জুন ২৩, ২০২১ ১৭:১৯ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র এ পর্বে সূরা ফুসসিলাতের ৪১ থেকে ৪৪ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ৪১ ও ৪২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا بِالذِّكْرِ لَمَّا جَاءَهُمْ وَإِنَّهُ لَكِتَابٌ عَزِيزٌ (41) لَا يَأْتِيهِ الْبَاطِلُ مِنْ بَيْنِ يَدَيْهِ وَلَا مِنْ خَلْفِهِ تَنْزِيلٌ مِنْ حَكِيمٍ حَمِيدٍ (42)

 “নিশ্চয় যারা তাদের নিকট কুরআন আসার পর তা প্রত্যাখ্যান করে, (তাদেরকে কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে) আর এই (কুরআন) অবশ্যই এক মহিমাময় (ও মহা শক্তিশালী) গ্রন্থ।” (৪১:৪১)

“সম্মুখ বা পশ্চাৎ হতে কোন মিথ্যা এতে অনুপ্রবেশ করে না।  (কারণ) এটা প্রজ্ঞাময় চিরপ্রশংসিত আল্লাহর পক্ষ হতে অবতীর্ণ।” (৪১:৪২)

যারা প্রতারণার মাধ্যমে ধর্মে বক্রতা এনে মানুষকে বিপথে পরিচালিত করতে এবং এর দ্বারা নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে চায় তাদের সম্পর্কে আমরা গত আসরে আলোচনা করেছি। এরপর আজকের এই দুই আয়াতে বলা হচ্ছে: এই কুরআন মানুষকে উপদেশ দেয়ার জন্য নাজিল হয়েছে যাতে তারা উদাসিনতার ঘুম থেকে জেগে উঠে তাদের মধ্যে যে খোদায়ী প্রবৃত্তি রয়েছে সেদিকে প্রত্যাবর্তন করে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে কিছু মানুষ এই কুরআনকে প্রত্যাখ্যান এবং ধর্মীয় বাস্তবতাকে অস্বীকার করে। কিন্তু এই আচরণের মাধ্যমে তারা এই আসমানি গ্রন্থের বিন্দুমাত্র ক্ষতি করতে পারে না। কারণ, আল্লাহর কিতাব চিরস্থায়ী ও অপরাজেয়; যার প্রতিটি কথা যুক্তিপূর্ণ, মহা শক্তিশালী এবং যার শিক্ষা ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ।

এখানে পবিত্র কুরআনের বিশালত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে আরো বলা হয়েছে, এই গ্রন্থ এমন এক সত্ত্বার কাছ থেকে নাজিল হয়েছে যার প্রতিটি কাজ প্রজ্ঞাপূর্ণ, যথার্থ ও অভ্রান্ত।  স্বাভাবিকভাবেই মহাপ্রজ্ঞাবান ও সপ্রশংসিত আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে যে কিতাব নাজিল হয়েছে তাতে সামনে বা পেছন থেকে কোনো ভ্রান্ত বা মিথ্যা বক্তব্য অনুপ্রবেশ করতে পারে না। এর কোনো আয়াতে পরস্পরবিরোধিতা বা স্ববিরোধিতা নেই, এর শিক্ষা ও আইনে কোনো ভুল নেই এবং ভ্রান্ত পথের অনুসারীরা এই কিতাবে কোনো ধরনের ত্রুটি যুক্ত করতে পারবে না। একইভাবে কারো পক্ষে এই গ্রন্থের বিষয়বস্তুকে ভুল প্রমাণ করা সম্ভব নয়।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ পৃথিবীতে পথভ্রষ্ট হয়ে যেতে না চাইলে আমাদেরকে বেশি বেশি কুরআন তেলাওয়াত করতে হবে। তাহলে আমরা সঠিক পথের দিশা পেতে থাকব।

২- পবিত্র কুরআন নিজের ভবিষ্যত নিয়ে কথা বলেছে। সুস্পষ্ট ভাষায় এতে বলা হয়েছে, এই কুরআনকে বিকৃত করার সাধ্য কারো নেই।

