সূরা ফুসসিলাত: আয়াত ৪৫-৪৮ (পর্ব-১০)
পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র এ পর্বে সূরা ফুসসিলাতের ৪৫ থেকে ৪৮ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ৪৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
وَلَقَدْ آَتَيْنَا مُوسَى الْكِتَابَ فَاخْتُلِفَ فِيهِ وَلَوْلَا كَلِمَةٌ سَبَقَتْ مِنْ رَبِّكَ لَقُضِيَ بَيْنَهُمْ وَإِنَّهُمْ لَفِي شَكٍّ مِنْهُ مُرِيبٍ (45)
“আর আমি মূসাকে কিতাব (অর্থাৎ তাওরাত) দিয়েছিলাম, অতঃপর তাতে মতভেদ ঘটেছিল। আর যদি আপনার রবের পূর্বাপর নিয়ম (অর্থাৎ মানুষকে সময় দেয়ার বিধান) না থাকত তবে তাদের মধ্যে (ধ্বংসের) ফয়সালা হয়ে যেত। আর নিশ্চয় এরাও (মুসার জাতির মতো) এই কুরআন সম্বন্ধে অস্থিরতাপূর্ণ সংশয়ের মধ্যে রয়েছে।” (৪১:৪৫)
গত আসরে আমরা বলেছিলাম, মক্কার কাফিররা রাসূলে আকরাম (সা.)কে আরবি ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় কুরআন নাজিল করার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিল। আর আজকের এই আয়াতে আল্লাহর রাসূলকে উদ্দেশ করে বলা হচ্ছে: হযরত মূসা (আ.)-এর জামানায়ও বনি ইসরাইল জাতি একই ধরনের অজুহাত দাঁড় করিয়েছিল এবং তাওরাতের সত্যতা নিয়ে মতভেদে লিপ্ত হয়েছিল। আল্লাহ তায়ালা তৎক্ষণাৎ তাদেরকে শাস্তি দিতে পারতেন। কিন্তু তাঁর বিধান হচ্ছে ভুল পথে পরিচালিত মানুষকে সঠিক পথে ফিরে আসার জন্য সময় দেয়া।
তবে ঐশী গ্রন্থ সম্পর্কে স্বাভাবিক যে সংশয় তৈরি হতে পারে মক্কার কাফিরদের সেরকম সংশয় ছিল না। স্বাভাবিক সংশয় মানুষ গবেষণা ও তত্ত্ব-তালাশের মাধ্যমে দূর করতে পারে। কিন্তু মক্কার কাফিররা ইচ্ছাকৃতভাবে বিভ্রান্তিকর সংশয় তৈরি করছিল যাতে কুরআনের বাণী তাদের শুনতেই না হয়। কুরআনের সত্যাসত্য যাচাই করার বিন্দুমাত্র আকাঙ্ক্ষা তাদের ছিল না।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- কাফির ও গোনাহগার ব্যক্তিকে ঈমানের পথে ফিরে আসার জন্য সময় দেয়ার ঐশী বিধান না থাকলে প্রতিটি মানুষ প্রথমবার গোনাহ করার সঙ্গে সঙ্গে ধ্বংস হয়ে যেত। তার পক্ষে আর বেঁচে থাকা সম্ভব হতো না।
২- কারো মনে কোনো বিষয়ে সংশয় তৈরি হলে ওই বিষয়ে সত্যে উপনিত হওয়ার জন্য তাকে গবেষণা ও অনুসন্ধান চালাতে হবে। অযথা সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দেয়া শুভবুদ্ধির পরিচায়ক নয়।
সূরা ফুসসিলাতের ৪৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
مَنْ عَمِلَ صَالِحًا فَلِنَفْسِهِ وَمَنْ أَسَاءَ فَعَلَيْهَا وَمَا رَبُّكَ بِظَلَّامٍ لِلْعَبِيدِ (46)
“যে ব্যক্তি সৎকাজ করে সে তার নিজের কল্যাণের জন্যই তা করে এবং কেউ মন্দ কাজ করলে তার প্রতিফল সে-ই ভোগ করে। আর আপনার রব তার বান্দাদের প্রতি মোটেই জুলুম করেন না।” (৪১:৪৬)
এই আয়াতে আল্লাহ তায়ালার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চিরন্তন বিধানের কথা উল্লেখ করে বলা হচ্ছে: যদি কেউ সৎকাজ করে তবে তা থেকে সে নিজেই উপকৃত হয় এবং যদি কেউ খারাপ কাজ করে তবে তার ফলও সে-ই ভোগ করে। কারণ, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি অবিচার করেন না।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কেউ যদি নিজে ইচ্ছা করে বিষমিশ্রিত খাবার খেয়ে ফেলে তাহলে সে মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়বে এবং প্রচণ্ড কষ্ট পাবে। তার এই কষ্টের জন্য অন্য কেউ দায়ী নয় এবং অন্য কেউ সে কষ্ট ভোগও করে না। কুফর ও গোনাহ করলেও পার্থিব জীবনেই মানুষকে বিভিন্নভাবে কষ্ট ভোগ করতে হয়। আর আখিরাতে এর জন্য রয়েছে জাহান্নামের ভয়াবহ আজাব।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- আমরা যখন কোনো কাজ করার ব্যাপারে স্বাধীন থাকি অর্থাৎ আমাদের ওপর কাজটি জোর করে চাপিয়ে দেয়া না হয় তখন সে কাজে ভুল করে ফেললে তার ক্ষতিকর পরিণতির জন্য অন্য কাউকে দায়ী করা যাবে না।
