সূরা ফুসসিলাত: আয়াত ২৪-২৮ (পর্ব-৫)
পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র এ পর্বে সূরা ফুসসিলাতের ২৪ থেকে ২৮ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ২৪ ও ২৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
فَإِنْ يَصْبِرُوا فَالنَّارُ مَثْوًى لَهُمْ وَإِنْ يَسْتَعْتِبُوا فَمَا هُمْ مِنَ الْمُعْتَبِينَ (24) وَقَيَّضْنَا لَهُمْ قُرَنَاءَ فَزَيَّنُوا لَهُمْ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ وَحَقَّ عَلَيْهِمُ الْقَوْلُ فِي أُمَمٍ قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِهِمْ مِنَ الْجِنِّ وَالْإِنْسِ إِنَّهُمْ كَانُوا خَاسِرِينَ (25)
“সুতরাং (এখন) যদি তারা ধৈর্য ধারণ করে (তবুও) জাহান্নামই হবে তাদের আবাস, আর যদি তারা ক্ষমা প্রার্থনা করে (তবুও) তারা ক্ষমাপ্রাপ্ত হবে না।” (৪১:২৪)
“আর আমি তাদের জন্য (মন্দ) সহচরবৃন্দ নির্ধারণ করে দিয়েছিলাম, যারা তাদের সামনে ও পিছনে যা আছে তা তাদের দৃষ্টিতে চাকচিক্যময় করে দিয়েছিল। আর তাদের উপরেও আযাবের বাণী সত্যে পরিণত হল তাদের পূর্বে গত হওয়া জিন ও মানুষের বিভিন্ন জাতির ন্যায়। নিশ্চয় এরা ছিল ক্ষতিগ্রস্ত।” (৪১:২৫)
গত আসরের আলোচনার ধারাবাহিকতায় খারাপ বন্ধুর কারণে মানুষের কঠিন পরিণতির প্রতি ইঙ্গিত করে এই দুই আয়াতে বলা হচ্ছে: কিয়ামতের দিন গোনাহগার ব্যক্তিদের ক্ষমাপ্রার্থনা মঞ্জুর করা হবে না। কারণ, সেদিন পাপী ব্যক্তিরা জাহান্নামের আগুন স্বচক্ষে দেখার পর ভয় পেয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করবে। সেদিন ক্ষমা চাওয়া ছাড়া পাপী ব্যক্তিদের আর কোনো উপায় থাকবে না। কাজেই সেদিন তারা ধৈর্যধারন করুক বা না করুক তাতে কোনো পার্থক্য হবে না। সেদিন ক্ষমাপ্রার্থনা করলেও তাদের স্থান হবে জাহান্নাম।
পরের আয়াতে এই কঠিন আজাবের কারণ হিসেবে পার্থিব জীবনে অসৎ ও খারাপ বন্ধু নির্বাচনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। খারাপ ও মন্দকাজ করলেও এসব বন্ধু সেসব কাজ থেকে বিরত থাকার উপদেশ দানের পরিবর্তে মানুষকে ওই পাপকাজ করতে উৎসাহ যোগায়। তারা খারাপ কাজকে অত্যন্ত ভালো ও সুন্দর হিসেবে উপস্থাপন করে। এ ধরনের অপরাধী ও কুকর্মশীল বন্ধু মানুষকে সারাক্ষণ চারদিক থেকে ঘিরে রাখে এবং তার চিন্তা করার ক্ষমতার ওপর এমনভাবে প্রভাব বিস্তার করে যে, তার পক্ষে ভালো ও মন্দ কাজের পার্থক্য করা কঠিন হয়ে পড়ে।
এ কারণে তাদের কাছে সত্য উল্টো হিসেবে ধরা দেয় এবং খারাপ কাজকে সুন্দর ও চাকচিক্যময় মনে হয়। কাজেই দেখা যাচ্ছে, খারাপ বন্ধু নির্বাচন করার কারণে মানুষ অধঃপতনের চরম সীমায় পৌঁছে যায়। এর ফলে সে যে শুধু আজকের দিনটিকে খারাপ ভিত্তির উপর দাঁড় করায় তাই নয় সেইসঙ্গে তার পরকালীন মুক্তির পথও বন্ধ হয়ে যায়। এই পথ অবলম্বন করে অতীতের বহু জাতি জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হয়েছে।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- যতদিন পার্থিব জীবন আছে ততদিন তওবা করে আল্লাহর রাস্তায় ফিরে আসার সুযোগ রয়েছে। কিয়ামতের দিন তওবা কিংবা ক্ষমাপ্রার্থনা কবুল হবে না।
