সূরা ফুসসিলাত: আয়াত ১৩-১৮ (পর্ব-৩)
পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র এ পর্বে সূরা ফুসসিলাতের ১৩ থেকে ১৮ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ১৩ ও ১৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
فَإِنْ أَعْرَضُوا فَقُلْ أَنْذَرْتُكُمْ صَاعِقَةً مِثْلَ صَاعِقَةِ عَادٍ وَثَمُودَ (13) إِذْ جَاءَتْهُمُ الرُّسُلُ مِنْ بَيْنِ أَيْدِيهِمْ وَمِنْ خَلْفِهِمْ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا اللَّهَ قَالُوا لَوْ شَاءَ رَبُّنَا لَأَنْزَلَ مَلَائِكَةً فَإِنَّا بِمَا أُرْسِلْتُمْ بِهِ كَافِرُونَ (14)
“তবুও যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে বলুন: আমি তোমাদেরকে আদ ও সামূদের ধ্বংসের মতই এক মহাধ্বংস সম্পর্কে সতর্ক করছি।” (৪১:১৩)
“যখন ওদের নিকট ওদের সম্মুখ ও পশ্চাৎ দিক হতে (আমার) প্রেরিত পুরুষগণ এসেছিল (এবং তারা বলেছিল), ‘তোমরা আল্লাহ ব্যতীত কারও উপাসনা করো না।’ তখন ওরা (জবাবে) বলেছিল, ‘আমাদের প্রতিপালক যদি (নবী পাঠাতেই) চাইতেন তাহলে তিনি অবশ্যই ফেরেশতা প্রেরণ করতেন। অতএব তোমরা যা নিয়ে প্রেরিত হয়েছ আমরা তা প্রত্যাখ্যান করলাম’।” (৪১:১৪)
এই দুই আয়াতে কাফেরদের উদ্দেশ করে বলা হচ্ছে: সত্যের বিরোধিতার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার ক্রোধের শিকার হওয়া। অতীতের কিছু জাতি নবীদের দাওয়াতের বাণী শোনা ও অলৌকিক নিদর্শন দেখা সত্ত্বেও তা প্রত্যাখ্যান করেছিল। এর কারণ হিসেবে তারা তাদের নবীদের বলেছিল: যদি তুমি আমাদেরকে তোমার কাছে আসা ফেরেশতাদেরকে দেখাতে পারো তাহলে আমরা তোমার প্রতি ঈমান আনব। কিন্তু তুমি যখন তা দেখাতে পারছ না তখন আমরা তোমার দাওয়াতের বাণী প্রত্যাখ্যান করছি। স্বাভাবিকভাবেই এ ধরনের গোঁয়ার্তুমি ও ধৃষ্টতার ফলে আল্লাহ তায়ালার মহাশাস্তি নেমে আসে এবং তিনি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মাধ্যমে ওইসব জাতিকে শাস্তি দেন।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- সব শাস্তি পরকালের জন্য নির্ধারিত থাকে না বরং কিছু শাস্তি পার্থিব জীবনেই দেয়া হয়। আমাদের পাপ ও মন্দ কাজগুলোর কারণে আমরা যেন দুনিয়া ও আখেরাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হই সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।
২- মানুষ যাতে তাদের কুফর ও শিরকের ব্যাপারে কোনো অপব্যাখ্যা দিতে না পারে সেজন্য মহান আল্লাহ নবী-রাসূলগণের মাধ্যমে তাদেরকে আগে সতর্ক করেন। আল্লাহ তায়ালার রীতি হচ্ছে, তিনি সতর্ক না করে কাউকে শাস্তি দেন না।
সূরা ফুসসিলাতের ১৫ ও ১৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
