সূরা ফুসসিলাত: আয়াত ৩৭-৪০ (পর্ব-৮)
পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র এ পর্বে সূরা ফুসসিলাতের ৩৭ থেকে ৪০ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ৩৭ ও ৩৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
وَمِنْ آَيَاتِهِ اللَّيْلُ وَالنَّهَارُ وَالشَّمْسُ وَالْقَمَرُ لَا تَسْجُدُوا لِلشَّمْسِ وَلَا لِلْقَمَرِ وَاسْجُدُوا لِلَّهِ الَّذِي خَلَقَهُنَّ إِنْ كُنْتُمْ إِيَّاهُ تَعْبُدُونَ (37) فَإِنِ اسْتَكْبَرُوا فَالَّذِينَ عِنْدَ رَبِّكَ يُسَبِّحُونَ لَهُ بِاللَّيْلِ وَالنَّهَارِ وَهُمْ لَا يَسْأَمُونَ (38)
“তাঁর (ক্ষমতার) নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে রাত ও দিন, সূর্য ও চাঁদ। তোমরা সূর্যকে সিজদা করো না, চাঁদকেও নয়; সিজদা করো আল্লাহকে, যিনি এগুলি সৃষ্টি করেছেন, যদি তোমরা প্রকৃতই তাঁর ইবাদাত কর।” (৪১:৩৭)
“অতঃপর তারা যদি অহংকার করে তবে (তারা জেনে নিক যে), আপনার প্রতিপালকের নিকটে যারা রয়েছে তারা দিন-রাত তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা বর্ণনায় লিপ্ত আছে, আর তারা কখনও ক্লান্তিবোধ করে না।” (৪১:৩৮)
এই দুই আয়াতের শুরুতে ইতিহাস জুড়ে মানুষ যেসব পদ্ধতিতে শিরক করেছে তার একটি উদাহরণ তুলে ধরে বলা হয়েছে: সূর্য ও চন্দ্র আল্লাহর সৃষ্ট বস্তু ছাড়া আর কিছু নয়। অথচ যুগে যুগে মানুষ সৃষ্টিকর্তা আল্লাহকে বাদ দিয়ে তাঁর সৃষ্ট বস্তু- চাঁদ ও সূর্যের উপাসনা করেছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, দিন-রাত ও চন্দ্র-সূর্য সবকিছু মানুষের জন্য আল্লাহর নির্দশন। রাতের অন্ধকার দেয়া হয়েছে বিশ্রাম গ্রহণের জন্য এবং তিনি দিনের আলো দিয়েছেন কাজ-কর্ম করা ও রিজিক অন্বেষণের জন্য। মানুষের জীবনকে সুন্দর ও সুবিন্যস্তভাবে পরিচালনা করার জন্যই রাত ও দিন প্রদান করেছেন মহান আল্লাহ।
সৌরজগতের প্রতিটি প্রাণীর জন্য শক্তির উৎস হিসেবে কাজ করে সূর্য। ভূপৃষ্ঠে বেঁচে থাকার জন্য সূর্য অপরিহার্য। আলো, তাপ, বায়ূপ্রবাহ, বৃষ্টিপাত, গাছের চারা গজানো, ফল ধরা, এমনকি ফুলের নানা বিচিত্র রঙেরও উৎস সূর্য। অন্যদিকে রাতের অন্ধকারে চাঁদও মিষ্টি আলো বিতরণের পাশাপাশি সাগর ও মরুভূমিতে চলাচলকারী মানুষকে পথ চলতে সহায়তা করে।
এতকিছুর পরও এই সূর্য ও চাঁদ আল্লাহর বাধ্যগত বস্তু এবং নিজেদের থেকে করার মতো কোনো শক্তি তাদের নেই। কিন্তু কিছু মানুষ এ বিষয়টি উপলব্ধি না করে সূর্য ও চাঁদকে সিজদা করে। আল্লাহ তায়ালা আজকের প্রথম আয়াতে এই শিরকি কাজ না করার নির্দেশ দিয়েছেন।
পরের আয়াতে বলা হচ্ছে: আল্লাহর একত্ববাদের দাওয়াত গ্রহণ করে একদল মানুষ আল্লাহ তায়ালার ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল হয়। কিন্তু কিছু মানুষ তাদের পূর্বপুরুষদের ভ্রান্ত বিশ্বাসে অটল থাকার অজুহাতে আল্লাহর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় এবং বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করতেও রাজি হয় না। এখানে বিশ্বনবী (সা.)কে উদ্দেশ করে আল্লাহ বলছেন: কিছু মানুষ তাদের ভ্রান্ত মতাদর্শে অটল থাকতে চায় বলে আপনি মনে কষ্ট নেবেন না। কারণ, আল্লাহর কাছে থাকা ফেরেশতারা সারাক্ষণ তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করছে এবং এই ইবাদত করতে গিয়ে তারা কখনো ক্লান্ত হয় না।
