জুন ২৯, ২০২১ ১২:৩৩ Asia/Dhaka

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার উত্তরার একটি অভিজাত ক্লাবে নারী নির্যাতনের ঘটনা দুর্ভাগ্যজনক, লজ্জাজনক এবং দুঃখজনক। এটি আসলে ভাষায় প্রকাশের মতো নয়। বিশিষ্ট মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন রেডিও তেহরানকে দেয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে একথা বলেছেন।

তিনি বলেন, এধরনের ঘটনায় বোঝা যায় আমাদের সমাজে নারীর নিরাপত্তা প্রতি পদে পদে বিঘ্নিত হচ্ছে। অভিজাত শ্রেণি পরীমনির ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করছে। একজন নারীর শ্লীলতাহানির ঘটনা যে ক্লাবটিতে ঘটেছে-সেই ক্লাবটি সরকারি জায়গায় এবং ঐ ক্লাবটির সভাপতি পুলিশের আইজিপি। আর সেখানে মদ খাওয়া,জুয়া খেলা এবং নতর্কী নাচানো হতো বলে শুনেছি। দুর্ভাগ্যজনক যে এই ধরনের ক্লাবের কর্মকর্তা হিসেবে সরকারের উর্ধ্বতন চাকুরিরত ব্যক্তিরা যুক্ত হন।

সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ, উপস্থাপনা ও তৈরি করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।

‘আমাদের সমাজ এবং রাষ্ট্র যারা পরিচালনা করেন সেই জায়গায় এরইমধ্যে  নৈতিক অবক্ষয় ছড়িয়ে পড়েছে এবং সমাজ অরক্ষিত হচ্ছে। আজকের এই সমাজকে ডোমিনেট করছে লুটেরা, দুর্বৃত্ত, পেশীশক্তি ও অর্থশক্তির মানুষেরা।‘

রেডিও তেহরান: জনাব নূর খান লিটন, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার উত্তরার একটি অভিজাত ক্লাবে সম্প্রতি একজন চিত্রনায়িকা বড় রকমের হেনস্তার শিকার হয়েছেন এবং এ নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় হয়েছে। এ ঘটনার মধ্যদিয়ে সমাজের উচ্চবিত্তের এবং চলচ্চিত্রজগতের একটি চিত্র প্রকাশ পাচ্ছে বলে অনেকে মনে করছেন। বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখছেন?

পরীমনির শ্লীলতহানি, অভিযোগ নাসিরের বিরুদ্ধে

নূর খান লিটন: দেখুন, বেশ কয়েকদিন আগে ঘটনাটি ঘটেছে। দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে একটি অভিজাত ক্লাবে ঘটনাটি ঘটেছে। যে ক্লাবের পরিচালনা পরিষদের সভাপতি হচ্ছেন বর্তমান পুলিশের আইজিপি জনাব বেনজীর আহমেদ। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশে একজন নারীর নিরাপত্তার বিষয়ের দিকে যদি আমরা খেয়াল করি তাহলে এই ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হলো যে, আমাদের সমাজে নারীদের নিরাপত্তা প্রতি পদে বিঘ্নিত হচ্ছে। একটি অভিজাত ক্লাবে একজন চিত্রনায়িকা এবং তার সাথে যারা ছিলেন তাদের উপস্থিতিতে এই ধরণের একটি ঘটনা সংঘটিত হওয়া লজ্জাকর, দুঃখজনক এবং বেদনাদায়ক। এটি আসলে ভাষায় প্রকাশের মতো নয়।

তবে আরেকটি দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে ঐ ঘটনার কয়েকদিন পর আমরা একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম আরেকটি অভিজাত ক্লাবে একধরণের প্রেস কনফারেন্স করা হয়েছে অথবা প্রেসের মানুষের সাথে তারা কথা বলেছেন। এতে মনে  হয়েছে ঘটনাটিকে হালকা করার জন্য কিংবা ধামাচাপা দেয়ার জন্য  একধরণের প্রয়াস এই অভিজাত শ্রেণির মধ্যে রয়েছে। অথবা তারা প্রচণ্ড ক্ষমতার অধিকারী। তারা বিষয়টিকে হালকা করে দেয়ার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে এবং অনেকে মনে করেন।