২- খারাপ ও দুশ্চরিত্র মানুষ যেন আমাদের বন্ধু হিসেবে জুটে না যায়। তাহলে তারা ছলে-বলে-কৌশলে আমাদেরকে জাহান্নামের পথে পরিচালিত করবে।
৩- যারা আমাদের খারাপ কাজের প্রশংসা করে তারা আমাদের প্রকৃত বন্ধু নয়। মনে রাখতে হবে, তারা মানুষরূপী শয়তান হিসেবে আমাদেরকে ধোকা দিতে এসেছে।
৪- মানুষের অধঃপতন হয় ধীরে ধীরে ও পর্যায়ক্রমে। প্রথম পর্যায়ে খারাপ বন্ধুরা তার সামনে মন্দ জিনিসকে আকর্ষণীয় হিসেবে তুলে ধরে। এরপর ইন্দ্রীয়সুখ লাভ করার জন্য ওই কথিত আকর্ষণীয় বিষয়গুলো নিয়ে মত্ত হয়ে গেলেই মানুষের জাহান্নামে যাওয়ার পথ উন্মুক্ত হয়ে যায়।
সূরা ফুসসিলাতের ২৬ থেকে ২৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
وَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا لَا تَسْمَعُوا لِهَذَا الْقُرْآَنِ وَالْغَوْا فِيهِ لَعَلَّكُمْ تَغْلِبُونَ (26) فَلَنُذِيقَنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا عَذَابًا شَدِيدًا وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَسْوَأَ الَّذِي كَانُوا يَعْمَلُونَ (27) ذَلِكَ جَزَاءُ أَعْدَاءِ اللَّهِ النَّارُ لَهُمْ فِيهَا دَارُ الْخُلْدِ جَزَاءً بِمَا كَانُوا بِآَيَاتِنَا يَجْحَدُونَ (28)
“আর কাফিররা বলে, তোমরা এ কুরআন শুন না এবং (তা তেলাওয়াতের সময়) হট্টগোল ও শোরগোল সৃষ্টি কর, যাতে তোমরা জয়ী হতে পার।”(৪১:২৭)
“সুতরাং আমি অবশ্যই কাফিরদেরকে কঠিন শাস্তি আস্বাদন করাব এবং অবশ্যই আমি তাদেরকে তাদের নিকৃষ্ট কার্যকলাপের প্রতিফল দেব।”(৪১:২৯)
“আল্লাহর দুশমনদের প্রতিদান এই (জাহান্নামের) আগুন, সেখানে তাদের জন্য রয়েছে স্থায়ী আবাস, তারা যে সারাক্ষণ আমার আয়াতগুলোকে অস্বীকার করত তার প্রতিফলস্বরূপ।”(৪১:২৮)
এই তিন আয়াতের শুরুতে রাসূলে আকরাম (সা.)-এর সঙ্গে মক্কার কাফিরদের একটি জঘন্য কাজের প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হচ্ছে: যখনই বিশ্বনবী মক্কাবাসীর সামনে পবিত্র কুরআনের আকর্ষণীয় ও মিষ্টিমধুর আয়াতগুলো তেলাওয়াত করতেন তখন এই তেলাওয়াত যাতে মানুষের কানে পৗঁছাতে না পারে সেজন্য কাফেররা শিশ বাজাত অথবা উচ্চস্বরে কোনো কবিতা আওড়াতে থাকত। মানুষকে ঈমানের আলো থেকে বঞ্চিত রাখা ছিল এই জঘন্য কাজের উদ্দেশ্য। আজকের পৃথিবীতেও নানা পদ্ধতিতে এই একই কাজ চলছে। কারণ, সত্য ধর্মের শত্রুরা একথা ভালো করে জানে যে, মানুষ যখনই পবিত্র কুরআনের শিক্ষার সংস্পর্শে আসবে তখনই তাদের বিশাল একটা অংশ তা মনেপ্রাণে গ্রহণ করবে। এ কারণে তারা তাদের গণমাধ্যম ও নানারকম প্রচারযন্ত্রকে কাজে লাগিয়ে সব সময় এমন একটা আবহ সৃষ্ট করে রাখে যাতে ইসলাম ও মুসলমানদের কথা- কুরআনের কথা মানুষের কানে পৌঁছাতে না পারে।