এই দুই আয়াতের কয়েকটি শক্ষিণীয় বিষয় হচ্ছে:
১- প্রকৃতি ও এর জীবন বাঁচানো উপাদানগুলোকে চিনতে পারলে খুব সহজেই আল্লাহকে চেনা সম্ভব। তবে এই চেনার জন্য আন্তরিকতার অভাব থাকতে পারবে না।
২- গর্ব, অহঙ্কার ও নিজেকে বড় মনে করা হচ্ছে আল্লাহকে চেনা ও তাঁর প্রতি ঈমান আনার পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায়।
৩- আল্লাহ তায়ালা মানুষের ইবাদতের মুখাপেক্ষী নন। যদি পৃথিবীর সব মানুষও তাঁর ইবাদত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তবুও আল্লাহর কোনো ক্ষতি হবে না। তাঁকে পরিবেষ্টনকারী ফেরেশতারা দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা আল্লাহ তায়ার মহিমা ও প্রশংসা বর্ণনা করছে।
সূরা ফুসসিলাতের ৩৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
وَمِنْ آَيَاتِهِ أَنَّكَ تَرَى الْأَرْضَ خَاشِعَةً فَإِذَا أَنْزَلْنَا عَلَيْهَا الْمَاءَ اهْتَزَّتْ وَرَبَتْ إِنَّ الَّذِي أَحْيَاهَا لَمُحْيِي الْمَوْتَى إِنَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ (39)
“আর তাঁর একটি নিদর্শন এই যে, আপনি ভূমিকে দেখতে পান শুষ্ক ও অনুর্বর, অতঃপর যখন আমরা তাতে (আকাশ থেকে) পানি বর্ষণ করি তখন তা আন্দোলিত হয় ও গাছের চারা গজায়। নিশ্চয় যিনি যমীনকে জীবিত করেন তিনি নিশ্চিতভাবে মৃতদের জীবনদানকারী। নিঃসন্দেহে তিনি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান।” (৪১:৩৯)
চাঁদ ও সূর্যের মাহাত্ম্য বর্ণনা করার পর এই আয়াতে ভূপৃষ্ঠের মৃত অবস্থার কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে: যখনই সেখানে বৃষ্টির পানি বর্ষিত হয় তখন মাটি জীবন ফিরে পায় এবং গাছপালা গজিয়ে ওঠে। পৃথিবী আবার সবুজ শ্যামল ও সুজলা সুফলা হয়ে ওঠে।
নিঃসন্দেহে বৃষ্টির পানি বর্ষণ করে মৃত মাটি থেকে এত জীবন সৃষ্টি করা আল্লাহ ছাড়া আর কারো পক্ষে সম্ভব নয়। কাজেই এটি আল্লাহ তায়ালার মহাজ্ঞান ও অসীম ক্ষমতার একটি নিদর্শন। কাজেই যে আল্লাহ মানুষের চোখের সামনে মৃত মাটি থেকে জীবিতের আবির্ভাব ঘটাচ্ছেন তার পক্ষে কি কিয়ামতের দিন মৃত মানুষকে আবার জীবিত করা সম্ভব নয়? অবশ্যই সম্ভব। আল্লাহ তায়ালার সীমাহীন শক্তি ও ক্ষমতা নিয়ে কোনো ধরনের সন্দেহ-সংশয় থাকা উচিত নয়।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- মানুষ যদি কখনো আল্লাহ তায়ালার অসীম ক্ষমতার ব্যাপারে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যায় তখন তার উচিত হবে বৃষ্টি, বাতাস, মাটি, গাছপালা ইত্যাদির দিকে নজর দেয়া। তাহলে সে দ্বিধাদ্বন্দ্ব কেটে যাবে।
২- কিছু মানুষ এই সন্দেহ-সংশয়কে পুঁজি করে পরকালে অবিশ্বাস করে। কিন্তু পরকালের অস্তিত্ব অস্বীকার করার পক্ষে শক্ত কোনো যুক্তি তুলে ধরা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না।
