পর মানুষ, জীবজন্তু, উদ্ভিদ ও তৃণলতার বেঁচে থাকার জন্য যা কিছু প্রয়োজন তাও আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টি করে তাদের নিয়ন্ত্রণে দিয়ে দিয়েছেন। আকাশচুম্বি ও অটল পাহাড়, সুবিশাল সাগর-মহাসাগর, গহীন জঙ্গল, ভূগর্ভস্থ খনিজ সম্পদ- এ সব কিছুই এই ভূপৃষ্ঠের উপর বসবাসরতদের বেঁচে থাকার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। ভূপৃষ্ঠে রয়েছে বরকত এবং খাদ্যদ্রব্যের অফুরন্ত ভাণ্ডার। এই বরকত ও রিজিক মানুষসহ অন্যান্য জীবের প্রয়োজন অনুযায়ী সৃষ্টি করা হয়েছে এবং এতে কোনো কমতি নেই। অবশ্য যমীন সৃষ্টির এই প্রক্রিয়া ধাপে ধাপে সম্পন্ন করেছেন আল্লাহ তায়ালা। দুই ধাপে এটি বসবাস উপযোগী হয়েছে এবং আরো দুই ধাপে এটিতে অসংখ্য নেয়ামতরাজি ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে মানুষ যাতে এখানে বসবাস করে তার সব প্রয়োজন মেটাতে পারে সেজন্য মোট চারটি পর্যায় সম্পন্ন হয়েছে।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- বিশ্বজগতের সৃষ্টিকর্তা ও প্রতিপালক একই সত্ত্বা। কিন্তু মুশরিকরা আল্লাহকে সৃষ্টিকর্তা হিসেবে বিশ্বাস করে ঠিকই কিন্তু বিশ্বজগত পরিচালনায় তাঁর সঙ্গে অন্য বস্তুসম্ভার বা ব্যক্তিবর্গকে শরিক করে।
২- বিশ্বজগত সৃষ্টি হয়েছে ধীরে ধীরে পর্যায়ক্রমে; একসঙ্গে নয়। এই ভূপৃষ্ঠ সৃষ্টি হয়েছে দু’টি ধাপে।
৩- আল্লাহ তায়ালা যে বিশ্বজগতের প্রতিপালক তার অন্যতম প্রমাণ হচ্ছে তিনি এই পৃথিবীতে মানুষের প্রয়োজন মেটানোর জন্য অসংখ্য নেয়ামত ও রিজিক ছড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু তিনি মানুষকে কর্মের স্বাধীনতা দিয়েছেন বলে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ অন্যায়ভাবে বেশিরভাগ সম্পদ কূক্ষিগত করে রেখেছে। ফলে পৃথিবীতে সৃষ্টি হয়েছে দরিদ্র ও বঞ্চিত বিশাল জনগোষ্ঠী।
সূরা ফুসসিলাতের ১১ ও ১২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
ثُمَّ اسْتَوَى إِلَى السَّمَاءِ وَهِيَ دُخَانٌ فَقَالَ لَهَا وَلِلْأَرْضِ اِئْتِيَا طَوْعًا أَوْ كَرْهًا قَالَتَا أَتَيْنَا طَائِعِينَ (11) فَقَضَاهُنَّ سَبْعَ سَمَاوَاتٍ فِي يَوْمَيْنِ وَأَوْحَى فِي كُلِّ سَمَاءٍ أَمْرَهَا وَزَيَّنَّا السَّمَاءَ الدُّنْيَا بِمَصَابِيحَ وَحِفْظًا ذَلِكَ تَقْدِيرُ الْعَزِيزِ الْعَلِيمِ (12)
অতঃপর তিনি আসমানের দিকে মনোনিবেশ করেন, যা ছিল ধূম্রপুঞ্জবিশেষ। অতঃপর তিনি ওকে (অর্থাৎ আকাশকে) ও পৃথিবীকে বললেন: তোমরা ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায় এস। ওরা বলল, আমরা অনুগত হয়ে এলাম।” (৪১:১১)
