সূরা ফুসসিলাত: আয়াত ৩১-৩৬ (পর্ব-৭)
পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র এ পর্বে সূরা ফুসসিলাতের ৩১ থেকে ৩৬ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ৩১ ও ৩২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
نَحْنُ أَوْلِيَاؤُكُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الْآَخِرَةِ وَلَكُمْ فِيهَا مَا تَشْتَهِي أَنْفُسُكُمْ وَلَكُمْ فِيهَا مَا تَدَّعُونَ (31) نُزُلًا مِنْ غَفُورٍ رَحِيمٍ (32)
“দুনিয়ার জীবনে ও আখিরাতে আমরা তোমাদের বন্ধু ও সহযোগী আর জান্নাতে তোমাদের যা কিছু মনে চাইবে তা প্রস্তুত থাকবে এবং সেখানে তোমরা যা কিছু দাবি করবে তা তোমাদের জন্য (প্রস্তুত) থাকবে।” (৪১:৩১)
“চরম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু আল্লাহর পক্ষ হতে (এসব হবে) আপ্যায়ন।” (৪১:৩২)
আগের আয়াতে প্রকৃত মুমিন ব্যক্তিদের অন্তরে ফেরেশতা নাজিল হওয়ার কথা উল্লেখ করার পর এই দুই আয়াতে বলা হচ্ছে: তারা শুধু পার্থিব জীবনেই মুমিন ব্যক্তিদের আত্মিক প্রশান্তি যোগায় না বরং কিয়ামতের দিনও তাদের বন্ধু ও সহযোগী হিসেবে তাদেরকে জান্নাতের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। ফেরেশতারা সেখানে তাদেরকে আল্লাহ তায়ালার অতিথি হিসেবে আপ্যায়ন করবে। সেখানে মানুষ যা পেতে আকাঙ্ক্ষা করবে তা তার জন্য আগে থেকে প্রস্তুত করা আছে। পার্থিব জীবনে এসব মুমিন ব্যক্তি তাদের নফস বা অন্তরের নিষিদ্ধ কামনা-বাসনা দমন করে রেখেছিল বলে তাদেরকে এই মহা পুরস্কার দেয়া হচ্ছে। সেখানে কোনো কামনা-বাসনা অবৈধ নয় বরং মানুষ যা কিছু চাইবে সঙ্গে সঙ্গে তা তার সামনে হাজির করা হবে। সেদিনের আপ্যায়ন হবে মহা দয়ালু আল্লাহ তায়ালার পক্ষ হতে এবং সেদিনের অতিথি হবে জান্নাতি পুতপবিত্র চরিত্রের অধিকারী মানুষ।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় একটি দিক হলো:
১- নফসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত মুমিন ব্যক্তিদের দুনিয়ার জীবনে বন্ধু কম থাকলেও তাদের রয়েছে আসমান থেকে আগত ফেরেশতা-বন্ধু যারা দুনিয়া ও আখিরাতে তাদেরকে সব ধরনের সাহায্য করবে।
সূরা ফুসসিলাতের ৩৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلًا مِمَّنْ دَعَا إِلَى اللَّهِ وَعَمِلَ صَالِحًا وَقَالَ إِنَّنِي مِنَ الْمُسْلِمِينَ (33)
“তার চেয়ে কার কথা উত্তম যে (মানুষকে) আল্লাহর দিকে আহবান জানায় ও সৎকাজ করে এবং বলে, অবশ্যই আমি মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত।”(৪১:৩৩)
যারা মানুষকে আল্লাহর রাসূলের কথা ও কুরআনের বাণী শুনতে বাধা দিয়েছিল তাদের বিপরীতে এই আয়াতে বলা হচ্ছে: কিছু মানুষ আছে যারা তাদের আকষর্ণীয় কথা ও আচরণের মাধ্যমে মানুষকে আল্লাহর দিকে আহ্বান করে। তারা নিজেদেরকে মুসলমান হিসেবে পরিচয় দিয়ে সেজন্য গর্ব অনুভব করে। এই আয়াতে বলা হচ্ছে: আল্লাহ ও তাঁর একত্ববাদের দিকে আহ্বানকারীর চেয়ে উত্তম বক্তব্য আর হতে পারে না। এসব মানুষ তাদের সৎ কাজ ও নেক আমলের মাধ্যমে নিজেদের মুখ নিঃসৃত দাওয়াতের বাণীর সত্যতা প্রমাণ করে।