চিত্রনায়িকা পরীমনি জনসম্মুখে যে কথাগুলো বলেছেন, সে কথাগুলোর সত্যতা নিয়ে কোনো কথা বলার সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না। যদিও বিষয়টির এখন তদন্ত চলছে।

আমাদের দেশে যে জিনিসটি হচ্ছে – এ ধরণের ঘটনা নিয়ে কোনো ভিকটিম বিশেষ করে কোনো নারী ভিকটিম যদি তাদের বিষয় নিয়ে এগিয়ে আসেন সমাজে তখন সমাজের বিভিন্নস্তরের পক্ষ থেকে থামিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয় । পারতপক্ষে আমাদের সমাজে কিন্তু নারী ভিকটিমরা কথা বলতে চান না। তারপরও দু একজন যারা সাহস করে দাঁড়ান তাদের বিষয়টিকে হালকা করে দেয়ার জন্য বা থামিয়ে দেয়ার জন্য সব ধরনের প্রচেষ্টা সমাজের একেবারে নিম্নস্তর থেকে উচুঁ স্তর পর্যন্ত আমরা দেখেছি। কখনও কখনও নারীদেরকে ধমক দেয়া হয়। প্রচণ্ড চাপ প্রয়োগ করা হয় যাতে মামলা তুলে নেয়া হয় অথব বিষয়টি নিয়ে তারা কথা না বলেন।

দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে সেই ব্রিটিশ আমল থেকে এধরনের ক্লাব আছে। আর যতটকু জানতে পেরেছি ঐ ক্লাবটির জায়গা সরকারি। সেখানে মদ খাওয়া, জুয়া খেলা বা নর্তকী নাচানো বা এ ধরনের কার্যক্রম ঐ ক্লাবে চলত বলে শোনা যাচ্ছে। আর ঐ ক্লাবটির প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন বাংলাদেশ পুলিশের আইজিপি। দুর্ভাগ্যজনক যে এই ধরনের ক্লাবের কর্মকর্তা হিসেবে সরকারের উর্ধ্বতন চাকুরিরত ব্যক্তিরা যুক্ত হন। নৈতিক জায়গায় তারা কেন দৃঢ়তা দেখাতে পারেন না। যখন এই ধরনের ঘটনা ঘটে তখন নির্দ্ধিধায় বলতে হয়ে তাদের চারিত্রিক ক্রুটির কারণে সমাজে অনেক ভালো কাজ করা যাচ্ছে না। অনেক ভালো জিনিষ হারিয়ে যাচ্ছে।

রেডিও তেহরান:  উত্তরার ওই ক্লাবে যে ঘটনাটা ঘটেছে তা বিশ্লেষণ করলে যেমন অর্থের কুপ্রভাব বের হয়ে আসে, তেমনি ক্ষমতার দাপট এবং সমাজের উচ্চবিত্তের অরুচিকর কর্মকাণ্ড পরিষ্কার হয়। এই যে অবক্ষয়, কেন এমনটা হলো?

নূর খান লিটন: দেখুন, সমাজে নৈতিক অবক্ষয় আসে কারণ সমাজটাকে যাদের নেতৃত্ব দেয়ার কথা সেই সামাজিক শক্তি এবং রাজনৈতিক শক্তির ভেতর যখন নৈতিকতার অবক্ষয় দেখা দেয় তখন তার প্রভাব সমাজে পড়ে। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, আমাদের সমাজ এবং রাষ্ট্র যারা পরিচালনা করেন সেই জায়গায় এরইমধ্যে  নৈতিক অবক্ষয় ছড়িয়ে পড়েছে এবং অরক্ষিত হচ্ছে। আজকের এই সমাজকে ডোমিনেট করছে লুটেরা, দুর্বৃত্ত, পেশীশক্তি ও অর্থশক্তির মানুষেরা। সম্প্রতি গুলশানে অপর এক নারী আত্মহত্যা করেছেন নাকি তাকে হত্যা করা হয়েছে তা জানি না সেই নারীর ঘটনায় যাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে তিনি সম্ভবত বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি। তার বিরুদ্ধে যখন অভিযোগ করা হলো তারপর অনেক নাটকীয় ঘটনা আমরা দেখতে পেলাম। তখন সোশ্যাল মিডিয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন মিডিয়ায় এ সম্পর্কিত খবর প্রথম দিকে প্রকাশিত হয় নি। পরে দেখা গেছে তাদের টাকার দাপটের কাছে সাংবাদিকমহলেরও একধরনের সংশ্লিষ্টতা আমরা লক্ষ্য করেছি। তারমানে হচ্ছে এই সমাজে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে কালোটাকা, রাজনৈতিক অপশক্তি। সমাজে ক্রিমিনালদের কাছে এক ধরনের অসহায় হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষ।