“অতঃপর তিনি আকাশমন্ডলীকে দু’দিনে সাত আসমানে পরিণত করলেন, (তাকে শক্তভাবে দাঁড় করিয়ে দিলেন) এবং প্রত্যেক আকাশের নিকট (তার স্বীয়) কর্তব্য ওহীর মাধ্যমে জানিয়ে দিলেন। আর আমি পৃথিবীর আকাশকে সুশোভিত করলাম প্রদীপমালা (অর্থাৎ তারকারাজি) দ্বারা এবং (তাকে) করলাম সুরক্ষিত। এই হলো পরাক্রমশালী সর্বজ্ঞ আল্লাহর ব্যবস্থাপনা।” (৪১:১২)
যমিন সৃষ্টির পর্যায়ক্রম বর্ণনার পর এই দুই আয়াতে আসমানের শ্রেণিবিন্যাসের প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হচ্ছে: প্রথমে এই আসমান পূঞ্জিভূত ও বিশাল ধোঁয়া ও গ্যাস আকারে ছিল। পরে আল্লাহ তায়ালা এগুলোকে সুবিন্যস্ত ও সুদৃঢ় করে দেন। তিনি যখন ইচ্ছা করেন তখন আসমান ও জমিনকে বাধ্যগত হয়ে তাঁর আদেশ পালন করতে হয়। তাদের ভালো লাগুক বা না লাগুক আল্লাহ যেভাবে চেয়েছেন সেভাবেই তাদেরকে আকৃতি ধারণ করতে হয়েছে। ভূপৃষ্ঠ যেমন দুই ধাপে এর অধিবাসীদের ধারণ করার অবস্থায় পৌঁছেছে তেমনি বিশাল আসমানও দুই পর্যায়ে আল্লাহ যেভাবে চেয়েছেন সেভাবে বিন্যস্ত হয়েছে।
অবশ্য আল্লাহ তায়ালা সাতটি আসমান সৃষ্টি করেছেন এবং আমরা আমাদের মাথার উপর যেটি দেখতে পাই সেটি হচ্ছে প্রথম আসমান। অন্য কথায়, আল্লাহর সৃষ্ট সাতটি জগতের মাত্র একটি জগত আমাদের চোখের সামনে ধরা দিয়েছে। টেলিস্কোপসহ অন্যান্য অত্যাধুনিক যন্ত্র দিয়ে মানুষ যত দূরের গ্রহ-নক্ষত্রই দেখতে পাক না কেন তার সবই প্রথম আসমানে স্থাপিত। প্রথম আসমানের বাইরে দৃষ্টি নিক্ষেপের সাধ্যও মানুষের নেই।
আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, রাতের অন্ধকারে তারকারাজি হচ্ছে উজ্জ্বল প্রদীপমালার মতো। এর প্রতিটি গ্রহ-নক্ষত্রের রয়েছে আলাদা আলাদা রহস্য এবং এগুলো সম্পর্কে মানুষকে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করার আহ্বান জানানো হয়েছে। এ ছাড়া, আল্লাহ তায়ালা এই গ্রহ-নক্ষত্রকে সব ধরনের বিপদাপদ থেকে রক্ষা করেছেন।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- মানুষ ছাড়া সকল সৃষ্টি আল্লাহর অনুগত। কাজেই মানুষকে পার্থিব জীবনের স্বল্প সময়ে কর্মের যে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে তাকে যেন আমরা আল্লাহর আনুগত্যে কাজে লাগাই।
২- বিশ্বজগত সৃষ্টি ও পরিচালনার বিষয়টি আমাদের উপলব্ধি করার ক্ষমতার চেয়ে অনেক বিশাল। আমরা আকাশ বা মহাকাশ যাই বলি না কেন তার সবই প্রথম আসমান। অর্থাৎ এখন পর্যন্ত মহাকাশের যতটুকু মানুষ আবিষ্কার করেছে এবং ভবিষ্যতেও করবে তা শুধুমাত্র প্রথম আসমানের বিষয়। এর বাইরের বাকি ছয়টি আসমানের সবকিছুই মানুষের জ্ঞানের বাইরে।#
পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/২৪
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।