শুধু নিজে সত্য উপলব্ধি করা এবং তা আমল করা যথেষ্ট নয়; বরং অন্য মানুষকেও আল্লাহর দিকে আহ্বান করতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, নিজের কাজে ও কথায় সেই আহ্বানের ছাপ থাকতে হবে।
এক্ষেত্রে মুসলমানদের মধ্যে একটি বিশেষ দলকে দ্বীন প্রচারের কাজে নিয়োজিত থাকতে হবে। এরাই হলেন আলেম ও মুবাল্লেগে দ্বীন যারা ধর্মকে সব ধরনের বিকৃতি থেকে রক্ষা এবং ধর্ম সম্পর্কে মানুষের অন্তর থেকে সন্দেহ-সংশয় দূর করার দায়িত্ব পালন করেন।
তবে এর অর্থ এই নয় যে, আলেমরা এই কাজে নিয়োজিত বলে সাধারণ মুসলমানদের কোনো দায়িত্ব নেই। প্রত্যেক মুসলমানকে তার সামর্থ্য অনুযায়ী মানুষের মধ্যে আল্লাহর একত্ববাদের প্রচার ও প্রসার ঘটানোর চেষ্টা করতে হবে। আল্লাহর দিকে মানুষকে আহ্বান জানানোর সবচেয়ে সাধারণ উদাহরণ আজান দেয়া।
সূরা ফুসসিলাতের ৩৪ ও ৩৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
وَلَا تَسْتَوِي الْحَسَنَةُ وَلَا السَّيِّئَةُ ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ فَإِذَا الَّذِي بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأَنَّهُ وَلِيٌّ حَمِيمٌ (34) وَمَا يُلَقَّاهَا إِلَّا الَّذِينَ صَبَرُوا وَمَا يُلَقَّاهَا إِلَّا ذُو حَظٍّ عَظِيمٍ (35)
“আর ভাল ও মন্দ সমান নয়। (অপরের মন্দ) সর্বোৎকৃষ্ট উপায়ে প্রতিহত করুন; তখন (দেখবেন) আপনার ও যার মধ্যে শক্ৰতা আছে, সে শত্রুতা- অন্তরঙ্গ বন্ধুত্বে পরিণত হবে। ”(৪১:৩৪)
“অবশ্য ধৈর্যশীল ব্যক্তি ছাড়া আর কেউ এই (গুণের) অধিকারী হয় না, এবং (ঈমান ও তাকওয়ার গুণে গুণান্বিত) মহা সৌভাগ্যবান ছাড়া আর কেউ তা অর্জন করতে পারে না। ” (৪১:৩৫)
সত্যের বিরোধিতাকারীরা মন্দ কথা বলা, গালিগালাজ, কটাক্ষ ও বিদ্রূপ করা এবং নানা ধরনের হুমকি ও চাপ সৃষ্টির আশ্রয় নেয়। কাজেই এ ধরনের মানুষের কাছে সত্যের দাওয়াত পৌঁছে দিতে গেলে চরম ধৈর্য ও সহ্যশক্তি থাকতে হবে। এ কারণে এই দুই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলছেন: দ্বীনের বিরোধিতাকারীরা মন্দ কথা ও পন্থার আশ্রয় নেয়া সত্ত্বেও তোমরা তাদের মতো আচরণ করতে পারবে না। তোমাদেরকে সঠিক পথে থাকতে হবে এবং কুৎসিত আচরণের জবাবে একই ধরনের আচরণ করা যাবে না। তোমাদেরকে নমনীয় ও সহানুভূতিশীল আচরণ করতে হবে। তাদের উগ্র ও বিদ্রূপাত্মক কথার জবাব দিতে হবে যুক্তিপূর্ণ ও কোমল বক্তব্যের মাধ্যমে। এ কাজ করতে পারলে সত্যের বিরোধিতাকারীদের অন্তরে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে এবং তারা তোমাদের বন্ধুতে পরিণত হবে।