রেডিও তেহরান: চিত্রনায়িকা পরিমনির এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে মামলা হয়েছে তার তদন্ত সূত্র ধরে যতই গভীরে যাওয়া হচ্ছে ততোই অনাচারের নানা রূপ বেরিয়ে আসছে যার সঙ্গে বিভৎসভাবে যুক্ত বিত্তবানের ক্ষমতার দাপট এবং নারী। তবে চূড়ান্ত পরিণতিতে দেখা যাচ্ছে নারীরাই ভিকটিম। সামগ্রিকভাবে বলা যায়-সমাজে নারীকে পণ্য বানানোর প্রবণতা নানাভাবে, নানা রূপে বাড়ছে। কেন এমনটি হচ্ছে?

নূর খান লিটন: দেখুন, দীর্ঘদিন ধরে যেভাবে নারীকে উপস্থাপন করা হচ্ছে-তাতে স্পষ্টভাবে মনে হচ্ছে নারীকে পণ্য হিসেবে দেখানোর প্রবণতা সমাজের একটা শ্রেণির ভেতর একেবারে দৃশ্যমান। যদি সেটা না হতো তাহলে সমাজে একজন নারীর উপর এ ধরনের নিপীড়ন, নির্যাতনের ঘটনা ঘটত না। এ ধরনের অভিযোগের কথা কল্পনাও করা যেত না। সাম্প্রতিককালে আমরা আরেকটা জিনিষ আমরা লক্ষ্য করেছি যে রাষ্ট্রীয় আচার-অনুষ্ঠানে আমরা নারীদের অংশগ্রহণকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারছি না। এখানে আমরা বলতে এখানে যারা নীতি নির্ধারক তাদের কথা বলছি। নারীদেরকে মর্যাদার আসনে ভাবার ক্ষেত্রে একধরনের কার্পণ্যতা আমাদের ভেতরে দেখা যাচ্ছে।

রেডিও তেহরান: একটা বিষয় খুবই পরিষ্কার যে, সমাজের উপর তলার লোকজনই এইসব অনাচারের সঙ্গে বিশেষভাবে যুক্ত। যেখানে সমাজের দারিদ্র, অনটন-নিপীড়ন দূর করার ক্ষেত্রে সমাজের এসব বিত্তশালী লোক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারতেন সেখানে তারাই যতসব অসভ্য অনাচারের সঙ্গে জড়িত। এই দুঃখজনক চিত্রের পরিবর্তন কিভাবে সম্ভব?

নূর খান লিটন: দেখুন, এটার পরিবর্তনের জন্য যে জিনিসটার খুব বেশি প্রয়োজন বলে আমি মনে করি সেটি হচ্ছে সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরে আদর্শ গড়ে তোলা। আদর্শের উপর ভিত্তি করে একটি রাষ্ট্র কিংবা একটি সমাজ যদি দাঁড়িয়ে থাকতে না পারে সেই রাষ্ট্র বা সমাজ আসলে দুর্বৃত্ত, খুনী, কালোটকা ও মাসলম্যানদের  দখলে চলে যায়। আর যখন সমাজ কিংবা রাষ্ট্র এদের দখলে চলে যায় তখন অনাচার,অবিচার বেড়ে যায়। সমাজে নৈতিকতার কোনো জায়গা আর থাকে না। আমরা কিন্তু সেই দিকে ধাবিত হচ্ছি এই ধরনের ঘটনার মধ্য দিয়ে এটি খুব স্পষ্ট।

রেডিও তেহরান: তো জনাব নূর খান লিটন একজন নারীর হেনস্থার ঘটনা নিয়ে সাম্প্রতিক সময় যে তোলপাড় হয়েছে সে সম্পর্কে রেডিও তেহরানের সাথে কথা বলার জন্য আপনাকে আবারও অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।#

পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/২৯