فَأَمَّا عَادٌ فَاسْتَكْبَرُوا فِي الْأَرْضِ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَقَالُوا مَنْ أَشَدُّ مِنَّا قُوَّةً أَوَلَمْ يَرَوْا أَنَّ اللَّهَ الَّذِي خَلَقَهُمْ هُوَ أَشَدُّ مِنْهُمْ قُوَّةً وَكَانُوا بِآَيَاتِنَا يَجْحَدُونَ (15) فَأَرْسَلْنَا عَلَيْهِمْ رِيحًا صَرْصَرًا فِي أَيَّامٍ نَحِسَاتٍ لِنُذِيقَهُمْ عَذَابَ الْخِزْيِ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَلَعَذَابُ الْآَخِرَةِ أَخْزَى وَهُمْ لَا يُنْصَرُونَ (16)
“আর আদ সম্প্রদায় অন্যায়ভাবে পৃথিবীতে দম্ভ করত এবং বলত: আমাদের চেয়ে অধিক শক্তিশালী আর কে আছে? তাহলে তারা কি লক্ষ্য করেনি, যে আল্লাহ তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন তিনি তাদের চেয়ে অধিক শক্তিশালী? অথচ (এই দম্ভের কারণে) তারা সারাক্ষণ আমার নিদর্শনাবলীকে অস্বীকার করত।” (৪১:১৫)
“অবশেষে আমি তাদের উপর অশুভ দিনগুলোতে শীতল ঝঞ্ঝাবায়ু পাঠালাম যাতে তাদেরকে দুনিয়ার জীবনে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি আস্বাদন করাতে পারি। আর নিঃসন্দেহে আখিরাতের শাস্তি অধিকতর অপমানকর এবং তাদেরকে (সেদিন) সাহায্য করা হবে না।” (৪১:১৬)
আরব দেশের দক্ষিণ প্রান্তে আদ জাতি বাস করত। দৈহিক উচ্চতা ও শক্তিতে তাদের জুড়ি ছিল না। তারা ছিল যুদ্ধবাজ এবং প্রচুর সম্পদের অধিকারী। উঁচু স্থানে তারা আবাসস্থল নির্মাণ করত এবং তাদের ছিল সুন্দর সুন্দর প্রাসাদ। তারা নিজেদেরকে অজেয় ভাবত এবং মনে করত পৃথিবীতে তাদের চেয়ে শক্তিশালী আর কেউ নেই। এই অনুভূতি তাদেরকে উদ্ধত ও অহংকারী করে তুলেছিল। তাই তারা তাদের নবী হযরত হুদ (আ.)কে বলত: “আল্লাহর আদেশ না মানলে যে শাস্তি আসবে, সেকথা বলার তুমি কে? আমাদেরকে পরাজিত করার বা ধ্বংস করার মতোও কেউ আছে নাকি?” নিজেদের শক্তি ও সংখ্যার আধিক্য তাদেরকে এতটা অন্ধ করে দিয়েছিল যে, সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ ও তাঁর প্রেরিত পুরুষকে প্রত্যাখ্যান করতে তারা এতটুকু দ্বিধা করেনি।
কিন্তু তারা একথা বিন্দুমাত্র উপলব্ধি করার চেষ্টা করেনি যে, যে আল্লাহ তাদের সৃষ্টি করেছেন তিনি তাদের চেয়ে শক্তিশালী। তিনি শুধু তাদের সৃষ্টিকর্তাই নন বরং আসমান-জমিনে বিদ্যমান সবকিছু তাঁর সৃষ্টি এবং মানুষের কথিত শক্তির সঙ্গে তাঁর অসীম ক্ষমতা ও শক্তির কোনো তুলনা চলে না।
যাই হোক, আদ জাতির কৃতকর্মের জন্য পার্থিব জীবনেই তাদের ওপর লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি নেমে আসে। টানা এক সপ্তাহ ধরে তাদের জনপদের উপর দিয়ে ঘুর্ণিঝড় বয়ে যায় এবং তাদের লোকালয়, বাগান ও ফসলের ক্ষেত সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। ফলে সেই সুরম্য প্রাসাদ, অট্টালিকা ও সঞ্চিত সম্পদের ধ্বংসাবশেষ ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- ঔদ্ধত্ব ও অহংকারের কারণে কুফরি করলে তার শাস্তি দুনিয়াতেই পেতে হয়।