আল্লাহর রাসূল (সা.) ও তাঁর আহলে বায়েতের জীবনাদর্শ ও দ্বীন প্রচারের পদ্ধতি ছিল ঠিক এরকম। তাঁরা দ্বীনের বিরোধিতাকারীদের সঙ্গে এমন ব্যবহার করতেন যে, বিরুদ্ধবাদীরা তাদের উগ্র আচরণের জন্য লজ্জিত হতো। মক্কা বিজয়ের সময় কিছু মুসলমান প্রতিশোধ গ্রহণের দাবি জানিয়েছিলেন কিন্তু আল্লাহর রাসূল সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। এই মহামানবের এই বিস্ময়কর আচরণ দেখে বহু কাফের মুসলমান হয়ে যায়।
স্বাভাবিকভাবেই ধৈর্যের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন ছাড়া এরকম আচরণ করা সম্ভব নয়। একজন মানুষ যখন ঈমানের নূরে আলোকিত হয়ে সর্বোত্তম চারিত্রিক গুণাবলী অর্জন করে তখনই তার পক্ষে প্রতিশোধস্পৃহা দমন করা এবং মন্দ আচরণের জবাব উত্তম আচরণ দিয়ে দেয়া সম্ভব হয়।
এই দুই আয়াতের একটি শিক্ষণীয় দিক হলো:
১- যুদ্ধের ময়দানে শত্রুর যেকোনো আঘাতের প্রত্যাঘাত করাই কর্তব্য। কিন্তু সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রতিশোধ বা পাল্টা আঘাত অসহিষ্ণুতার প্রমাণ বহন করে। যে সমাজে এ ধরনের আচরণ বেশি সে সমাজে শান্তি আসতে পারে না।
সূরা ফুসসিলাতের ৩৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
وَإِمَّا يَنْزَغَنَّكَ مِنَ الشَّيْطَانِ نَزْغٌ فَاسْتَعِذْ بِاللَّهِ إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ (36)
“আর যদি শয়তানের পক্ষ থেকে কোন কুমন্ত্রণা আপনাকে প্ররোচিত করে, তাহলে আপনি আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করুন। নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞাতা।" (৪১:৩৬)
বিতাড়িত শয়তান মানুষকে নানাভাবে প্ররোচিত করার চেষ্টা করে। মানুষে মানুষে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করা শয়তানের অন্যতম কর্ম এবং মানুষের মধ্যে বন্ধুত্ব ও অন্তরঙ্গতা সৃষ্টি হলে শয়তান কষ্ট পায়। তাই আল্লাহ তায়ালা এই আয়াতে বিশ্বনবী (সা.)সহ সকল মুমিনকে উদ্দেশ করে বলছেন: মানুষকে দ্বীনের দাওয়াত দিতে গিয়ে যখনই শত্রুদের কটূকথা সহ্য করবে এবং তাদের সঙ্গে বিনয়ীভাবে কথা বলবে তখনই শয়তান প্রকৃতির লোকেরা এসে তোমাদেরকে একথা বোঝানোর চেষ্টা করবে যে, ওদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা উচিত হয়নি বরং ওদেরকে দাঁতভাঙা জবাব দেয়া উচিত ছিল; ওরা এটারই প্রাপ্য। আল্লাহ বলছেন: এ ধরনের কথাবার্তা তোমাদের বন্ধু ও হিতাকাঙ্ক্ষীদের মুখ থেকে বের হলেও প্রকৃতপক্ষে এর বুদ্ধিদাতা শয়তান।
কাজেই এ ধরনের কথাবার্তায় কখনো প্ররোচিত হওয়া যাবে না। নিজেকে আল্লাহ তায়ালার হাতে সঁপে দিতে হবে, তাঁর ছায়াতলে আশ্রয় নিতে হবে এবং তাঁর ওপর নির্ভর করতে হবে; কারণ তিনি সবকিছু শোনেন ও জানেন।#
পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/২৬
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।