সূরা ফুসসিলাতের ৪০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
إِنَّ الَّذِينَ يُلْحِدُونَ فِي آَيَاتِنَا لَا يَخْفَوْنَ عَلَيْنَا أَفَمَنْ يُلْقَى فِي النَّارِ خَيْرٌ أَمْ مَنْ يَأْتِي آَمِنًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ اعْمَلُوا مَا شِئْتُمْ إِنَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ (40)
“নিশ্চয় যারা আমার আয়াতসমূহে বক্রপথ অবলম্বন করে তারা আমার অগোচর নয়। যে ব্যক্তি জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে সে শ্রেষ্ঠ; নাকি যে কিয়ামতের দিন নিরাপদে (ও প্রশান্ত চিত্তে) উপস্থিত হবে সে (শ্রেষ্ঠ)? তোমাদের যা ইচ্ছা কর, তোমরা যা কর, তিনি তার দ্রষ্টা।” (৪১:৪০)
সত্যের বিরোধিতাকারীরা মন্দ কথা বলা, গালিগালাজ, কটাক্ষ ও বিদ্রূপ করা এবং নানা ধরনের হুমকি ও চাপ সৃষ্টির আশ্রয় নেয়। কাজেই এ ধরনের মানুষের কাছে সত্যের দাওয়াত পৌঁছে দিতে গেলে চরম ধৈর্য ও সহ্যশক্তি থাকতে হবে। এ কারণে এই দুই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলছেন: দ্বীনের বিরোধিতাকারীরা মন্দ কথা ও পন্থার আশ্রয় নেয়া সত্ত্বেও তোমরা তাদের মতো আচরণ করতে পারবে না। তোমাদেরকে সঠিক পথে থাকতে হবে এবং কুৎসিত আচরণের জবাবে একই ধরনের আচরণ করা যাবে না। তোমাদেরকে নমনীয় ও সহানুভূতিশীল আচরণ করতে হবে। তাদের উগ্র ও বিদ্রূপাত্মক কথার জবাব দিতে হবে যুক্তিপূর্ণ ও কোমল বক্তব্যের মাধ্যমে। এ কাজ করতে পারলে সত্যের বিরোধিতাকারীদের অন্তরে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে এবং তারা তোমাদের বন্ধুতে পরিণত হবে।
আল্লাহর রাসূল (সা.) ও তাঁর আহলে বায়েতের জীবনাদর্শ ও দ্বীন প্রচারের পদ্ধতি ছিল ঠিক এরকম। তাঁরা দ্বীনের বিরোধিতাকারীদের সঙ্গে এমন ব্যবহার করতেন যে, বিরুদ্ধবাদীরা তাদের উগ্র আচরণের জন্য লজ্জিত হতো। মক্কা বিজয়ের সময় কিছু মুসলমান প্রতিশোধ গ্রহণের দাবি জানিয়েছিলেন কিন্তু আল্লাহর রাসূল সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। এই মহামানবের এই বিস্ময়কর আচরণ দেখে বহু কাফের মুসলমান হয়ে যায়।
স্বাভাবিকভাবেই ধৈর্যের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন ছাড়া এরকম আচরণ করা সম্ভব নয়। একজন মানুষ যখন ঈমানের নূরে আলোকিত হয়ে সর্বোত্তম চারিত্রিক গুণাবলী অর্জন করে তখনই তার পক্ষে প্রতিশোধস্পৃহা দমন করা এবং মন্দ আচরণের জবাব উত্তম আচরণ দিয়ে দেয়া সম্ভব হয়।
এই দুই আয়াতের একটি শিক্ষণীয় দিক হলো:
১- যুদ্ধের ময়দানে শত্রুর যেকোনো আঘাতের প্রত্যাঘাত করাই কর্তব্য। কিন্তু সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রতিশোধ বা পাল্টা আঘাত অসহিষ্ণুতার প্রমাণ বহন করে। যে সমাজে এ ধরনের আচরণ বেশি সে সমাজে শান্তি আসতে পারে না।#
পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/২৬
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।