২- শক্তির দম্ভ এমন এক বিপদ যা ব্যক্তি ও সমাজকে দুনিয়াতেই চরম অপমান ও লাঞ্ছিত করে।
৩- যে দিনক্ষণে যখন আল্লাহর রহমত আসে সেটি শুভ এবং যে সময়টিতে শাস্তি আসে সেটি অশুভ।
সূরা ফুসসিলাতের ১৭ ও ১৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
وَأَمَّا ثَمُودُ فَهَدَيْنَاهُمْ فَاسْتَحَبُّوا الْعَمَى عَلَى الْهُدَى فَأَخَذَتْهُمْ صَاعِقَةُ الْعَذَابِ الْهُونِ بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ (17) وَنَجَّيْنَا الَّذِينَ آَمَنُوا وَكَانُوا يَتَّقُونَ (18)
“আর সামুদ জাতি, আমি তাদেরকে সঠিক পথে চলার নির্দেশ দিয়েছিলাম। কিন্তু তারা সঠিক পথে চলার পরিবর্তে অন্ধ হয়ে থাকাকেই পছন্দ করেছিল। কাজেই, তাদের কৃতকর্মের কারণে অপমানজনক শাস্তির বজ্রাঘাত তাদেরকে পাকড়াও করল।” (৪১:১৭)
“আর যারা ঈমান এনেছে ও তাকওয়া অবলম্বন করেছে, আমি তাদেরকে উদ্ধার করলাম।” (৪১:১৮)
আদের পর এই দুই আয়াতে সামুদ জাতির পরিণতি বর্ণনা করা হয়েছে। এই জাতির লোকেরা আরব দেশের উত্তর প্রান্তে বসবাস করত। তারা পাহাড়ের ভেতরে সুরম্য অট্টালিকা নির্মাণ করেছিল এবং তাদের ছিল সুজলা সুফলা শষ্যখেত ও বাগান।
আল্লাহ তায়ালা এই জাতি সম্পর্কে বলেন: আমি এই জাতিকে সৎপথ প্রদর্শনের জন্য হযরত সালেহ (আ.)কে তাদের কাছে পাঠিয়েছিলাম। হযরত সালেহ উপযুক্ত দলিল-প্রমাণ এবং অলৌকিক নিদর্শন নিয়ে তাদের সামনে হাজির হন। কিন্তু সামুদ জাতি তা গ্রহণ করেনি বরং আল্লাহ ও তাঁর নবীর শিক্ষা প্রত্যাখ্যান করে। তারা সত্য দেখার ও তা উপলব্ধি করার চেষ্টা না করে অন্ধ হয়ে থাকাকেই শ্রেয় মনে করে।
গোঁয়ার্তুমির কারণে ওই অহংকারী সম্প্রদায় সত্য গ্রহণ করা থেকে বিরত থেকেছে; মূর্খতা বা সত্য উপলব্ধি করতে না পারার কারণে নয়। এ কারণে তাদেরকে পার্থিব জীবনেই চরম অপমানকর শাস্তি গ্রাস করে নিয়েছে। ভয়ানক বজ্রপাতে তাদের লোকালয় ও জনপদ জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে গেছে। শুধু বিদ্যুৎ চমকানি ও বজ্রপাত নয় সেইসঙ্গে প্রচণ্ড ভূমিকম্পেও তাদের জনপদ কেঁপে ওঠে ও ধ্বংস হয়ে যায়।
অবশ্য যারা হযরত সালেহ’র দাওয়াতের বাণী কবুল করে ঈমান এনেছিল ও তাকওয়া অবলম্বন করেছিল তাদেরই এই শাস্তি ভোগ করতে হয়নি। মহান আল্লাহ তাদেরকে এই ভয়ঙ্কর আযাব থেকে রক্ষা করেছিলেন।
এই দুই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:
১- অন্তরের উপলব্ধি ক্ষমতাকে বন্ধ করে রাখার মাধ্যমে মানুষ কাফের হয়ে যায়।
২- আল্লাহর রহমত ও শাস্তি দু’টিই একটি নিয়ম মেনে আসে এবং মানুষের কর্মের পরিণতিতে হয়। ঈমান ও পবিত্র জীবন মুক্তির চাবিকাঠি; অন্যদিকে কুফর ও পাপকাজ ধ্বংসের মাধ্যম।#
পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/২৪
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।