৩- কুরআনের আয়াতে মহান আল্লাহর বুৎপত্তি ও প্রজ্ঞার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বলে এই গ্রন্থ ইসলাম ধর্মের জন্য অভ্রান্ত পৃষ্ঠপোষক হিসেবে পরিগণিত।

সূরা ফুসসিলাতের ৪৩ ও ৪৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

مَا يُقَالُ لَكَ إِلَّا مَا قَدْ قِيلَ لِلرُّسُلِ مِنْ قَبْلِكَ إِنَّ رَبَّكَ لَذُو مَغْفِرَةٍ وَذُو عِقَابٍ أَلِيمٍ (43) وَلَوْ جَعَلْنَاهُ قُرْآَنًا أَعْجَمِيًّا لَقَالُوا لَوْلَا فُصِّلَتْ آَيَاتُهُ أَأَعْجَمِيٌّ وَعَرَبِيٌّ قُلْ هُوَ لِلَّذِينَ آَمَنُوا هُدًى وَشِفَاءٌ وَالَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ فِي آَذَانِهِمْ وَقْرٌ وَهُوَ عَلَيْهِمْ عَمًى أُولَئِكَ يُنَادَوْنَ مِنْ مَكَانٍ بَعِيدٍ (44)

“(হে রাসূল) আপনাকে শুধু তা-ই বলা হচ্ছে, যা আপনার পূর্ববর্তী রাসূলদেরকেও বলা হয়েছিল। নিশ্চয় আপনার রব একান্তই ক্ষমাশীল এবং যন্ত্রণাদায়ক আযাব দাতা।” (৪১:৪৩)

“আমি যদি অনারবী (কোনো) ভাষায় কুরআন অবতীর্ণ করতাম, তাহলে ওরা অবশ্যই বলত, ‘এর আয়াতগুলি (বোধগম্য ভাষায়) বিবৃত হয়নি কেন? (কি আশ্চর্য যে, এর ভাষা) অনারবী (অথচ রাসূল) আরবী!’ (আপনি) বলে দিন, যারা ঈমান এনেছে এই কিতাব তাদের জন্য পথনির্দেশক ও ব্যাধির প্রতিকার। কিন্তু যারা ঈমান আনেনি তাদের কর্ণে রয়েছে বধিরতা (তারা যেন অন্ধ) এবং কুরআন তাদের অন্তরের উপর অন্ধত্ব তৈরি করবে (ফলে তাদের জন্য এর বাণী হবে অস্পষ্ট)।  (এরা এমন যেন) এদেরকে বহু দূর হতে আহবান করা হয় (কিন্তু তারা তা শুনতে পায় না)। (৪১:৪৪)

এই দুই আয়াতে বলা হচ্ছে: এরা শুধু কুরআনের বিরুদ্ধাচরণই করেনি সেইসঙ্গে আল্লাহর রাসূলকেও নানা ধরনের অসঙ্গত কথা বলেছে। তারা প্রিয়নবী (সা.)কে যাদুকর, কবি ও পাগল বলে আখ্যায়িত করেছে। এখানে মহান আল্লাহ তাঁর রাসূলকে উদ্দেশ করে বলছেন: আপনার আগে গত হয়ে যাওয়া নবী-রাসূলদেরকেও এ ধরনের অসমীচীন ও অসঙ্গত কথা বলা হয়েছে এবং তাঁরাও এ ধরনের কাফেরদের মুখোমুখি হয়েছিলেন। কাজেই আপনি কাফেরদের বক্তব্য উপেক্ষা করুন এবং ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার সঙ্গে রিসালাতের দায়িত্ব পালন করে যান।

