জুন ২৩, ২০২১ ১৭:১৯ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র এ পর্বে সূরা ফুসসিলাতের ১৯ থেকে ২৩ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ১৯ ও ২০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

وَيَوْمَ يُحْشَرُ أَعْدَاءُ اللَّهِ إِلَى النَّارِ فَهُمْ يُوزَعُونَ (19) حَتَّى إِذَا مَا جَاءُوهَا شَهِدَ عَلَيْهِمْ سَمْعُهُمْ وَأَبْصَارُهُمْ وَجُلُودُهُمْ بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ (20)

“আর (স্মরণ করুন সেদিনের কথা) যেদিন আল্লাহর শত্রু দেরকে আগুনের দিকে সমবেত করা হবে এবং তাদেরকে থামিয়ে দেয়া হবে (যাতে অন্যরাও তাদের কাছে পৌঁছে যেতে পারে)।”(৪১:১৯)

“পরিশেষে যখন তারা আগুনের কাছে পৌঁছাবে তখন তাদের কান, চোখ ও শরীরের চামড়া তারা যা কিছু করত তার সাক্ষী দেবে।” (৪১:২০)

জালিম ও অপরাধীরা পৃথিবীর জীবনেই কি ধরনের শাস্তি পায় সে সম্পর্কে আমরা গত আসরে আলোচনা করেছি। এরপর এই দুই আয়াতে পরকালে তাদেরকে যে শাস্তি দেয়া হবে সে সম্পর্কে ইঙ্গিত করা হয়েছে। বলা হচ্ছে: যারা আল্লাহর প্রেরিত নবী-রাসূল ও তাঁদের শিক্ষার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে যায় এবং তাদের বিরুদ্ধাচরণ করে তারা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহরই শত্রু। দৃশ্যত তারা নবী-রাসূলদের বিরোধিতা করলেও তাদের প্রকৃত শত্রুতা আল্লাহ তায়ালারই সঙ্গে। কাজেই পৃথিবীতে যেমন অপরাধীদেরকে এক রশিতে বেঁধে টেনে টেনে কারাগারের দিকে নিয়ে যাওয়া হয় তেমনি কিয়ামতের দিন তাদেরকে ফেরেশতারা লাইনে দাঁড় করিয়ে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাবেন। জাহান্নামের আগুন চোখে দেখার পর তা থেকে বাঁচার জন্য অপরাধী ও পাপী ব্যক্তিরা নিজেদেরকে নির্দোষ দাবি করবে এবং নিজেদের দোষ অন্যের কাঁধে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করবে।

পবিত্র কুরআন বলছে: এ অবস্থায় চোখ, কান ও চামড়াসহ অপরাধীদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কথা বলা শুরু করবে এবং তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী দেবে। নিজের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের এমন সাক্ষ্য অস্বীকার করার কোনো উপায় তাদের থাকবে না। এসব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অপরাধীদের প্রতিটি পাপকাজের সময় উপস্থিত ছিল এবং সব ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। এখান থেকে বোঝা যায়, পার্থিব জীবনের প্রতিটি কথা ও কাজ মানুষের নিজের শরীরেই রেকর্ড হয়ে থাকে এবং তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তার সব কাজের সাক্ষী হয়ে থাকে। কাজেই কিয়ামতের দিন হবে জাহান্নামবাসীর জন্য মহা কলঙ্ক ও লজ্জার দিন। সেদিন তার জীবনের সব গোপন রহস্য উন্মোচিত হয়ে যাবে।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- শিরক ও কুফরের বিভিন্ন স্তর রয়েছে। মানুষ শিরক ও কুফরি করতে করতে এমন স্থানে পৌঁছে যায় যে, তখন আল্লাহকে অস্বীকার করার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বিরুদ্ধে শত্রুতাও শুরু করে দেয়। এ ধরনের মানুষ আল্লাহর সঙ্গে শত্রুতা ও আক্রোশের কারণে আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নবী-রাসূলদের শিক্ষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে এবং নানা ধরনের বিদ্বেষী পদক্ষেপ গ্রহণ করে।

২- শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সাক্ষ্য প্রমাণ করে, তারা মানুষের কৃতকর্ম দেখছে এবং তা সংরক্ষণ করে রাখছে। পার্থিব জগতে তারা যা কিছু উপলব্ধি করছে কিয়ামতের দিন সে সম্পর্কে তারা আল্লাহর কাছে প্রতিবেদন পেশ করবে।

সূরা ফুসসিলাতের ২১ ও ২৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

وَقَالُوا لِجُلُودِهِمْ لِمَ شَهِدْتُمْ عَلَيْنَا قَالُوا أَنْطَقَنَا اللَّهُ الَّذِي أَنْطَقَ كُلَّ شَيْءٍ وَهُوَ خَلَقَكُمْ أَوَّلَ مَرَّةٍ وَإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ (21) وَمَا كُنْتُمْ تَسْتَتِرُونَ أَنْ يَشْهَدَ عَلَيْكُمْ سَمْعُكُمْ وَلَا أَبْصَارُكُمْ وَلَا جُلُودُكُمْ وَلَكِنْ ظَنَنْتُمْ أَنَّ اللَّهَ لَا يَعْلَمُ كَثِيرًا مِمَّا تَعْمَلُونَ (22) وَذَلِكُمْ ظَنُّكُمُ الَّذِي ظَنَنْتُمْ بِرَبِّكُمْ أَرْدَاكُمْ فَأَصْبَحْتُمْ مِنَ الْخَاسِرِينَ (23)