তারা তাদের অশুভ লক্ষ্য চরিতার্থ করার জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নানা উপকরণ ব্যবহার করে। সিনেমা, নাটক, চিত্রকলা, ক্যারিকেচার, গল্প ও উপন্যাসের ভেতরে তারা ধর্মীয় মূল্যবোধগুলোকে আক্রমণ করে বক্তব্য রাখে। এরা দ্বীন সম্পর্কে মিথ্যা ও অবাস্তব তথ্য ছড়িয়ে দিয়ে এবং নানা ধরনের অপবাদ ও অস্পষ্টতা তৈরি করে ইসলামের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ন করে যাতে বিশ্ববাসী এই পবিত্র ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট না হয়।
অবশ্য এটি শত্রুদের অলীক কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ, এ ধরনের কাজকর্ম করে ইসলামের বিস্তার রোধ করা যায় না। নিঃসন্দেহে সত্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এই যে, একের পর এক বাধা অতিক্রম করে সে সামনের দিকে এগিয়ে যায় এবং নিজের চলার পথ তৈরি করে নেয়। এ কারণেই আজ বিশ্বব্যাপী কুরআনের প্রতি মানুষের আকর্ষণ বেড়েছে এবং ইসলাম গ্রহণকারীর সংখ্যা দৃশ্যমান হারে বাড়ছে।
এটা স্পষ্ট যে, যারা কুরআনের আয়াত শোনার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এবং সবাইকে খারাপ কাজের প্রতি উসকানি দিয়ে জাহান্নামের পথে নিয়ে যায় তাদের জন্য রয়েছে ভয়াবহ শাস্তি। যারা অনবরত কুরআনের আয়াত অস্বীকার করে তারা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ ও তার দ্বীনের শত্রুতে পরিণত হয়। কাজেই তাদের কৃতকর্মের মতো তাদের শাস্তিও হবে ভয়ঙ্কর এবং জাহান্নাম থেকে তাদের মুক্তিরও কোনো উপায় থাকবে না।
এই তিন আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হলো:
১- সাধারণত যাদের কাছে বলার মতো যুক্তিপূর্ণ ও ন্যায়সঙ্গত কিছু থাকে না তারাই নানা অজুহাতে মানুষকে যৌক্তিক কথা শোনা থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করে।
২- পবিত্র কুরআনের বিশেষ আকর্ষণীয় ক্ষমতা রয়েছে। যদি কেউ এই মহাগ্রন্থের আয়াতের অর্থ না বোঝে তারপরও শুধুমাত্র এর তেলাওয়াত শুনলেও মানুষ কুরআনের প্রতি আকৃষ্ট হয়। এ কারণে শত্রুরা কুরআনের আয়াত শোনার পরিবেশ ধ্বংস করতে ব্যস্ত।
৩- যারা সত্য উপলব্ধি করা সত্ত্বেও জেনেবুঝে দ্বীনের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে তাদের জন্যই চিরকালীন আবাস জাহান্নাম প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এটি তাদের ন্যায়সঙ্গত শাস্তি।#
পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/২৪
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।