স্বাভাবিকভাবেই অজ্ঞ ও নিরপরাধ মানুষের জন্য আল্লাহ তায়ালার ক্ষমার ভাণ্ডার অবারিত। কিন্তু যারা জেনেবুঝে পরিকল্পিতভাবে মিথ্যা অপবাদ দেয় এবং পবিত্র কুরআন ও আল্লাহর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে তাদেরকে কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। আল্লাহর প্রিয় হাবিবের বিরোধিতাকারীদের একাংশ একথা বলত যে, তোমার কাছে আসা কিতাবটি কেন আরবি ভাষায় নাজিল হয়েছে? যদি তুমি সত্যিই নবী হয়ে থাকো তাহলে অনারবি কোনো ভাষায় কিতাব নাজিল করে দেখাও।  তুমি যদি এই মুজিযাটি দেখাতে পারো তাহলে আমরা বুঝব যে, তুমি সত্যিই আল্লাহর নবী। এই ধরনের মানুষদের এ বক্তব্যের জবাবে আল্লাহ তায়ালা  বলছেন: যদি আমি কুরআনকে অন্য ভাষায় নাজিল করতাম তাহলে তারা এই অজুহাত দেখাত যে, অন্য ভাষার এ কিতাবটি আমাদের জন্য বোধগম্য নয়। অথচ এখন তাদের বোধগম্য করে এটি যখন আরবি ভাষায় নাজিল করলাম তখন তারা অনর্থক তর্ক সৃষ্টি করে মানুষকে এই কিতাব শোনা থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করছে।

আয়াতের পরবর্তী অংশে বলা হচ্ছে: যারা পবিত্র কুরআনের প্রতি ঈমান এনেছে এই গ্রন্থ তাদের জন্য হেদায়াত ও অন্তরের ব্যধিমুক্তির উপলক্ষ। এই কিতাব দুনিয়া ও আখিরাতে মানুষকে পুতপবিত্র জীবনের দিকে আহ্বান করে। এই গ্রন্থ তোমাদের অন্তরসমূহে জমে থাকা ময়লা ও চারিত্রিক কলুষতা ধুয়েমুছে পরিষ্কার করে দেয় যাতে তোমরা পরিপূর্ণতায় পৌঁছাতে পারো।

কিন্তু দুঃখজনকভাবে কিছু মানুষ আছে যারা সত্যকে উপলব্ধি করতে বা তা শুনতে প্রস্তুত নয়। যেন তাদের চোখ বা কান নেই এবং তারা দেখতে ও শুনতে পায় না। তারা যদি ঈমান গ্রহণ করে সত্য অনুসন্ধানের প্রকৃত আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কুরআনের কাছে আসত তাহলে তারা হেদায়াতপ্রাপ্ত হতো এবং তাদের অন্তরের সব ব্যাধি ও চারিত্রিক দুষণ দূর হয়ে যেত।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- মুসলিম নেতৃবৃন্দ ও মুবাল্লিগদেরকে শত্রুদের অসঙ্গত কথা ও গালিগালাজ সহ্য করার মানসিকতা থাকতে হবে।

২- আল্লাহর ক্ষমা ও শাস্তি উভয়ই তাঁর প্রজ্ঞা থেকে উৎসারিত। যার যার জায়গা থেকে এই দুই উপাদান নেককার বান্দাদের উৎসাহ যোগানোর পাশাপাশি পাপী ব্যক্তিদের ভয় দেখায়; যদিও আল্লাহর ক্ষমা তাঁর ক্রোধের উপর বিজয়ী হয়।

৩- শত্রুদের অজুহাত সৃষ্টির প্রচেষ্টা কখনো থামবে না। মুসলমানরা যত ভালো আচরণই করুক তারা তাতে খুঁত বের করার চেষ্টা করবেই।

৪- কুরআন সঠিক পথ প্রদর্শনকারী কিতাব। এটি অন্তরের রোগ, চারিত্রিক কলুষতা ও সামাজিক অনাচারের প্রতিষেধক। তবে শর্ত হচ্ছে এর বাণী গ্রহণ ও ধারণ করার মানসিকতা থাকতে হবে।#

পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/২৬

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।