“আর তারা তাদের (শরীরের) চামড়াকে বলবে, কেন তোমরা আমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিলে? তারা বলবে, যে আল্লাহ সব কিছুকে বাকশক্তি দিয়েছেন তিনি আমাদেরকেও কথা বলার শক্তি দিয়েছেন। তিনি প্রথমবার তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাঁরই নিকট তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।” (৪১:২১)

“তোমাদের কান, চোখ ও চামড়া তোমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে না- এ বিশ্বাসে তোমরা এদের নিকট (নিজেদের গোনাহগুলোকে) গোপন করতে না; উপরন্তু (একই বিশ্বাসে) তোমরা মনে করতে যে, তোমরা যা করো, তার অনেক কিছুই আল্লাহ জানেন না!” (৪১:২২)

“আর তোমাদের রব সম্বন্ধে তোমাদের এ (ভ্রান্ত) ধারণাই তোমাদের ধ্বংস করেছে। ফলে তোমরা হয়েছ ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত।” (৪১:২৩)

শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি যখন জাহান্নামবাসীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে তখন এসব মানুষ প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে নিজেদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে ধমক দেয়া শুরু করে দেবে। তারা বলবে, তোমরা কি আমার শরীরের হাত, পা, চোখ, কান ও চামড়া নও? আমি কি বছরের পর বছর ধরে তোমাদের সঙ্গে বসবাস করিনি; তোমাদেরকে সব রকম বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করিনি? তাহলে কেন তোমরা আজ আমার বিরুদ্ধে এভাবে সাক্ষ্য দিচ্ছ? গোনাহগার ব্যক্তিদের এসব প্রশ্নের উত্তরে তাদের শরীরের অঙ্গগুলো কঠিন স্বরে বলবে: আমরা নিজেদের ইচ্ছায় কথা বলিনি, বরং যে আল্লাহ তোমাদেরকে দুনিয়ার জীবনে সৃষ্টি করেছিলেন এবং মৃত্যুর পর আজকের এই ভয়ঙ্কর দিনে তোমাদেরকে আবার অস্তিত্ব দিয়েছেন; তিনি সবকিছুকে বাকশক্তি দিয়েছেন যা থেকে আমরাও বঞ্চিত হইনি।         

যখন পার্থিব জীবনে তোমাদেরকে বলা হতো: একজন আল্লাহ আছেন, তিনি তোমাদের প্রতিটি কর্ম সম্পর্কে জানেন এবং তার কাছে কোনো কিছু গোপন থাকে না- তখন তোমরা তাতে বিশ্বাস করতে না। তোমরা মনে করতে, তোমাদের বহু খারাপ কাজ আল্লাহ দেখতে পাচ্ছেন না। তোমরা এটাও বিশ্বাস করতে না যে, আমরাও তোমাদের প্রতিটি ও আচরণ প্রত্যক্ষ করছি এবং একদিন আমাদের বাকশক্তি খুলে যাবে এবং আমরা তোমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেব। এ কারণে তোমরা লোকচক্ষুর অন্তরালে পাপকাজ করতে; কিন্তু জানতে না যে, আল্লাহ তায়ালা তোমাদের অন্তর ও বাইরের সব খবর জানেন এবং তাঁর নিয়োজিত বাহিনী সার্বক্ষণিকভাবে তোমাদের ক্রিয়াকলাপ পর্যবেক্ষণ করছে।

পাপী ব্যক্তিদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আরো বলবে: প্রকৃতপক্ষে আমরা তোমার দেহের অঙ্গগুলি তোমার সকল কাজে সাক্ষী ও প্রত্যক্ষদর্শী ছিলাম। যাই হোক, নিজেদের রব সম্পর্কে তোমাদের ভ্রান্ত ধারণার কারণে আজ তোমরা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছো এবং চরম ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হতে যাচ্ছ।

এখানে বলে রাখা ভালো যে, বাকশক্তি খুলে যাওয়া শুধু মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকবে না। বরং পবিত্র কুরআনের ভাষ্য অনুযায়ী কিয়ামতের দিন আসমান, জমিন এবং জাহান্নামও কথা বলবে।

এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- মানুষের মূল হচ্ছে তার রুহ বা অন্তর এবং শরীর হচ্ছে তার নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দেয়া একটি হাতিয়ার। কাজেই কিয়ামতের দিন এই হাতিয়ার মানুষের মূল বা রুহের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে পারবে।   

২- কিয়ামত দিবসেরর সাক্ষীরা এত নিখুঁত ও সঠিক সাক্ষ্য দেবে যে, তা অস্বীকার করার কোনো উপায় মানুষের থাকবে না।

৩- আমাদের চারপাশের সব জড় বস্তু ও আমাদের শরীরের নির্বাক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ একদিন আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছায় বাকশক্তি ফিরে পাবে এবং তারা যা কিছু দেখেছে আমাদের বিরুদ্ধে তার সাক্ষ্য দেবে।

৪- পাপী মানুষেরা তাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সাক্ষ্যদানের বিষয়ে উদাসিন বলে গুনাহ করতে কুণ্ঠিত হয় না। কিন্তু মানুষ যদি একথা মনে করে যে, আল্লাহ তায়ালা তাকে দেখছেন তাহলে প্রকাশ্য বা গোপন কোনো স্থানেই তার পক্ষে পাপকাজ করা সম্ভব নয়।#

পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/২৪

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।