২- জীবনে বিপদ-আপদ ও বালা-মুসিবত আসলে আমরা যেন সেজন্য আল্লাহকে দায়ী না করি। কারণ, আল্লাহ কারো প্রতি অবিচার করেন না। যেকোনো বিপদ আমাদেরই কর্মের ফসল।
সূরা ফুসসিলাতের ৪৭ ও ৪৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
إِلَيْهِ يُرَدُّ عِلْمُ السَّاعَةِ وَمَا تَخْرُجُ مِنْ ثَمَرَاتٍ مِنْ أَكْمَامِهَا وَمَا تَحْمِلُ مِنْ أُنْثَى وَلَا تَضَعُ إِلَّا بِعِلْمِهِ وَيَوْمَ يُنَادِيهِمْ أَيْنَ شُرَكَائِي قَالُوا آَذَنَّاكَ مَا مِنَّا مِنْ شَهِيدٍ (47) وَضَلَّ عَنْهُمْ مَا كَانُوا يَدْعُونَ مِنْ قَبْلُ وَظَنُّوا مَا لَهُمْ مِنْ مَحِيصٍ (48)
“কিয়ামতের দিনক্ষণের জ্ঞান কেবল আল্লাহর নিকটই আছে এবং তাঁর অজ্ঞাতসারে কোন ফল আবরণ মুক্ত হয় না, কোন নারী গর্ভধারণ ও সন্তান প্রসব করে না। যেদিন (আল্লাহ) মুশরিকদের ডেকে বলবেন, ‘আমার (সেসব) অংশীদাররা কোথায় (যাদেরকে আমার সঙ্গে শরীক করতে?)’ তখন ওরা বলবে: ‘আমরা উচ্চকণ্ঠে আপনার নিকট নিবেদন করেছি যে, (এ ব্যাপারে) আমাদের কাছে কোনো সাক্ষী নেই’।”(৪১:৪৭)
“আর আগে তারা যাদেরকে (সৃষ্টিকর্তা বলে) ডাকত তারা তাদের কাছ থেকে উধাও হয়ে যাবে এবং তারা উপলব্ধি করবে যে, তাদের পলায়নের আর কোন উপায় নেই।”(৪১:৪৮)
এই দুই আয়াতে বলা হচ্ছে: কিয়ামত কবে সংঘটিত হবে সে জ্ঞান আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কারো কাছে নেই। যদিও নবী-রাসূলগণের মাধ্যমে কিয়ামতের কিছু আলামত বলে দেয়া হয়েছে কিন্তু এ সম্পর্কে নিশ্চিত জ্ঞান একমাত্র আল্লাহর কাছে রয়েছে। শুধু কিয়ামত নয় পার্থিব জীবনেরও এমন কিছু বিষয় আছে যেগুলোর রহস্য মানুষের অজানা কিন্তু তা আল্লাহর কাছে সুস্পষ্ট। যেমন ফলের আবরণের মধ্যে কি আছে তার সঠিক জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ জানেন। একইভাবে একজন নারীর গর্ভে কি আছে তাও আল্লাহই ভালো জানেন।
আজকাল প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষ গর্ভের সন্তান ছেলে না মেয়ে তা জানতে পারে। কিন্তু সেই সন্তান সুস্থ হয়ে জন্ম নেবে নাকি অসুস্থ অবস্থায় ভূমিষ্ঠ হবে, তার গায়ের রং কি হবে, সে কতো বছর বাঁচবে, বড় হয়ে সে কী হবে, পূর্ণবয়সে তার উচ্চতা কেমন হবে, সে জান্নাতবাসী হবে নাকি জাহান্নামী হবে- এসব জ্ঞান মানুষের পক্ষে প্রযুক্তি দিয়ে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা গর্ভাবস্থায়ই এর প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান রাখেন।
পরের আয়াতে বলা হচ্ছে: পার্থিব জীবনে যারা আল্লাহর সঙ্গে বহু বস্তু ও ব্যক্তিকে শরীক করত ও বিপদ-আপদে তাদের কাছে ধর্না দিত কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা মুশরিকদেরকে তাদের সেসব কল্পিত খোদাদের ডাকতে বলবেন। তিনি বলবেন: আজকের আজাব থেকে বাঁচার জন্য পারলে তাদেরকে ডাকো। উত্তরে তারা স্বীকার করবে: তাদের সে ধারণা ভুল ছিল এবং আজ সে ধারণা প্রমাণ করার জন্য কোনো দলিল বা সাক্ষী তাদের কাছে নেই। সেদিন তাদের দৃষ্টিসীমা থেকে সেসব কল্পিত খোদা অদৃশ্য হয়ে যাবে এবং তারা উপলব্ধি করবে যে, আল্লাহর হাত থেকে আজ তাদের পালানোর আর কোনো পথ নেই।
এই দুই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে:
১- আমরা কিয়ামতের দিনক্ষণ জানি না বলে তা ঘটবে না তা নয়। কিয়ামত অবশ্যই সংঘটিত হবে।
২- আল্লাহ শুধু বড় বড় বিষয় সম্পর্কেই অবহিত নন বরং বিশ্বের প্রতিটি বিষয়ের খুঁটিনাটি জ্ঞান তাঁর কাছে রয়েছে।
৩- পার্থিব জীবনে আমরা যেন এমন কারো আশ্রয়প্রার্থী না হই যার পক্ষে কিয়ামতের দিন আমাদেরকে আশ্রয় দেয়া সম্ভব হবে না।#
পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/২৬
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।